খালিদ হাসান, শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক(জবি)

  ২৫ জুলাই, ২০১৮

‘আজকেই আমাদের জীবনের শেষ দিন’

২৩ জুলাই ২০১৫, আগের দিন থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি। টানা বর্ষণ। ঈদের তৃতীয় দিন। প্রজেক্টের কাজে যেতে হবে নোয়াখালির দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া। রাতের বাসে উঠে পরলাম মানিকনগর থেকে। নয় জনের টিম আমাদের। পুরো বাসে আমরা নয় জন। ভোরে গিয়ে নামলাম নোয়াখালি। সেখান থেকে পূর্বের নির্ধারিত কটেজে। সারা দিন বৃষ্টি মাথায় কাজ করলাম সূবর্ণচরের কয়েকটি ইউনিয়নে। রাতে জানতে পারলাম তিন জনের এডভান্স টিম হাতিয়ায় যাবো। আমি, বন্ধু আরিফ আর পারভেজ।সাথে থাকবে হাতিয়ার স্থানীয় বড় ভাই মামুন।

২৫ জুলাই সকালে নাস্তা করে ভারী বর্ষণ মাথায় নিয়েই সিএনজি করে চলে এলাম চেয়ারম্যান বাড়ি ঘাটে। এসে শুনি হাতিয়াগামী সিট্রাক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্যার কে ফোন দিয়ে জানালাম এ কথা। স্যার বললেন, রোদ উঠে গেলে ট্রলারে করে চলে যেয়ো। নদীতে সাত নাম্বার সংকেত চলছে। মন টানছিলো না।এমন বর্ষণ আগে দেখিনি। দেখতে দেখতে দুপুরে রোদ দেখা গেলো। ট্রলার চলবে। চেয়ারম্যান বাড়ি ঘাট থেকে হাতিয়াতে ট্রলারে লাগে প্রায় তিন ঘন্টা। ভাড়া জন প্রতি ১৫০ টাকা।স্থানীয় মামুন ভাই বলল সমস্যা হবে না, চল রওনা হই, আমি দশ নাম্বার সংকেতে নদী পার হয়েছি। প্রচন্ড অনিচ্ছ্বা সত্ত্বেও উঠে পড়লাম ট্রলারে। নারী ,পুরুষ শিশু মিলিয়ে পঞ্চাশ ষাটের মতো যাত্রী। ট্রলারের আকার মাঝারী। দুপুর ২টায় ট্রলার ছাড়ল। রোদ উঠলেও আকাশ ছিল গুমোটে। আমি আর পারভেজ গিয়ে বসলাম ট্রলারের পেছনের ইঞ্জিনের উপর। তীর ঘেসেই ট্রলার চলছিল। ভয় লাগছিল আবার ভালোও লাগছিল। আরিফ আর পারভেজ নদী অঞ্চলের। ওরা স্বাভাবিক ছিল। প্রায় এভাবে আধা ঘন্টা চলার পর তীর ছেড়ে মাঝ নদীতে ঢুকে পড়ল ট্রলার। জানিয়ে রাখা ভাল, এটা মেঘনার মোহনা। এই মোহনা মিশেছে বঙ্গোপসাগরে।

আমরা ছবি তুলছিলাম, গান গাচ্ছিলাম। হঠাৎ আকাশে মেঘ। ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছিলো চারপাশ। গুমোট পরিবেশ। আমাদের ট্রলার গভীর নদীতে।এক পসলা বৃষ্টি হয়ে গেলো। আমরা বাইরে যারা বসেছিলাম তারা ভিজে একাকার। ভিতরে ঘরের মতো জায়গাটায় নারী ও শিশুরা। ট্রলার চলছিল। হঠাৎ আবার সেই অন্ধকার।সেই সাথে বাতাস। মাঝারি ঢেউ। মামুন ভাই বুঝতে পেরেছে আমরা ভয় পাচ্ছি। তিনি আমাদের সাহস দিতে লাগলেন। কোনও সাহসের কথায় কাজ হচ্ছে না।বাতাসের জোর বাড়তে লাগল। সাথে ঢেউয়ের আকারও বড় হতে লাগল। এক পর্যায়ে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। চারপাশ অন্ধকার। কাছের লোকদেরও দেখা যাচ্ছে না ঠিকমতো। এক পৃথিবীর ভয় আমাদের মাঝে। খুব অসহায় মনে হলো। এক পর্যায়ে ঝড় শুরু হলো। প্রচন্ড বাতাসে আর ছাতা ধরে রাখা সম্ভব হলো না। উড়ে গেলো। ইঞ্জিনের উপরে বসে থাকা সম্ভব হলো না। নিচে নেমে এলাম। ঝড়ের প্রকোপ বাড়তে লাগল। অশান্ত মেঘনা। একেকটা ঢেউয়ের আকার হবে আনুমানিক পনেরো থেকে বিশ ফুট।

একটা সময় মনে হলো ঢেউয়ের আঘাতে আমাদের ছোট্ট ট্রলার একেবারে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। নারী ও শিশুদের গগণ বিদারী চিৎকারে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। অনেকে বমি করা শুরু করে দিয়েছে। শক্ত করে ট্রলারের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি। অসহায় আমরা। সৃষ্টিকর্তাকে ডাকা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। সাহসী মামুন ভাই ও ততক্ষণে বমি করা শুরু করে দিয়েছেন। একজন আরেক জনের দিকে তাকাচ্ছিলাম। বড় ভুল হয়ে গেছে, ধিক্কার দিচ্ছিলাম নিজেকে। আরিফ নদী অঞ্চলের ছেলে হলেও এবার আরিফও স্বীকার করল আমাদের আসা উচিৎ হয়নি। প্রিয় মুখগুলো বার বার চোখে ভাসছিল। একবার ফোন বের করে দেখলাম ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। ধরেই নিয়েছি আজকেই আমাদের জীবনের শেষ দিন। আম্মার সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছিল। নিজেকে বার বার ধিক্কার দিচ্ছিলাম এই বলে আমার লাশটাও পরিবার পাবে না।প্রচণ্ড ঝড় বইছে। ট্রলারে পানি উঠে যাচ্ছে। শ্রমিকরা পানি সেচে ফেলছে। ট্রলারের চালক একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছে আর বড় বড় ঢেউয়ের সাথে খেলা করছে। সামনে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। এক পর্যায়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল ট্রলার ডুবে গেলেই ভাল হবে। মানসিক চাপ আর নিতে পারছিলাম না। মানুষ যে কতটা অসহায় হতে পারে সেদিন বুঝেছিলাম। একটা পর্যায়ে বাঁচার শেষ আশাটুকু ছেড়ে দিয়ে বসে পড়লাম পাটাতনে। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক এভাবে চলার পর নদী কিছুটা শান্ত হলো। তীর দেখা গেলো। তবে একবারে শান্ত হয়নি। তীরে ট্রলার বেড়ানো সম্ভব নয়। মাঝি জানালো এই ঢেউয়ে ল্যান্ডিং করতে গেলে ট্রলার ভেঙ্গে যেতে পারে। তাই স্টেশন থেকে আরো আধা ঘণ্টা পথ পিছনে এসে আরেকটা বড় ট্রলারের সাথে বাধা হলো। আমি ব্যাগ নিয়ে আগেই সেই ট্রলারে উঠে গেছি। আরিফ জানালো আমাদের একটা ব্যাগ পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে আবার উঠলাম ট্রলারে। যাত্রীদের বললাম এই ব্যাগে আমাদের গবেষণার জিনিস ছাড়া আর কিছু নেই। একজন ব্যাগটা বের করে দিল। ততক্ষনে ট্রলার ছেড়ে দিয়েছে। মাঝিকে অনুরোধ করলে বলল সামনের স্ট্যান্ডে নামতে। বুঝলাম তাদের বলে লাভ নেই।ব্যাগ তীরে দাঁড়িয়ে থাকা পারভেজকে ছুঁড়ে দিয়ে নদীতে লাফ দিলাম। সাঁতরে উঠলাম তীরে। এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল যা পরে বুঝেছি। বিপদে পরলে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তীরে গিয়ে জেলেদের মাছ বিক্রয় কেন্দ্রে গিয়ে পোশাক পাল্টালাম।

ততক্ষণে বিকেল সারে ৫টা। আমাদের যেতে হবে হাতিয়ার ওছখালিতে। প্রায় ঘণ্টাখানেক পথ হেঁটে খুঁজে পেলাম একটা বাজার। সেখান থেকে মোটর সাইকেল যোগে ওসখালিতে। গিয়ে উঠলাম ডাক বাংলোতে। বিদ্যুত নেই। ভুতুরে বাংলো। সেদিন হয়তো জাতীয় দৈনিকে খবর হতে পারতো হাতিয়ায় ট্রলার ডুবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীসহ পঞ্চাশ জন নিখোঁজ। সেদিন পেয়েছিলাম দ্বিতীয় জীবন। ট্রলারে আমাদের সাথে ছিল কয়েকটি নিষ্পাপ শিশু। সেই শিশুদের উছিলায় হয়তো সেদিন সৃষ্টিকর্তা বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। সেই দিনটিকে ভুলতে পারি না, ভোলা সম্ভব নয়।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জীবন,শেষ দিন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist