গাজী শাহনেওয়াজ

  ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯

বিএনপির সংসদে ফেরা

একাদশ জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হয় প্রায় এক বছর আগে। এ নির্বাচনে বিএনপির ভূমিধস পরাজয় ছিল ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর আলোচিত ঘটনা। সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি সেখানে যোগদান করবে কিনা সে বিষয়ে সাধারণের মধ্যে ছিল প্রবল আগ্রহ। শুরুতে বিএনপিবিহীন সংসদের দুইটি অধিবেশন বলা যায় প্রায় নিষ্প্রাণ ছিল। তৃতীয় অধিবেশনের শেষদিকে বিএনপি সংসদে ফেরায় প্রাণফিরে আসে চিরচেনা সংসদ অধিবেশনের। এটি বলা যায় বিদায়ী বছরে সংসদে আলোচিত ঘটনা।

বিরোধী জাতীয় পার্টি সংসদে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেনি। এই সংসদে নয়; বিদায়ী দশম সংসদেও তাদের ভূমিকা ছিল একই রকমের। বিএনপি না ফিরলে এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের কয়েকজন সংসদ সদস্যের জাতীয় ইস্যুতে সমালোচনায় মুখর না হলে বলা যায় সংসদ অনেকটা নিষ্প্রভ থাকত।

সেদিক থেকে সংখ্যায় কম হলেও বিএনপির সদস্যের উপস্থিতিতে সংসদ জাতীয় বিষয়ে বিতর্ক অনেকটাই আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। তাদের তির্যক বাক্যবাণে নাজেহাল হতে হয়েছে সরকারি দলকে। যদিও সিংহভাগ আসন দখল করে রাখা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এমপিদের হই হুল্লোড় আর চিৎকার চেঁচামেচিতে বেশিক্ষণ বাণ নিক্ষেপ করা সম্ভব হয়নি বিএনপি এমপিদের।

এছাড়া বিদায়ী বছরে টেলিযোগাযোগ খাত নিয়ে বছরজুড়েই সরব ছিল সংসদ অধিবেশন। বিল পাসের ক্ষেত্রে অন্য যেকোনো বছরের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিল এবার পাস হয়েছে। নারী এমপিদের আসন দখল এবং আলোচনায় অংশগ্রহণে গত বছরে রেকর্ড গড়ে জাতীয় সংসদ। ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি নারী এমপি সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে এই সংসদে এসে দলের পাশাপাশি নারীদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তবে বছর শেষে ঘটে যাওয়া বুবলিকান্ডে নারী এমপিদের ইমেজ অবশ্য কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।

টানা পাঁচ বছর বাইরে থাকার পর সংসদের সব ক’টি অধিবেশনে যোগ দিয়ে রেকর্ডও গড়েছে বিএনপি। ঘুচিয়েছে সংসদ বর্জনের অপবাদও। স্বল্প সংখ্যক এমপি হয়েও বিভিন্ন ইস্যুতে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ করে এবং সরকারের নানা সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় বারের সরকারের প্রথম বাজেট অধিবশনে অংশগ্রহণ করে বাজেটের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে বিএনপি। বাজেট অধিবেশনের প্রথম দিন মঙ্গলবারই সংসদে যোগ দেয় বিএনপি। এদিন সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার বক্তব্যে অনেক দিন পর সংসদে উত্তাপ ছড়িয়েছিল। এরপর বিএনপির এমপি হারুনুর রশীদ খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রসঙ্গ আনেন।

এদিকে সবচেয়ে আশার কথা হলো গেল বছরে দলটি নানা বিষয়ে সরকারি দলের এমপিদের সঙ্গে বাক্যবাণে জড়ালেও কোনো ওয়াক আউট করেনি। এর আগে ২০১৩ সালের ৭ জুন বাজেট ঘোষণার দিন সংসদে ছিলেন বিএনপির সংসদ সদস্যরা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি। যে কারণে ওই সংসদে দলটির কোনো প্রতিনিধি ছিল না। এবার মাত্র ৬ জন এমপি সংসদে রয়েছেন।

দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো অংশ না নেওয়ায় জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের মর্যাদা পায়। এবার বিএনপি নির্বাচনে এলেও হাতেগোনা কয়েকজন দলটি থেকে এমপি নির্বাচিত হওয়ায় প্রধান বিরোধী দলের আসনটি এবারও জাতীয় পার্টিই পায়। গত সংসদে জাতীয় পার্টি সরকারেও ছিল আবার বিরোধী দলেও ছিল। এবার অবশ্য তারা সরকারে নেই। অনেকেই মনে করেছিলেন এ দলের একাধিক এমপি গত সরকারের মন্ত্রিসভায় থাকায় বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। পার্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিজেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত ছিলেন। সব মিলিয়ে জাতীয় পার্টি সরকারের বিশ্বাসযোগ্য বিরোধী দলে পরিণত হয়েছিল। এবার হয়তো তা হবে না। কিন্তু এবারও খোলস পাল্টায়নি জাপার।

সংসদ অধিবেশনে সরগরম ছিল গ্রামীণ ও রবি দুই অপারেটরের কাছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) পাওনা নিয়ে। বছরের প্রথম অধিবেশন থেকে শেষ অধিবেশন পর্যন্ত এই ইস্যুটি নিয়ে কথা হয় সংসদে। ইস্যুটির প্রভাব এতটাই নেতিবাচক আকার ধারণ করে যে, পরিস্থিতি সামলাতে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর রবি চাকরিচ্যুতির মতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।

বিটিআরসি গ্রামীণফোনের কাছে পাওনা ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা আর রবির কাছে ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা পরিশোধের তাগাদা দিয়ে আসছিল। বিষয়টি মধ্যস্থতায় নামেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। পরে এটি সংসদে মূল আলোচনায় চলে আসে।

একাদশ সংসদের প্রথম বছরটি আরো দুই ঘটনার জন্য আলোচিত। এবার নির্বাচিত এমপিদের মধ্যে বিএনপি যখন শপথ নেবে কি নেবে না এই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন তখন ইচ্ছা থাকলেও সংসদে আসা হয়নি সরকার দলীয় এমপি সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের। তিনি শপথ না নিয়েই না ফেরার দেশে চলে যান। আবার শপথ নিয়েও সংসদে কথা বলা হয়নি বিরোধী দলীয় নেতা এইচ এম এরশাদের। দশম সংসদে নিজের ভুলে বিরোধী দলের নেতা হতে পারেননি এরশাদ। তাই এবার চেয়েছিলেন সংসদে মূল বিরোধী দল হিসেবে কঠোর ভূমিকা পালন করবেন। তার সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল।

একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় ৩০ জানুয়ারি। বিদায়ী বছরে মোট ৫টি অধিবেশন হয়। তার মধ্যে প্রথম অধিবেশনের কার্য দিবস ছিল ২৬ দিন। এছাড়া দ্বিতীয় অধিবেশনের কার্য দিবস ৫ দিন, তৃতীয় অধিবেশন ছিল ২১ দিন, চতুর্থ অধিবেশন ৪ দিন এবং সব শেষ ৫ম অধিবেশনের মেয়াদ ছিল মাত্র ৫ দিন। এক বছরের মোট ৬১ কার্য দিবস।

বিদায়ী বছরে সংসদে আরেকটি আলোচিত বিষয় ছিল প্রথমবারের মতো সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী নিজেই সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেন। যা আগে কখনো ঘটেনি। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অসুস্থ থাকায় একাদশ সংসদের প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেন সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সারা দেশে দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযানে যখন রাজনীতির মাঠ টালমাটাল তখন সংসদেও এর আঁচ লাগে। কয়েকজন সংসদ সদস্যের ব্যাংক হিসাব জব্দের মধ্য দিয়ে কালিমা লাগতে থাকে একাদশ সংসদের গায়ে। কালিমার শেষটুকু লাগান আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত সংসদ সদস্য তামান্না নুসরাত বুবলি। বিএস পাস দেখাতে গিয়ে প্রক্সি পরীক্ষার্থী হয়ে পরীক্ষা দেয়ায় সমালোচনার তির নিক্ষেপ হয় সংসদের দিকে। চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশের জাসদ একাংশের কার্যকরী সভাপতি মঈনুদ্দিন খান বাদল। তার অকাল প্রয়াণে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি।

গত এক বছর নানা ঘটনার সাক্ষী হয়ে রয়েছে সংসদ। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদই প্রথম জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অস্তিত্বের সঙ্কট, উপর্যুপরি দুর্যোগের ভয়াবহ আঘাত, জীব-বৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি এবং সম্পদের অমিতাচারী ব্যবহারের প্রেক্ষাপটে আনীত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার সাধারণ প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এটি একেবারেই এই সংসদের জন্য বিরল ঘটনা।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বিএনপি,সংসদ,বিরোধী দল,ফিরে দেখা ২০১৯
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close