গাজী শাহনেওয়াজ

  ০৫ জানুয়ারি, ২০১৯

ভারসাম্য রক্ষায় বিরোধী দলে জাতীয় পার্টি

সরকার ও সংসদের ভারসাম্য রক্ষায় এবার জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে জাতীয় পার্টি। সংসদীয় নিয়মনীতির নানা কাঠামোতে এবার বিরোধী দলে থেকেও সরকারের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবেন দলটির সংসদ সদস্যরা। কার্যত দলটি সংসদের বিরোধী দল হলেও; মহাজোটের অন্যতম শরিক হওয়ায় এ সুবিধা পাবে। জাপার চেয়ারম্যান এরশাদ গতকাল এক চিঠিতে জানিয়েছেন, এবার তারা বিরোধী দলে থাকবেন।

দশম জাতীয় সংসদের মতো এবার বিরোধী দলে জাপা থাকলেও মন্ত্রিসভায় তাদের ঠাঁই হবে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও দলটির সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মন্ত্রিসভায় বিরোধী দলের কাউকে না রাখতে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন বলে জানা গেছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, সরকারের নীতিনির্ধারকদের মতে, জাতীয় পার্টিকে সরকারে রাখলে কয়েকটি মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হবে। দলটিকে সংসদে বিরোধী আসনে রেখেও একই মর্যাদা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে একঢিলে দুই পাখি মারা সম্ভব। সংসদীয় কাঠামোতে বেশ কয়েকটি পদ বিরোধীদের জন্য আছে, যেগুলো সরকারের মন্ত্রী পদমর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। জাতীয় পার্টিকে তা দেওয়া হলে দলটিকে দিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা বেশ জোরালোভাবেই পালন করানো যাবে। সরকারের শীর্ষপর্যায়ের এই চিন্তার সঙ্গে সহমত রয়েছে দলটির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতাদেরও।

সূত্রটি আরো জানিয়েছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার সরকার বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে নিয়ে ওই ধরনের ভূমিকা পালন করানোর একটা চিন্তা করেছিল। তবে নানা কারণে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তবে এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলের মর্যাদা পাওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম আসন নেই আওয়ামী লীগ বাদে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের। এরপরও বিরোধী দল হিসেবে সরকার আস্থা রাখছে এরশাদের জাপার ওপর।

আমাদের সংবিধানে ও সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধিতে বিরোধী দল হওয়ার জন্য কত আসন প্রয়োজন, সে ধরনের কোনো কথা লেখা নেই। এ ধরনের বিধান না থাকলেও বিরোধী দলের মর্যাদা পেতে জাতীয় সংসদের স্পিকারের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে ভারতের লোকসভায় বিরোধী দল থেকে ১০ শতাংশ আসন প্রয়োজন হয়। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, তার দলের নির্বাচিত সদস্যরা সরকারের মন্ত্রিসভায় না থেকে বিরোধী দলে থাকবেন।

এদিকে, জাতীয় পার্টির নির্বাচিত এমপিদের মধ্যে রওশন ও এরশাদপন্থি বেশ কয়েকজন রয়েছেন। সংখ্যায় তারা বেশি না হলেও বিভাজনটি বেশ স্পষ্ট। রওশনপন্থি বলে পরিচিতরা মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়ার মজা পাওয়ায় এবারও তারা সেদিকেই যাওয়ার পক্ষে। এ নিয়ে এ দুই পন্থিদের মধ্যে স্পষ্টতই টানাপড়েন রয়েছে। এরশাদপন্থিরা চাইছে, বিরোধী দলে থেকে সরকারকে চাপে রেখে মহাজোটের শরিক হিসেবে তাদের সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেওয়া, যাতে আগামী পাঁচ বছর পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের দল কোনো ধরনের সংকটে না পড়ে। ফলে মন্ত্রী ও বিরোধী দলে থাকা নিয়ে দলটির মধ্যে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব এখনো বিরাজমান। ফলে এরশাদ তার কর্তৃত্ব ধরে রাখতে ও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বৃহস্পতিবার শপথ নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। এ ছাড়া দলটির টানাপড়েনের কারণে বিরোধীদলীয় নেতাও নির্বাচন করতে পারেনি দলটির সংসদীয় দলের সভায়। খবর সরকার ও জাপার নির্ভরযোগ্য সদস্যদের সূত্রের।

ক্ষমতাসীন দলের একজন সিনিয়র সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা চাই, জাতীয় পার্টি এবার পুরোপুরি বিরোধী দলে থাকুক। সেখানে থেকে তারা সরকারের ক্ষমতাকে উপভোগ করুক। সরকার ও বিরোধী দলে একই দলের সদস্য থাকলে না করা যায় সমালোচনা না নেওয়া যায় সুবিধা। তবে, এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষ লাভবান হয়; ক্ষতিগ্রস্ত হয় দল।

বিরোধী দলে কারা থাকবেন, জানতে চাইলে অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান ও দশম সংসদের প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজ বলেন, জাতীয় পার্টির সদস্যরা দশম জাতীয় সংসদের বিরোধী দলে ছিলেন। আবার দলটির অনেক সংসদ সদস্য সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। এ নিয়ে সরকারের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি ছিল। পরে বঙ্গবন্ধুতনয়া ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে এক সভায় এ নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়, সেখানে সিনিয়র একজন সদস্য তার মতামত তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, জাপার সদস্যদের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে সংসদের বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার করলে ভালো হতো। একই সঙ্গে দলটির বিরোধীদলীয় নেতা ও প্রধান হুইপের পদটিও রয়েছে। পাশাপাশি একজন হুইপও করা যায়। এতে বিরোধী দলের তিনজন সদস্য মন্ত্রী পদমর্যাদার হয়ে যান। মন্ত্রিসভার সদস্যদের মতো তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেন। ওই প্রস্তাব ও মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে নেত্রী বলেছিলেন, এতে পরে কেন তোমরা এ যুক্তি উপস্থাপন করেছো; আরো আগে বললে বিষয়টি সুষ্ঠু সমাধান করা যেত। এভাবেই পাঁচ বছর পেরিয়ে যায়। কিন্তু গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনেও বিরোধী দল হওয়ার মতো এককভাবে কোনো দল আসন না পেলেও সংবিধান ও সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধি ও রেওয়াজ অনুযায়ী বিরোধী দল করার যে বিধান রয়েছে, এবারও তাই অনুসরণ করা হবে, যোগ করেন বঙ্গবন্ধুর সময় থেকে টানা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া এই অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান আ স ম ফিরোজ।

জাপা ও সরকারের সূত্র মতে, জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত কোনো সংসদ সদস্যকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই না দিতে একাট্টা দলটির চেয়ারম্যান এরশাদ। কারণ দলটির সদস্যরা মন্ত্রিসভায় থাকায় এবার দলটির ভরাডুবি হয়েছে। বিরোধী দলে এককভাবে জাপা থাকলে সরকারের সমালোচনার মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে বলে মনে করছেন এরশাদ ঘরানার সদস্যরা। তবে রওশানপন্থিরা চাইছে বিরোধী দলের সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি মন্ত্রীর পদটিও। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ লিখিত চিঠি দিয়ে বিষয়টি সরকারকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, মন্ত্রিসভায় তার দলের কেউ থাকবেন না।

সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাপা বিরোধী দলে থাকলেও তাদের মধ্যে অনেক সিনিয়র সদস্য এবার নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। তাদের মধ্য থেকে কাউকে ডেপুটি স্পিকার করার চিন্তা রয়েছে সরকারে। কারণ সরকার ও সংসদের ভারসাম্য রক্ষা করাই সরকারের চ্যালেঞ্জ। কারণ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। ভোটে ভরাডুবি হয়েছে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের। এ দল ও জোট সর্বসাকুল্যে আসন পেয়েছে সাতটি। সেদিক থেকে জাপা ভঙ্গুর ও দুর্বল দল বলা হলেও তাদের আসন সংখ্যা ২২।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জাতীয় পার্টি,ভারসাম্য রক্ষা,বিরোধী দল
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close