সৈয়দা ইয়াসমিন আরা, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক

  ২৪ জুলাই, ২০১৯

প্রবাসী বাচ্চাদের ভাষা বিভ্রাট

আমেরিকায় যে সব বাঙালি বাচ্চারা জন্মগ্রহণ করে, তাদের ভাষা বিভ্রাট নিয়ে প্রায়শই নানা সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। বাসার ভেতর মা-বাবা বাংলা ও ইংরেজির সংমিশ্রণে বাংলিশ ভাষায় কথা বলছে আর বাইরে স্কুল থেকে শুরু করে সবখানেই ইংরেজি ভাষা। বেশির ভাগ বাচ্চাদের অভিভাবক বাসায় অবসর সময়ে হিন্দি গান, হিন্দি সিরিয়াল ও মুভিতে বুঁদ হয়ে থাকে। অভিভাবকদের সাথে বাচ্চারাও সেটা সমান তালে উপভোগ করে। তো বাচ্চারা এখন বাংলা, তখন ইংরেজি নয়তো হিন্দি, এই তিন ভাষার মারপ্যাঁচে পড়ে সঠিকভাবে কোনও ভাষাই প্রথম দিকে রপ্ত করতে পারে না। তবে বাচ্চাদের ইংরেজি ভাষা শেখাতে অভিভাবকদের জোরালো ভূমিকার কারণে সেটা মোটামুটি রপ্ত করে ফেলে। তারপর স্কুলে পদার্পণ করে পুরোপুরি ভাবেই ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠে। অবশ্য আমেরিকার মাটিতে জন্মগ্রহণ করে এরা জন্মের পর থেকেই আমেরিকার নাগরিক। এদের দেশ হয়ে উঠে আমেরিকা। তাই ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হওয়া তাদের খুব জরুরি। কিন্তু পিতামাতার সূত্রে এরা বাঙালি। তাই মাতৃভাষা বাংলা ভাষার আক্ষরিক জ্ঞান অর্জন করতে না পারলেও ভাষাগত জ্ঞান থাকা অতি আবশ্যক। হোক তারা আমেরিকার নাগরিক কিন্তু তাদের আসল পরিচয় তো এরা বাঙালি।

বাঙালি মা-বাবা ও অভিভাবকদের বদৌলতে এই বাচ্চারা ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলা ও হিন্দিতে কমবেশি পারদর্শী হয়ে উঠে। তাদের ব্যক্তিগত প্রয়াসে পরিস্থিতি বুঝে তারাও তাদের প্রতিভা বিকাশের কোনও ত্রুটি করে না। এতেই ঘটে প্রবাসী বাঙালি বাচ্চাদের ভাষা বিভ্রাট। যেমন এখানে ছোট্ট দুটি ঘটনা উল্লেখ করছি।

প্রবাসে আপনজন বর্জিত জীবনে আশেপাশে যারা থাকেন তারাই হয়ে উঠেন আত্মার আত্মীয়, পরম আপনজন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কারো না কারো বাসায় একত্রিত হয়ে খাওয়া-দাওয়া, আড্ডায় যান্ত্রিক জীবনের একঘেঁয়েমি থেকে কিছুটা সময় মুক্তি। এমনি এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বান্ধবী তাপসীর বাসায় জম্পেস আড্ডা বসেছে। ছেলেরা লিভিং রুমে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতি, খেলাধুলা, অর্থনৈতিক ব্যাপার নিয়ে তুমুল গবেষণা, তর্কবিতর্কের ঝড়। আর মেয়েরা অন্যরুমে গুচি, প্রাডা, লুইসভিটন, জারা, সাফোরা, সোনাচান্দি প্রভৃতি নিয়ে ফ্রী বিজ্ঞাপনে ব্যস্ত। সেই সাথে অবশ্যই তাদের নিজ নিজ বাচ্চারা কে কত প্রতিভাবান সেই সুখ্যাতি বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। ঠিক সেই মুহূর্তে টিয়া আপুর ছোট্ট ছেলেটি তিড়িং বিড়িং করে দৌড়ে এসে মাকে নালিশ। আম্মু আম্মু টুশি আমাকে মাঙ্কি বলেছে। টিয়া আপুর ছেলের পিছনে পিছনে ততক্ষণে টুশি হাজির। সে যখন দেখলো তার নামে মিথ্যাচার করা হচ্ছে, সাথে সাথে সে এর তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলো। টুসি বললো, 'আন্টি আন্টি রনি মিথ্যা বলছে,আমি মাঙ্কি বলিনি, আমি বলছি মাগ্যি মাগিইইইই।' টিয়া আপু টুসির মার দিকে তাকিয়ে মানে টা কি বোঝার চেষ্টা। আর টুশির মা লজ্জায় চেরি ফল। উনি উঠে ঠাস করে মেয়ের গালে এক চড়, আর সাথে সেই বিখ্যাত ডায়লগ, 'ছিঃ ছিঃ এই সব তুমি কোথায় শিখলে?' টুশিতো চড় খেয়ে ভেউ ভেউ কান্না, সেই সাথে গোমর ফাঁস করে দিল। সে বললো, 'তুমিতো ম্যাড হইলে মাগি মাগি বলো। রনি আমাকে দাক্কা(ধাক্কা) দিসে, আমি ম্যাড হইসি, তাই আমি ওকে মাগি বলসি।' টুশির আম্মু এরপর চেরিফল থেকে নেতানো লতা হওয়া ছাড়া উপায় বা কি বেচারির। মেয়ে তার সত্যবাদি যুধিষ্টর এর বংশধর এর পরিচয় বহন করছে। যাই হোক আপায়- ভাবীতে তেমন মানসিক ক্লেশ না থাকার দরুণ সবাই মিলে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে।

তখন এই গল্প সেই গল্প প্রসঙ্গে আরেক ভাষার বিভ্রাট এর ঘটনা শুনালেন ইলা আপু। একদিন ইলা আপুর বাসায় উনার চাচাতো ভাই এসেছেন। দরজায় কলিং বেল বাজাতেই, ইলা আপুর মেয়ে দরজা খুলেই জিজ্ঞেসা, 'মামা মামা তুমি বাল কাটসো?' মামাতো চোখ বড় বড় করে ভিমড়ি খাওয়া অবস্থা। ইলা আপুও মেয়ের পিছনেই দাঁড়িয়েছেন ততক্ষণে। উনিও উনার ভাইয়ের মুখের সাদা রং লাল হতেই বুঝে ফেলেছেন বিষয়টি। এই মুহূর্তে উনার মেয়ের হিন্দি ভাষার প্রতিভা ছড়াচ্ছে। তাই তাড়াতাড়ি ভাইকে আস্বস্ত করলেন উনার মেয়ে বলছে, 'আপনি চুল কেটেছেনতো (কারন উনার ছিল কাঁধ অবদি বাবরিচুল)'। হঠাৎ মামার এই ছোট চুল দেখে এমন প্রশ্ন। আমরা স্বীকার করি আর নাই করি, এখানে দোষটা মূলত অভিভাবকদের। বাচ্চারা আমাদের থেকে যা পাবে, তাই শিখবে। আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে তারা যাই পাচ্ছে, সেটাই বুঝে না বুঝে গ্রহণ করছে। এবং পরবর্তীতে সেটার প্রয়োগ করছে। আমরা যদি তাদের সঠিকভাবে ভাষা শিক্ষা দিতে না পারি, তাহলে এমন ভাষা বিভ্রাট খুব স্বাভাবিক। সত্যি বলতে তাদের ভাষাতো ইংরেজি। ঘর থেকে বাইরের জগতে যখন থেকে তাদের পদার্পণ, তখন থেকেই তারা এই ভাষায় অভ্যস্ত।

এখানকার এক জাতি আছে গায়ানিজ। এরা কথা বলে ইংরেজিতে, আর কথার টানে থাকে পুরাই ইন্ডিয়া আর আফ্রিকার সংমিশ্রণ। বড়ই অদ্ভুত শোনায় সেই কথা বলার ধরন। উইকেন্ড এ সারাদিন তারা নিজ বাসায় পুরা পাড়া কাঁপিয়ে হিন্দি গান বাজায়, অর্থ বুঝুক আর না বুঝুক। আবার হিন্দি কিছু গানকে ইংরেজিতে রূপান্তর করে ট্যাব্বু ট্যুব্বু হিন্দি আফ্রিকান সুরে গান শুনে। তো যাইহোক, আমাদের এই প্রজন্মের বাচ্চারাও হয়তো সুদূর ভবিষ্যতে এই গায়ানিজ জাতির মতোই কোন এক জাতিতে রূপান্তরিত হবে। আপাতত দৃষ্টিতে এটাই বুঝা যাচ্ছে। তখন হয়তো আমাদের বাঙালি জাতি আমেরিকার বুকে গায়ানিজদের মতো বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজির সংমিশ্রণে 'বাংহিলিজ' হিসেবে পরিচিতি পাবে। এই বিষয়টি আমাদের অভিভাবকরা যত দ্রুত উপলব্ধি করতে পারবে, হয়তো ধারণাকৃত পরিস্থিতির হতে উত্তরণ সম্ভব।

আমাদের নতুন প্রজন্মের বাঙালি বাচ্চাদের কাছে আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা অতি আবশ্যক। প্রবাসে আমাদের ব্যস্ত জীবনেও বাচ্চাদের প্রতি বিশেষ ভাবে নজর দিতে হবে। খুব বেশি কিছু করতেও না পারি, অন্তত তাদের সামনে অশ্লীল শব্দের ব্যবহার বন্ধ করার পাশাপাশি নিজ গৃহে হিন্দি চর্চা বাদ দিতে হবে। বর্তমানে ইউটিউবে বিভিন্ন ধরণের মজার মজার শিশুতোষ বাংলা এনিমেটেড ভিডিও পাওয়া যায়। যেখানে খুব সুন্দর ও আকর্ষণীয় ভাবে বাংলা বর্ণ শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। তাছাড়াও খুব আকর্ষণীয় ভাবে মজার মজার বাংলা ছড়া, ছড়া গান ও লোকগাথার মজার সব গল্প পাওয়া যায়। ইউটিউবে পাওয়া এসব শিশুতোষ এনিমেটেড ভিডিও গুলো আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি, আমাদের বাচ্চারা ইংরেজি ভাষার কার্টুন দেখা ছেড়ে এসবে বুঁদ হয়ে থাকবে। এতে করে যেমন সুন্দর করে বাংলা ভাষা শিখবে, তেমনি বাংলার প্রতি তাদের ছোট্ট মনে ভালোবাসার সঞ্চার হবে। আমাদের নতুন প্রজন্মকে ষোলো আনা বাঙালি বানানো আমাদেরই দায়িত্ব ও কর্তব্য।

পিডিএসও/রি.মা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্রবাসী বাচ্চা,ভাষা বিভ্রাট
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close