অলোক আচার্য

  ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

রাঘববোয়াল-চুনোপুঁটি ও আমজনতা

আমাদের দেশে প্রবাদ-প্রবচনের অভাব নেই। এই যেমন ইদানীংকালে রাঘববোয়াল, রুইকাতলা, চুনোপুঁটি এসব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। রাঘববোয়াল বলতে সাধারণত বিশালাকৃতির বোয়াল মাছকে বোঝানো হয়। তবে প্রবাদে এর অর্থ ভিন্ন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহৃত হয়। সেক্ষেত্রে রাঘববোয়ল বলতে সেসব দুর্নীতিবাজকে বোঝানো হয়, যারা একই সঙ্গে অবৈধ উপায়ে প্রচুর টাকার মালিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছেন। তাদের দেখা সচরাচর মেলে না। দামি গাড়িতে চলাফেরা করেন। তাদের হুকুমে জি হুজুর করার মানুষের অভাব নেই। এরাই হলো রাঘববোয়াল।

দুর্নীতির ক্ষেত্রে এ রাঘববোয়ালদের মুখোশ খুলে ফেলার কথা প্রায়ই আমরা শুনে থাকি। এর বিপরীতে রয়েছে চুনোপুঁটি নামের একটি বাগধারা। এই শ্রেণিও নেতিবাচক অর্থে দুর্নীতিবাজ। তবে তারা স্তরভেদে নিচুস্তরে থেকে কর্মসম্পাদন করেন। তাদের সঙ্গে রাঘববোয়ালদের একটা সম্পর্ক থাকে। এসব চুনোপুঁটি আমরা প্রায়শই দেখি। তারাও সমাজে কালো টাকার জোরে প্রভাব বিস্তার করে। আর অপরটি আমজনতা। এরা ওপরের দুই তরিকার দুর্নীতিবাজদের শোষণের স্বীকার। তাদের খবরদারিতে আমজনতা অতিষ্ঠ।

ওরাই সমাজের হর্তাকর্তা। এদের হাত এত শক্ত যে এরা প্রায়ই জাল ছিঁড়ে বের হয়ে যায়। তবে ধরা পড়লে আমরা অর্থাৎ আমজনতা শান্তি পাই। এসব বড় বড় রুই কাতলাদের ক্ষুধা এত বেশি যে, অবৈধ পথে আয় করতে গিয়ে দেশটার ১২টা বাজিয়ে দেন। আর এত ক্ষমতার মালিক হতে তারা রাজনীতিকে ব্যবহার করেন। এসব দুর্নীতিবাজ রাঘববোয়াল-চুনোপুঁটি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার সামনে আজ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দুর্নীতি আসলে কী বা দুর্নীতির ফলে কী হয়? একটি রাষ্ট্র যখন উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখে; তখন এই দুর্নীতি সেই লাগাম টেনে ধরে। এগোতে গিয়েও বারবার পিছিয়ে পড়তে হয়। আমাদের দেশে মাঝে মাঝে এ রকম বহুবিধ কর্মকাণ্ডের কথা শোনা যাচ্ছে। যেমন রূপপুরের বালিশ কাণ্ড বা হালের পর্দাকাণ্ড। তারপর আবার প্রকাশিত হলো ধানবীজ বাবদ তিন কোটি টাকা দুর্নীতির খবর। প্রতিনিয়তই এমন খবর থলে থেকে বেরিয়ে আসছে। এসব বিড়াল থলের মধ্যে এমনভাবে ছিল যে, তাদের প্রকাশ্যে আনাই কষ্টসাধ্য। অবশ্য থলের বিড়াল তো এক দিন না এক দিন বের হয়ে আসবেই।

দায়িত্ব গোল্লায় যাক! আরো কত কান্ড অপ্রকাশিত রয়েছে তার হিসাব নেই। যারা এভাবে দুর্নীতি করে দেশের ১২টা বাজাচ্ছেন; তাদের চেহারা আমরা দেখতে পাচ্ছি। দেশের মানুষের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ টাকা কোথায় যাচ্ছে? এসব দুর্নীতিবাজ মানুষের মতোই দেখতে! অথচ কর্মকান্ড মানুষের মতো না! এসব দুর্নীতিবাজের অপরাধ খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। দুর্নীতি আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন। দেশটা যখন উন্নতির দিকে ধাবমান; তখন এসব দুর্নীতিবাজ মানুষের জন্য উন্নয়নের সুফল দেশের প্রান্তিক মানুষ পর্যন্ত পৌঁছায় না। ফলে উন্নয়নের সুফল তারা কমই ভোগ করতে পারছেন। তাদের প্রাপ্য সুবিধা নিয়ে ওপর মহলের কতিপয় দুর্নীতিপ্রবণ মানুষ আরাম-আয়েশে বিলাসবহুলভাবে জীবন কাটাচ্ছে। দুর্নীতির ঘুণপোকা দেশের উন্নয়নকে কেটে শেষ করে ফেলছে। পকেট মোটা করতে পারাতেই দুর্নীতিবাজদের আনন্দ। তা সে যেকোনো উপায়েই হোক না কেন। সবাই কাজের বিনিময়ে উপরি পাওনার খোঁজ করেন। এভাবে অধিকাংশই যদি দুর্নীতিপ্রবণ আচরণ করেন; তবে সাধারণ মানুষের কী হবে? দুর্নীতি মানুষ কেন করে—এমন প্রশ্নের সোজা কোনো উত্তর নেই। কারণ বেতন আগের চেয়ে বেশি হলেও তেমন কোনো উপকার হয়নি। কারণ অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের প্রবণতা কমেনি। সরকারের বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ টাকা যেকোনোভাবে নিজের পকেটে ঢোকাতে ব্যস্ত সবাই।

প্রতিটি সেক্টরে উপরি পাওনার সিস্টেম আছে। যে নিতে জানে সে যেকোনো পরিস্থিতিতেই ঘুষ নেয়। কোনো কোনো সেক্টরের উপরি পাওনা নেওয়ার সুযোগ একটু বেশি। সেসব সেক্টরে চাকরির জন্য চাপ থাকে বেশি। এই চাকরি পাওয়াটাও আমাদের দেশে বিশাল একটা ব্যাপার। মানে এখানেও সেই দুর্নীতির বিষয়। চাকরি পাওয়াটাই যেখানে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়ে নেওয়া হয়, সেখানে কতটুকু ভালো আশা করা যুক্তিযুক্ত। যার উপরি পাওনার সামর্থ আছে; সে উপরি দিয়ে নিজের পাওনা আদায় করে নেয়। টাকার জোরে কত যোগ্যতমকে টপকিয়ে তার থেকে কম যোগ্যতার মানুষ চাকরি পাচ্ছেন; তার হিসাব কে রাখছেন। যার সামর্থ্য নেই, বেকার থাকে। এ যেন অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমাদের দুর্নীতির মধ্য দিয়ে অনেক তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীও বাড়ি-গাড়ির মালিক। মাঝে মধ্যেই পত্রিকায় এসব খবর প্রকাশিত হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত না হলে আমরা সেসব জানতে পারতাম না। কোটি টাকা, বাড়ি, গাড়ির মালিক হওয়ার স্বপ্ন থাকতে পারে। তবে সেই স্বপ্নটা অবৈধ উপায়ে পূরণ করার ইচ্ছাটাই নষ্টের মূলে। সত্যি কথা বলতে উপরি পাওনা পেতে পেতে এমন অভ্যাস (বদঅভ্যাস) তৈরি হয় যে, সেটাই বৈধ মনে হয়। উপরি পাওনা না পেলেই খারাপ লাগে। বর্তমান সরকার প্রথম থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে বারবার কঠোর অবস্থান ঘোষণা করেছেন। ঘুষ দেওয়া ও নেওয়ার বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ওই যে একটা প্রবাদ আছে, ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি’। অবস্থা অনেকটা সে রকম।

দুর্নীতির শিকার হয় প্রান্তিক মানুষগুলো। এই মানুষগুলো ঘামে ভেজানো টাকায় উন্নয়নের ধারা প্রবাহিত হয়। আর দুর্নীতিবাজদের কারণে সেই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। তাই এ রকম দু-একটি ঘটনা নয়, ধীরে ধীরে সব পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। দুর্নীতির কারণে কেউ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয় আবার কেউ শুকিয়ে মরে। সমাজে বিভাজন তৈরি হয়। ধনী-গরিবের ভেদাভেদ তৈরি হয়। রাতারাতি বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়ে সমাজের হর্তাকর্তা হয়ে ওঠেন অনেকে। দুর্নীতিবাজদের ধরতে দুদকের অভিযানে সাধারণ মানুষ শান্তি পাচ্ছে। তবে তা আরো জোরদার হতে হবে। কোনোভাবেই দুর্নীতিবাজদের ছাড় দেওয়া চলবে না।

নতুন পে-স্কেলের আওতায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এটা করেছেন। এটার একটা উদ্দেশ্য ছিল সরকারি কাজে যাতে দুর্নীতি না হয়। প্রয়োজন যদি মিটে যায়; তাহলে কেন অসততার আশ্রয় নেওয়া। আবার যদি সেই অর্থনীতির কথায় বলি তাহলে প্রয়োজনের কী আর শেষ আছে! তাই যত বেতনই বাড়ানো হোক না কেন ’উপরি পাওনা’ ছাড়ে কী করে। ঢেঁকি যে স্বর্গে গেলেও ধানই ভাঙে! যত সুখেই থাক, আরো চাই। রাজার ভাণ্ডার উজাড় করে দিলেও তারা দুর্নীতি বন্ধ করবে না। দেশের যা হয় হোক, নিজের পকেট ভর্তি হোক। দেশের ব্যাংকে টাকা রাখার জায়গা না থাকলে বিদেশে যাও। সেখানে বাড়ি-গাড়ি তৈরি করো।

আমরা নিজেরা নিজেদের লোভের জায়গা থেকে সরে না এলে দুর্নীতি কোনোকালেই একেবারে শেষ হবে বলে মনে হয় না। দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীই যথেষ্ট। মনে রাখা জরুরি যে, বড় কোনো অপরাধের জন্মও ছোট অপরাধ থেকেই হয়। ঘুষ নেওয়া কোনো কর্মকর্তার পরিবারের কোনো সন্তান বড় কোনো চাকরি পেলেও সে ঘুষ নেওয়াই স্বাভাবিক। কারণ সে এই শিক্ষা তার পরিবারের কাছ থেকেই পেয়েছে। এভাবেই দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে পরিবার থেকে সমাজে, সমাজ থেকে রাষ্ট্রে।

প্রতি ক্ষেত্রেই এই উপরি ইনকামের প্রশ্ন। সে সেবা হোক বা বাণিজ্য হোক। যদি সেবা হয়, তো সেখানে দালাল বাহিনী প্রস্তুত। আপনার কাজ যত কঠিনই হোক না কেন, এই দালালদের কাছে তা হাতের ময়লা। শুধু আপনি পকেট থেকে কিছু বের করলেই হলো! দুর্নীতিবাজরা এভাবে অবৈধ আয় করে দেশটাকে পিছিয়ে দিচ্ছে তা একবারও ভেবে দেখছে না। তারা আছে ব্যাংক ব্যালান্স মোটা করার স্বপ্নে বিভোর। একে একে কত কান্ড প্রকাশিত হচ্ছে! সামনে আবার কোনো লঙ্কাকান্ড অপেক্ষা করছে, দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকল আমজনতা। তবে তাদের আকাঙ্ক্ষা অন্যত্র। দুর্নীতির অবসান হোক—এটাই প্রত্যাশা।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
দুর্নীতি,রাঘববোয়াল,কলাম
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close