এহ্সান ইসলাম

  ২৮ এপ্রিল, ২০১৮

স্বপনের স্বপ্নরথ থামিয়ে দিল ঘাতকের ছুরি

ঘরের দেয়ালে এখনো ঝুলছে স্বপনের গায়ে হলুদের ককসিটে নকশা প্ল্যাকার্ড। শেষ হয়নি বিয়ের সব কিছুর গোছগাছ। এর মধ্যে ঘরে জুড়ে চলছে শোকের মাতম। কোনো কিছুতেই সান্তনা দেওয়া যাচ্ছে না স্বপনের মা ও দাদীকে। দাওয়ায় বসে আছেন শোকে স্তম্ভিত বাবা। গতকাল স্বপনের বাড়ি গিয়ে দেখা যায় এই মর্মান্তিক দৃশ্য। স্বপনের মৃত্যুর খবরে তার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন বলে জানায় তার পরিবার। বছরখানি হয় বিয়েকে করেছেন তারা। এর মধ্যেই থেমে গেলে স্বপনের স্বপ্ন রথ। শুধু স্বপনকে স্মরণ করে চলছে বন্ধু-স্বজনদের ফেসবুকে একের পর এক শোকঝড়া স্ট্যাটাস ও ছবির শেয়ার। তারা কেউ-ই এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না।

ইতালির বাণিজ্যিক নগরী মিলান শহরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে বাংলাদেশি যুবক শামসুল হক স্বপন (৩১)। গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সময় আনুমানিক রাত পৌনে তিনটা দিকে (বাংলাদেশ সময় শুক্রবার সকাল) মিলান সেন্ট্রাল স্টেশন সংলগ্ন সেত্তেমবিরিনি নামক রাস্তায় ছিনতাইকারীরর কবলে পড়ের এই ঘটনা ঘটে। এ সময় তাদের ছুরিকাঘাতে আহত দুইজন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় মরক্কোর ২ নাগরিককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত শুক্রবার রাতেই স্বপনের কাছাকাছি থাকা একাধিক ব্যক্তি তার পরিবারকে মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন।

পরিবারের হাল ধরায় বাবাকে বিদেশ থেকে দেশে স্থায়ী করেছেন স্বপন। এখনো খানিকটা ঋণের তলে আছে তার পরিবার। তারপরও একপাশ থেকে আগলে রেখে ছোটভাইদের দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। তাছাড়া ইচ্ছে ছিল তার হাত ধরে দাঁড়াবে তার পরিবার। ভাগ্যের অন্বেষণের ল-ন শহর ছেড়ে ইতালির মিলানে কর্মস্থল গড়েছেন।

শমসুল হক স্বপনর (৩১) বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বারুয়াখালী ইউনিয়নের ব্রাহ্মণখালী গ্রামের। আব্দুল সালামের পাঁচ ছেলের মধ্যে স্বপনই সবার বড়। সে পরিবারের হাল ধরনে এই আশায় প্রবাস থেকে পাকাপাকি ভাবে দেশে ফিরেছেন তিনি। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠার আগেই এই দূর্ঘটনায় তিনি স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। ‘ছাতার তো বাবা একটা খুঁটি। সেই খুঁটি ভাইঙ্গ্যা গেলে মাতার ওপর ছাতি ধরুম কেমনে!’ স্বপনের সহপাঠী-বন্ধুদের পেয়ে এভাবেই কাঁদ ছিলেন তিনি। ‘তুমরা আমার সোনার টুকরা ভাইরে আইনা দেও। হারামিরা আমার ভাইয়ের কলিজাডা ফাইরা ফালাইছে। স্বপনের চিহ্নটাও (সন্তান) তো ওরা রাখতে দিলো না।’ বলতে বলতে কাঁদছিলেন স্বপনের দাদি। তার মায়ের শুধু একই কথা, ‘তোমরা আমার সোনারে আইনা দাও, ও আমারে মা বলে ডাকুক। ওর বৌটাকে নিয়ে আমার সামনে দিয়ে হাঁটুক।’

নিহত স্বপনের লাশ রাখা হয়েছে মিলানের নিগোয়ারদা হাসপাতালে। তবে বিভিন্ন জটিলতায় তার লাশ দেশে আনা কঠিন হবে বলে মন্তব্য করে প্রবাসীরা। ইতালি প্রবাসী রাজীব হোসেন সহ একাধিক বাংলাদেশি জানান, ইতালিতে রক্তের সম্পর্ক ছাড়া কাউকে লাশ হস্তান্তর করতে চায় না। নিয়ম অনুযায়ি মিলানের বাঙালি কমিউনিটির মধ্যে আগামী রোববার বসা হবে। তাছাড়া লাশ দেশে পাঠাতে প্রায় ৭-৮ লাখ টাকা খবর হবে। স্বপনের রেস্টুরেন্টের মালিককে ঘটনা জানান হলে তিনি হাসপাতালে যাবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তারপরও অপমৃত্যু হিসেবে লাশ পাঠান কঠিনই হবে।

স্থানীভাবে অত্যন্ত স্বজ্জন, মিশুক, পরোপকারি যুবক হিসেবে স্বপনের প্রশংসা আছে বলে জায়ায় স্থানীয়রা। এজন্য আত্মীয়দের সঙ্গে থাকা পুরনো বিরোধ মিটিয়েছেন। স্থানীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক করেছেন উন্নত। এছাড়া তার মতো স্থানীয় অনেক যুবকই ইতালিতে মাথা গোজার ঠাই করা পেছনে স্বপনের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। বন্ধুদের মধ্যে সদা হাস্যোজ্জ্বল স্বপন বন্ধু প্রাণদের একজন। স্বপনের সহপাঠী ও প্রতিবেশিরা জানা যায়, ২০০৫ সালে এইচএসসি শেষে ঢাকার তেজগাঁও কলেজ পড়ালেখা শুরু করেন স্বপন। পরিবারের নির্ভর যোগ্য আর শিক্ষিত মানুষ বলতে তিনিই। পরিবারের কথা চিন্তা করে ২০০৯ সালে প্রথমে ইংল্যান্ড, পরে ইতালিতে প্রত্যাবর্তন করে রেস্টুরেন্টে কাজ করে আসছিলেন। পাঁচ বছর ধরে ইতালি প্রবাসী স্বপন ২০১৫ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ক্যাফে দান্তে মিলান নামক এক রেস্টুরেন্টেক কাজ করছিলেন বলে তার ফেসবুকে উল্লেখ আছে। সর্বশেষ পিয়াচ্ছা দোমোর করদোসিওর এক রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন বলে ইতালি থেকে পরিচালিত ‘মিলান বাংলাপ্রেসক্লাব’ নামক এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানা যায়।

স্বপনের পরিবার জানায়, পারিবারিক আর্থিক অবস্থার গুছিয়ে উঠতে উঠতে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বিয়ে করেন স্বপন। পরের বছরের শুরুতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্ত্রীকে ঘরে তুলেন। সর্বশেষ একমাসের ছুটি কাটিয়ে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বাড়ি থেকে যান স্বপন। কিন্তু মাত্র পনের দিন আগে তার স্ত্রীর মিস কনসেনপ হয়। এই সময় স্বামীর মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন তা স্ত্রী। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ি তিনি হাসপাতালে ভর্তি আছেন।

স্বপনের কাকা ও স্কুল শিক্ষক হারুন অর রশিদ জানান, পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল স্বপনের মৃত্যুতে তার পরিবার আর্থিক সংকটে পরবে। তাছাড়া এক বছরের কিছু সময়ে স্বামীকে হারিয়ে এক অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হলো তার স্ত্রীর পরিবার।’ স্বপনের মরদেহ দেশে আনা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

এদিকে স্বপনের বন্ধু রুবেল হোসেন জানান, চার-পাঁচ বছর স্বপরিবারে ইতালি প্রবাসী তার মামা শ্বশুর ফজলুর রহমান একইভাবে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। পরে তার বিক্ষত শরীর বাড়ি থেকে দুইশতাধিক মিটার দূরে পাওয়া যায়। ইতালিতে প্রবাসী হত্যার ঘটনায় নবাবগঞ্জ উপজেলার ইতালি প্রবাসী পরিবারগুলো উদ্বিগ্ন বলে অভিমত ব্যাক্ত করেন একাধিক পরিবার।

পিডিএসও/রানা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ঘাতকের ছুরি,স্বপ্নরথ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist