বদরুল আলম মজুমদার

  ০২ জুলাই, ২০১৯

শিশুদের ডিজিটাল আসক্তি : ব্যাহত হচ্ছে লেখাপড়া

মোবাইল ফোনসহ আধুনিক প্রযুক্তির প্রতি শিশুদের আসক্তি দিন দিন বাড়ছে। অনেক অভিভাবক ইচ্ছা করেই আধুনিকতার নামে সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন আপডেট ডিজিটাল প্রযুক্তি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রতি অতি আকর্ষণ শিশু-কিশোরদের জন্য আত্মঘাতী হচ্ছে— তা অনেকেই ভেবে দেখছেন না। অথচ গবেষকরা বলছেন, শৈশবে প্রযুক্তির অধিক ব্যবহার মানুষের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে ব্যাঘাত ঘটতে পারে শিশুদের লেখাপড়া ও সুস্থ মানসিক বিকাশে।

সম্প্রতি ‘দ্য অ্যামেরিকান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স ও ক্যানাডিয়ান সোসাইটি অব পেডিয়াট্রিক্সের বিজ্ঞানীরা কোন বয়সের শিশুকে কতটুকু প্রযুক্তির সংস্পর্শে নেওয়া উচিত, সে সম্পর্কে পরিষ্কার একটি ধারণা দিয়েছেন। তারা বলেছেন, দুই বছরের আগে শিশুদের সব গ্যাজেট থেকে দূরে রাখাই উচিত। ওই বয়সে ইন্টারনেট, আইপ্যাড বা টেলিভিশনে অভ্যস্ত হলে শিশু স্বভাবে অস্থির হয়, অনেক ক্ষেত্রে কানে কম শোনে।

বিজ্ঞানীদের মতে, দুই বছরের পর অল্প অল্প করে শুরু করলেও তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সিদের কখনো দিনে এক ঘণ্টার বেশি মোবাইল, টেলিভিশন, আইপ্যাড, ল্যাপটপ, টেলিভিশন ইত্যাদির সংস্পর্শে থাকা ঠিক নয়। ছয় থেকে ১৮ বছর বয়সিরা দিনে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা সেই জিনিসগুলোর কাছাকাছি গেলে ক্ষতি এড়াতে পারবে। এসবে অভ্যস্ত হলে অনেক শিশু অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যায়। এর নানা রকমের ক্ষতিকর প্রভাব জীবনের ওপরও পড়ে। ডায়াবেটিস কিংবা হৃদরোগেরও ঝুঁকি বেড়ে যায় শিশুদের।

গবেষণায় আরো বলা হয়, গ্যাজেট ব্যবহার করার কারণে শিশুরা খুব তাড়াতাড়ি যৌনতা, সন্ত্রাস ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা পায়। ফলে অনেক শিশু খুব আগ্রাসী স্বভাবের হয়। কিছু শিশু বড় হয়ে নানা কিছুতে জড়িয়েও যায় ভালো-মন্দ না বুঝে। এতে তাদের মানসিক বিকাশ ও লেখাপড়ার বারোটা বাজতে বসেছে।

এর বাইরে এসব গ্যাজেট বেশি ব্যবহার করার ফলে খুব কম বয়সেই অনেকে মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করে। তাতে এক সময় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকিও থাকে। এক জরিফে দেখা যায়, কানাডায় এ সমস্যা বেশ প্রকট হতে শুরু করেছে। সেখানে ছয়জন শিশুর মধ্যে অন্তত একজনকে বেশি গ্যাজেট ব্যবহার করার ফলে মানসিক স্বাভাবিকতা ফিরে পেতে নিয়মিত ওষুধ খেতে হচ্ছে।

গবেষকরা বলছেন, মোবাইল উপকরণ আসার আগে বাচ্চারা লেখাপড়ায় তড়িৎ উন্নতি করতে পারতো। কিস্তু ইদানিং বেশ কয়েক বছর থেকে স্মার্ট মোবাইল ফোন, ট্যাব বা এ জাতীয় অন্য ডিভাইসে অভ্যস্ত হওয়া শিশুর লেখাপড়ায় উন্নতি খুব ধীরগতিতে হয়। দেখা গেছে, সে রকম শিশুদের এক-তৃৃতীয়াংশই শিক্ষাজীবনে খুব সমস্যায় পড়ে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, শতকরা ৬০ ভাগ শিশুর বাবা-মাই আজকাল কম বয়সি সন্তানের হাতে মোবাইল বা অন্য গ্যাজেট তুলে দেন। শতকরা ৭৫ ভাগ শিশুর বাবা-মা তারপর আর খবরই নেন না তাদের সন্তান রাতে কখন ঘুমায়। বাবা-মায়ের অজান্তেই অনিদ্রাজনিত অসুখ ডেকে আনে সন্তান।

আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এসব গ্যাজেট থেকে সন্তানদের দূরেও রাখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি ভারতে গ্যাজেট আসক্তি ঠেকাতে বাবা-মা স্মার্টফোন দিতে অস্বীকার করায় ৯ বছর বয়সি এক শিশু ছুরি দিয়ে নিজেই নিজের শরীরে আঘাত করেছে।

ফর্টিস ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ কাউন্সিলের চেয়ারপারসন ও কনসালট্যান্ট ড. সামির পারিজের মতে, বর্তমানে শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের অ্যাপ তৈরি হচ্ছে। ফলে শিশুরা সহজেই বিভিন্ন ডিভাইস পরিচালনায় পারঙ্গম হয়ে উঠছে। তার মতে, শিশুদের ডিভাইস ব্যবহার করতে দেওয়ার মাধ্যমে ব্যস্ত রাখার একটি ক্রমবর্ধমান প্রবণতা আজকাল বাবা-মায়েদের মধ্যে বেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাবা-মায়েদের বিভিন্ন অডিও-ভিজুয়াল সাহায্য করছে তাদের সন্তানদের সঠিকভাবে পরিচালনা করতে। কিন্তু এই সাময়িক স্বস্তি তাদের দীর্ঘমেয়াদে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

বহির্বিশ্বের মতো আমাদের দেশে শিশুদের হাতে এসব গ্যাজেট তুলে দিচ্ছে মা-বাবা। সন্তানকে একটু শান্ত বা ব্যস্ত রাখতে অনেক বাবা-মাই আজকাল এমনটা করে থাকেন। শিশুদের এক-দুই বছর বয়স থেকেই গড়ে ওঠা এসব অভ্যাস পরবর্তী সময়ে লাগাম টেনে ধরা যায় না। দিন যত যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগসহ অনেক মাধ্যমে তারা এতটাই আসক্ত হয়ে পড়ে যে, ব্ল্যাকহোলের মতো মরণব্যাধি খেলায়ও পিছু হটছে না অনেক কিশোর। রাত জেগে অনলাইনে পড়ে থেকে স্বাভাবিক ঘুমের ব্যাঘাত কারণে অধিকাংশ বাবা মা-ই আজ সন্তানদের নিয়ে বেশ বেকায় আছেন।

শিশুদের গেজেট আসক্তি নিয়ে কথা হয় উত্তরা মাইলস্টোন কলেজের অধ্যক্ষ সহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, শিশুর ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির সময়টুকুতে এই শহুরে জীবনযাত্রা এবং প্রযুক্তির আগ্রাসন একটি প্রাণঘাতী ভূমিকা পালন করছে। প্রযুক্তির যে সুবিধার কথা বলা হচ্ছে তা কেবল প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়েদের বেলায় কিছুটা উপকারভোগী হলেও, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিকৃত যৌনদৃশ্য দেখে সাধারণ জীবনে তারাও অনেকটা বেশামাল হয়ে পড়ে।

তিনি আরো বলেন, একটি স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে যে আনন্দ পাওয়া যায় তার চেয়ে বরং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক বেশি। বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের ব্যস্ত রাখার জন্য তাদের হাতে ফোন তুলে দিচ্ছেন। বরং এর পরিবর্তে তাদের উচিত সন্তানদের দক্ষতা বৃদ্ধির কর্মসূচিতে অংশ নিতে উৎসাহিত করা। এক্ষেত্রে নিবিড়ভাবে সন্তানের সমস্যাগুলো জানা, তার জন্য একটি ইতিবাচক পরিবেশ নিশ্চিত করা, মোবাইল ব্যবহারের সময় নির্ধারণ করে দেওয়া এবং গঠনমূলক শখকে উৎসাহিত করা। এসবই তাদের এই আসক্তি থেকে দূরে রাখার ভালো উপায় বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন মোবাইলফোন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা উচিত। পরিবারের সদস্যদের বন্ডিংয়ের জন্য সময় বের করতে হবে। বাবা-মা হিসেবে যে ভূমিকা পালন করার কথা তা সঠিকভাবে পালন করতে হবে। তার মতে, গ্যাজেট আসক্তি নিয়ন্ত্রণ করার এখনই উপযুক্ত সময়।

সম্প্রতি জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিসেফ একটি জরিপে জানায়, বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন ১ লাখ ৭৫ হাজার শিশু নতুন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। এর অর্থ প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন শিশু প্রথমবারের মতো ইন্টারনেট জগতে প্রবেশ করছে। সংস্থাটি বলছে, প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক শিশু যেমন প্রথমবারের মতো ইন্টারনেট জগতে আসছে, একই সঙ্গে ইন্টারনেট ব্যবহার তাদের জন্য নানাবিধ ঝুঁকি তৈরি করছে।

ইউনিসেফ মনে করে অনলাইনের ক্ষতিকারক বিষয়বস্তুর হাত থেকে শিশুদের রক্ষা করা দায়িত্ব সবার ওপরই বর্তায়। এক্ষেত্রে সরকার, পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়া প্রযুক্তি শিল্পের ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রয়েছে। শিশুরা নিজেদের নিরাপদ রেখে কীভাবে অনলাইন ব্যবহার করতে পারে সেটি শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ডিজিটাল আসক্তি,শিশুদের মোবাইল,মোবাইল আসক্তি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close