প্রতীক ইজাজ

  ১৯ এপ্রিল, ২০১৮

বেপরোয়া বাসচালক : সাহস জোগায় কে

*১ বছরেও চূড়ান্ত হয়নি সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া *৫ বছরে ঢাকা শহরে রুট বেড়েছে ১৪৪টি, রাস্তা বাড়েনি

কারা আগে কে যাত্রী নেবে ৩ বাসের প্রতিযোগিতা। ছবিটি কারওয়ান বাজার তোলা

রাজধানীতে দুই বাসের চাপায় হাত হারানো কলেজছাত্র রাজীবের মর্মন্তুদ মৃত্যু ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে দেশের মানুষকে। কেবল দুই বাস চালকের বেপরোয়া বাস চালনার কারণে একটি তরতাজা যুবকের এমন অসহায় মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না কেউ। নিহতের পরিবারের কান্না ক্ষুব্ধ করে তুলেছে মানুষকে।

রাজীবকে হারানোর ক্ষত মুছতে না মুছতেই গতকাল অনুরূপ আরেকটি ঘটনা ঘটেছে গোপালগঞ্জ সদরে। সদরের বেতগ্রাম বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বাসের পেছন দিক থেকে আসা একটি ট্রাক দ্রুত গতিতে বেপরোয়াভাবে হঠাৎ করেই বাসের পেছন অংশ ঘেঁষে চলে যায়। এতে ওই বাসে জানালার মাঝখানের রড ধরে থাকা হাত মুহূর্তেই শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হাতটি বাসের জানালায় ঝুলে থাকার কিছু পর সড়কে পড়ে যায়। অস্ত্রোপচার শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শয্যায় ছেলেটি এখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।

চালকদের বেপরোয়ার কারণে দেশে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির মতো এমন মর্মন্তুদ ঘটনা প্রতিদিন লেগেই রয়েছে। সড়ক পথে কিছুই মানছেন না এসব চালকরা। নির্ধারিত স্টপেজে বাস না থামিয়ে হঠাৎ করেই পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে পড়ছে মাঝ সড়কে। রাস্তার মাঝখানেই নামিয়ে দিচ্ছেন ও তুলছেন যাত্রীদের। অন্য বাসকে সামনে যেতে না দেওয়ায় বাসের পেছনের অংশ বাঁকা করে রাখছেন সড়কের ওপর। ঝুঁকিপূর্ণভাবে ওভারটেক করছে এক বাস অন্য বাসকে। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি হচ্ছে। ভীতসন্ত্রস্ত যাত্রীদের করুণ আকুতি কানে তুলছেন না চালকরা। জেব্রা ক্রসিং বা ট্রাফিক সিগন্যাল তো মানছেনই না; উল্টো স্পিড ব্রেকারের ওপর দিয়ে দ্রুত গতিতে

চালাতে গিয়ে ত্রাহি অবস্থা করে তুলছেন যাত্রীদের। প্রচণ্ড গরমে যাত্রীর অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে থাকছেন রাস্তার ওপর। ইচ্ছেমতো গতিতে বাস চালাচ্ছেন। ভাড়া আদায় করছেন ইচ্ছেমতো। এমনকি এসবের প্রতিবাদ করলে হেনস্থা করা হচ্ছে যাত্রীদের।

শুধু রাস্তাঘাটেই নয়; সর্বক্ষেত্রেই বেপরোয়া এসব বাস-ট্রাক চালক, হেলপারসহ সর্বস্তরের বাস শ্রমিকরা। মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির পরও এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতেও হিমশিম খেতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। মনঃপুত না হওয়ায় এসব শ্রমিক নেতাদের চাপের মুখে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে খসড়া অবস্থায় পড়ে রয়েছে সড়ক পরিবহন আইন।

এমনকি আদালতের আদেশ পর্যন্ত অবজ্ঞা করার স্পর্ধা দেখিয়েছেন এসব পরিবহন শ্রমিকরা। কোনো ধরনের আগাম ঘোষণা ছাড়াই গত বছরের মার্চে পরিবহন ধর্মঘট ডেকে অচল করে দেয় দেশ। ঢাকা ও মানিকগঞ্জের পৃথক আদালতের রায়ে এক চালকের মৃত্যুদন্ড ও আরেক চালকের যাবজ্জীবন সাজায় ক্ষুব্ধ হয়ে এই কর্মবিরতি করে শ্রমিকরা। দেশের মানুষের চরম দুর্ভোগ সত্ত্বেও তখন ওই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান ক্ষমতাসীন সরকার সমর্থিত শ্রমিক নেতারাও। পরে অবশ্য সাজার বিষয়টি দেখার প্রতিশ্রুতি দিলে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নেন শ্রমিকরা।

বাস চালকসহ পরিবহন শ্রমিকদের এমন বেপরোয়া যান চলাচল ও আচরণের বিষয়টি এখন দেশজুড়েই সমালোচিত। কিন্তু কেন? এর পেছনে কারণ কি? কেন কোনো কিছুই মানছে না এসব শ্রমিকরা? এদের পেছনে কারা রয়েছেন? কেন কিছুতেই তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না? এমনতর নানা প্রশ্ন এখন সর্বত্র। তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে গোটা পরিবহন খাত।

এ নিয়ে গতকাল কথা হয় দেশের পরিবহন বিশেষজ্ঞ, বিশ্লেষক, যাত্রী অধিকার নিয়ে কর্মরত সংগঠন নেতা এবং যাত্রীদের সঙ্গে। তাদের মতে, পরিবহন খাতে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাপটে সড়কপথের যাত্রীদের অসহায়ত্ব এখন চরমে পৌঁছেছে। এর জন্য তারা সরকার সমর্থিত শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক নেতাদের প্রশ্রয়কে দায়ী করেন। তারা এমনও বলেন, পরিবহন চালকরা এমন বেপরোয়া আচরণের সাহস পাচ্ছেন রাজনীতির কারণে। মালিক ও শ্রমিক নেতাদের ক্ষমতার প্রভাবে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি চালকদের অদক্ষতা, শর্তানুযায়ী ন্যূনতম শিক্ষাও না থাকা, সচেতনতার অভাব, মাদকসহ নানা অপরাধে ডুবে থাকাসহ বিশৃঙ্খল জীবন এমন বেপরোয়া আচরণের কারণ বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, সরকার চাইলে এসব শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। পরিবহন খাত সৃশৃঙ্খল করতে পারে। কিন্তু শ্রমিক রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগ করা গেলে অনেকাংশেই শৃঙ্খলা ফিরে আসত। চালকরা এমন বেপরোয়া হতে সাহস পেত না।

তবে পরিবহন বিশেষজ্ঞদের এমন অভিযোগ মানতে নারাজ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি ও সরকারের নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি বলেন, পরিবহন খাত আগের চেয়ে অনেক বেশি শৃঙ্খলায় এসেছে। চালকসহ সব ধরনের শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে রাস্তার স্বল্পতা এবং জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে কিছু দূর্ঘটনা ঘটছে। কোনো বাস চালকই ইচ্ছে করেন দুর্ঘটনা ঘটান না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলেই দুর্ঘটনা হয়।

এই শ্রমিক নেতা এমনও বলেন, পরিবহন খাতে একটি গতি এসেছে। সুশৃঙ্খল হয়েছে। এখানে রাজনীতি কোনো সমস্যা নয়। শ্রমিকরাও যদি অন্যায় করে শাস্তি পাচ্ছে। তাদের জন্য আইন আছে। প্রয়োগ হচ্ছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ শামসুল হক বলেন, ঢাকার রাস্তায় এখন চরম বিশৃঙ্খলা চলছে। পরিবহন চালকদের কিছুই মানতে বাধ্য করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে গণপরিবহন চালকরা ভীষণ বেপরোয়া আচরণ করছে। এর কারণ হচ্ছে পরিবহন খাতে ক্ষমতাসীন রাজনীতির প্রভাব বাড়ছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন সেই সরকার সমর্থিত মালিক ও শ্রমিক নেতাদের দাপট বাড়ে। ফলে কখনোই এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। চালকদের আচরণও সংশোধন হয় না। যাত্রীদের ঝুঁকি থেকেই যায়।

বিশেষজ্ঞরা রুট দখলে পরিবহন মালিকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতাকেও পরিবহন খাতে এমন বিশৃঙ্খলার পেছনের আরেকটি কারণ বলে মনে করছেন। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অপর গবেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, ২০১৩ সালে ঢাকা শহরে রাস্তার সংখ্যা বিবেচনায় ১৫৬টি রুট নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেখানে এখন প্রায় ৩০০ রুটে বাস চলাচল করছে। অথচ রাস্তা তেমন বাড়েনি। দক্ষ চালকও বাড়েনি। বরং এসব রুটে বাস চালাতে গিয়ে চালকরা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কোন বাস মালিক এখন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পথে নামছে না। নামছে রাজনৈতিক প্রভাবে। যখন যারা সরকারের থাকছে, তখন তাদের লোকজন রুটের অনুমতি পায়। ফলে এদের নিয়ন্ত্রণাধীন শ্রমিকদেরও কিছু বলা যাচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বাস চালকদের এমন বেপরোয়া চালনার আরো কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে, একই রুটে বিভিন্ন কোম্পানির বা মালিকের বাস চলাচল করায় গণপরিবহনগুলোর মধ্যে যাত্রী টানার এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। এটাও দুর্ঘটনার বড় কারণ। এছাড়া চালকের সহকারী হিসেবে কিছু দিন কাজ করার পরই চালক বনে যাচ্ছেন অনেক শ্রমিক। তাদের কোনো প্রশিক্ষণ ও গাড়ি চালনার বিধি-বিধান জানতে নেই কোনো পড়াশোনা। অথচ ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছেন অনায়াসে। যেহেতু দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালক বা সহকারীদের আইনের আওতায় আনা কঠিন, তাই তাদের মধ্যে আইন মানার প্রবণতাও ক্ষীণ। বিশেষ করে এ-সংক্রান্ত আইন এখনো বাস্তবায়ন করতে না পারাটাও পরিবহন শ্রমিকদের এমন বেপরোয়া হয়ে ওঠার পেছনে অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, গত বছর মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া খসড়া আইনে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ও নিহতের ঘটনা ঘটলে দন্ডবিধির আওতায় বিচার হবে। দন্ডবিধিতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। হেলপারের লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাছাড়া প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালালে এবং সে ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা না হলেও চালকের ২ বছরের জেল বা ২ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। আর গতিসীমা লঙ্ঘন করলেও একই শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও আইনটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি পরিবহন নেতাদের চাপের কারণে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা।

এমনকি মানা হচ্ছে না বিদ্যমান মোটর ভ্যাহিকল অ্যাক্ট ১৯৮৩ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, অ্যাক্ট অনুযায়ী, ২১ বছর বয়সী পেশাদার চালককে প্রথমে হালকা যান চালনার জন্য লাইসেন্স দেওয়া হয়। এর তিন বছর পর মাঝারি যান এবং এরও তিন বছর পর মেলে ভারী যান চালনার লাইসেন্স। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ব্র্যাকের এক গবেষণার তথ্যানুযায়ী, ভারী যানবাহনের ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ চালকই ‘ওস্তাদে’র (মূল চালকের) সহকারী থেকে চালক হয়েছেন। এরা গাড়ি চালনার কোনো নিয়ম জানেন না।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রাজীবের মৃত্যু,দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি,সড়ক দুর্ঘটনা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist