মো. কায়ছার আলী
অধিকারহীন মানবাধিকার
মহামতি বুদ্ধ একদিন তার শিষ্যদের নিয়ে বসে আছেন। এমন সময় এক লোক এসে তার মুখে থুতু ছিটিয়ে দিল। বুদ্ধ থুতু মুছে বললেন, আর কিছু বলবে? লোকটি হতবাক। কারণ, কারো মুখে থুতু দেওয়ার পর আজ পর্যন্ত এ রকম প্রশ্ন কেউ কাউকে করেনি। বুদ্ধের শিষ্যরা রেগে উঠলেন। তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ শিষ্য আনন্দ বলে উঠলেন, এ ধৃষ্টতা সহ্য করা যায় না। এ পাপাচারীকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। বুুদ্ধ বললেন, তোমরা থাম। সে নয়, তোমরাই আমার অবমাননা করছ। এত বছর আমার সঙ্গে থেকেও তোমরা ক্রোধ সংবরণ করতে পারলে না। এ লোকটির কোনো দোষ নেই। সে এখানে নতুন এসেছে। সম্ভবত সে আমার সম্পর্কে এমন কিছু শুনেছে, যা তাকে ক্ষুব্ধ করেছে। নিশ্চয়ই ওর আমাকে কিছু বলার আছে। কারণ, একজন মানুষ যখন কাউকে খুব বেশি ভালোবাসে, বেশি ক্ষুব্ধ হয় বা বেশি ঘৃণা করে এবং সে তখন কিছু বলার আগে কোনো আচরণের আশ্রয় নেয়। বুদ্ধ লোকটিকে নিরাপদে চলে যেতে দিলেন।
এদিকে লোকটি বাড়ি গিয়ে সারা রাত চিন্তা করল। যতই চিন্তা করছিল ততই বিস্মিত হচ্ছিল। কে এই বুদ্ধ? কী করে একজন মানুষ এত শান্ত সৌম্য হতে পারেন, পারেন এত জাদুকরী ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে? সকাল হতে না হতেই সে আশ্রমে ছুটে এলো। লুটিয়ে পড়ল বুদ্ধের পায়ে। এবারও বুদ্ধ জানতে চাইলেন, আর কিছু বলবে? আনন্দকে ডেকে বললেন, দেখ মানুষ কীভাবে তার আবেগ প্রকাশ করে! অব্যক্ত কথা বলতে চায়! থুতু যেমন সে দিয়েছিল কিছু বলার জন্য, পায়ে লুটিয়েছেও কিছু বলার জন্য। লোকটি তখন বলল, প্রভু আমার গতকালের ঘৃণ্য কাজের জন্য আমাকে ক্ষমা করুন। বুদ্ধ বললেন, আমি কিছুই মনে করিনি। কারণ, তুমি তো আমাকে থুতু দাওনি। থুতু দিয়েছ আমার সম্পর্কে তোমার মনের ভ্রান্ত ধারণাকে। তাতে তো আমার কোনো ক্ষতি হয়নি। এটাই বুদ্ধের শিক্ষা। ধ্যানের মধ্য দিয়ে যে পরম শাশ্বতবোধ বা জ্ঞানে তিনি উদ্ভাসিত হয়েছিলেন তা তাকে দিয়েছিল এক অসাধারণ নির্লিপ্ততা। ঈর্ষপরায়ণ চাচাতো ভাই দেবদত্তের বারংবার চালানো হত্যা প্রচেষ্টাও তাকে বিচলিত করেনি। হত্যার জন্য পাঠানো তীরন্দাজ বাহিনী তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে, পাহাড়ের ওপর থেকে গড়িয়ে দেওয়া পাথর তার পদতলে এসে থেমে গেছে, মদপান করিয়ে ছেড়ে দেওয়া হাতি হাঁটু গেড়েছে বুদ্ধের উত্থিত অভয়মুদ্রার সামনে। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এক রাজপরিবারে বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন। শিশুকালে তার নাম ছিল সিদ্ধার্থ। অর্থাৎ যে সিদ্ধি লাভ করেছেন বা যার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। রাজকুমার সিদ্ধার্থ এক রাতে ঘুমন্ত স্ত্রী-পুত্র পরিবারকে নিঃশব্দ বিদায় জানিয়ে প্রাসাদ ত্যাগ করেন। দীর্ঘ ছয় বছর ধ্যান-সাধনার পর এক পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধ বোধি লাভ করেন।
আমরা সৃষ্টির সেরা মানুষ। শ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত। শিক্ষিত, আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর, চিকিৎসা ও অন্যান্য যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবস্থাসহ সকলে মিলেমিশে এ দেশে বসবাস করছি। এজন্য মহান সৃষ্টিকর্তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। বিশ্বের প্রতিটি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান নিজ নিজ দেশ ও জাতিকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যেতে সদা তৎপর। ইতিহাস সাক্ষী দেয় মানবিকতা ও মানবাধিকার প্রথম লিখিতভাবে স্বীকৃতি লাভ করে ৬২২ সালে মদিনায় মদিনা সনদে, ৬২৮ সালে মক্কায় হুদায়বিয়ার সন্ধিতে, ৬৩২ সালে বিদায় হজের ভাষণে। গুহাবাসী থেকে সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সভ্যতার আলোয় আসতে আমাদের দীর্ঘ সময় লেগেছে। সভ্য হলেও কোথাও কোথাও কলঙ্কের কালিমা আজও বিদ্যমান। কেউ কাউকে ক্ষমতার ভাগ দেন না বা দিতে চান না। এর বাস্তব প্রমাণ ঐতিহাসিক ম্যাগনাকার্টা। ১২১৫ সালের ১৫ জুন লন্ডন থেকে ২০ মাইল দূরে টেমস নদীর তীরে এক বৈঠকে ইংল্যান্ডের অজনপ্রিয় রাজা জন আর বিরোধী ব্যারনদের মধ্যে একটি চুক্তির ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল মানবাধিকারের মহাসনদ ম্যাগনাকার্টা। সেই ধারণাগুলো বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল এবং অসংখ্য সংবিধানের মূল ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। ম্যাগনাকার্টার মাধ্যমেই যথাযথ প্রক্রিয়ার নীতি এবং আইনের অধীনে সমঅধিকারের রীতির জন্ম নিয়েছিল ব্রিটেনে। এ ম্যাগনাকার্টার মধ্য দিয়েই সংসদীয় গণতন্ত্রের পাশাপাশি আইনের ধারণার যাত্রা শুরু হয়। ঐতিহাসিক এ সনদেই বিশ্ব ইতিহাসের সর্বপ্রথম ঘোষণা করা হয়—কোনো দেশের রাজাসহ সে দেশের সবাই রাষ্ট্রীয় আইনের অধীন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন।
ঐতিহাসিকভাবে ম্যাগনাকার্টা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, একে বর্তমান সাংবিধানিক সূচনাও বলা যেতে পারে। এর শর্তগুলোর মধ্যে হচ্ছে—রাজা স্থানীয় প্রতিনিধি লোকদের অনুমোদন ছাড়া কারো স্বাধীনতায় বা সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। এ চুক্তির সুবাতাস শুধু ইংল্যান্ডেই নয়, অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষমতালিপ্সু রাজা সহজেই এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে চাননি। কিন্তু সব সামন্ত মিলে রাজা জনকে লন্ডনের কাছে এক দ্বীপে বন্দি করে এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন। এ চুক্তি বিচার বিভাগকে অনেকটা নিরপেক্ষ করেছিল। ইংল্যান্ডের সংবিধান বলতে নির্দিষ্ট কোনো দলিল নেই। এ দলিলটি সেদেশের অন্যতম সাংবিধানিক দলিল। প্রজাদের অধিকার ও রাজার ক্ষমতা হ্রাসের যৌক্তিক এ দলিল পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশে মানবাধিকার ও জনগণের ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছে। গত বছরের ১৫ জুন ঐতিহাসিক ম্যাগনাকার্টার ৮০০ বছর পূর্তি পালিত হয় টেমস নদীর ওই স্থানে; যেখানে রাজা জন বাধ্য হয়ে স্বাক্ষর করেছিলেন।
১৬২৮ সালে পিটিশন অব রাইটস, ১৬৮৮ সালে বিল অব রাইটস, ১৭৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকান বিল অব রাইটস, ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব সংগঠিত হয়। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা মানুষের মৌলিক চাহিদা বা অধিকার। সহজ কথায় মৌলিক অধিকারকেই মানবাধিকারের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। আজ ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। নীতি, নৈতিকতা, মূলবোধ, শান্তির বাণীগুলো চর্চা হতে হতে সার্বজনীনতা ও বিশ্বজনীনতা আজকে লাভ করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্টের (হিরোশিমা ও নাগাসাকি) ভয়াবহতা বিশ্ববাসী জানে। সে সময় বিভীষিকা ও ধ্বংসলীলা বিশ্ববিবেককে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের স্ত্রী এলিনর রুজভেল্ট বিষয়টি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় এক আবেগময় বক্তৃতায় মানবতার পক্ষে বক্তব্য উত্থাপন করেন। ৪৮টি রাষ্ট্র তখন একটি কমিশন গঠনের পক্ষে মতামত বা ভোট দেন এবং অবশিষ্ট আট রাষ্ট্র ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকলেও বিপক্ষে কোনো মন্তব্য প্রদান করেনি। জাতিসংঘ সনদই হচ্ছে প্রথম আন্তর্জাতিক দলিল বা মানবাধিকার সমুন্নত রাখার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মানবাধিকার সংক্রান্ত সার্বজনীন ঘোষণা গৃহীত হয়। বিষয়টি স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে ১৯৫০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ৪২৩/৫ নম্বর সিদ্ধান্তে ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকারের সচেতনতা বৃদ্ধি ও চর্চার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে যথাযথ মর্যাদায় পালনের জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
পূর্বের কথায় এবার ফিরে আসি। বুদ্ধের মতে, অহিংসা পরম ধর্ম। জীব হত্যা মহাপাপ। তবে কেন বুদ্ধের অনুসারী দেশ মিয়ানমার এ পৈশাচিক আচরণ করবে! রোহিঙ্গারা কি জীব নয়? জীবন্ত সাধারণ নারী, পুরুষ ও শিশু হত্যা করা কি অহিংস নীতি? সর্বশেষ গত ২৫ আগস্ট কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের মুহূর্তে কেনইবা রোঙ্গিরা বা অন্য কেউ একযোগে পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ করল? সেই আক্রমণের ওপর ভিত্তি করে তদন্ত ছাড়াই অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে যেভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডলীতে নিরপরাধ শিশু ও রোহিঙ্গাদের নিক্ষেপ করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই কোনো সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। রোহিঙ্গারা বহিরাগত নয়, অভিবাসী নয়, জন্মসূত্রে ওই দেশেরই নাগরিক। রোহিঙ্গাদের একমাত্র দোষ তারা মুসলমান। এ পর্যন্ত সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা নাফ নদী অতিক্রম করে বাংলাদেশে এসেছে। গত ৫ ডিসেম্বর ২০১৬ নৌকাডুবিতে তওহিদ নামের এক বছর বয়সী শিশুটি মায়ের দুধের পরিবর্তে নাফ নদীর দূষিত পানি খেতে খেতে চিরতরে না ফেরার দেশে চলে গেছে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব উথান্টের দেশ, শান্তিতে নোবেলজয়ী গণতন্ত্রকামী বেসামরিক সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলর সূূ চির মিয়ানমারে এবারের মানবাধিকার দিবস কি পালিত হবে! হলে তা কোনো সুরে বাজবে, তা আমাদের জানা নেই।
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট [email protected]
পিডিএসও/হেলাল