ফয়জুন্নেসা মণি

  ১৪ মে, ২০১৭

মা দিবস

মাতৃত্ব এক অনন্য গবেষণাগার

মায়ের কাছে সন্তান অত্যন্ত প্রিয়। সে সন্তান যেমনই হোক। ছেলে কিংবা মেয়ে, বোবা-কানা যাই হোক-সব সন্তানই তার মায়ের কাছে শ্রেষ্ঠ সম্পদ; মানিক-রতন। আবার মা শব্দটিও আমাদের কাছে প্রিয়। মায়ের হাসি সন্তানের কাছে সেরা উপহার। মা সন্তানের কাছে তেমন কিছুই চায় না। সন্তানের মঙ্গলই মায়ের একমাত্র চাওয়া। মা শুধু সন্তানের সুখ-শান্তি আর হাসিমাখা মুখ দেখতে চায়।

মায়ের প্রতি সন্তানের আস্থা ও নির্ভরতা বিষয়ে একটা ছোট গল্প—

একটি ভাঙা সেতু পার হচ্ছে মা আর তার ছোট ছেলে। মা বলছে, আমার হাতটি ধর বাবা। ছেলে বলছে, না মা তুমিই আমার হাত ধরে রাখ। অবাক হয়ে মা বলছে, কেন? তুমি আমার হাত ধরলে অসুবিধা কী? মৃদু হেসে ছেলে বলছে, আমি যদি তোমার হাত ধরি, কোনো সমস্যায় পড়লে হয়তো আমি তা ছেড়ে দেব। কিন্তু মা, তুমি যদি আমার হাত ধর-আমি জানি, যত বড় সমস্যাই হোক ওই হাত তুমি ছাড়বে না !! এই হলেন মা।

ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিং বলেছিলেন, ‘মাতৃত্বেই সব মায়া-মমতা ও ভালোবাসার শুরু এবং শেষ।’ সন্তানের প্রিয় খাবার, প্রিয় বই, প্রিয় রঙ, প্রিয় পোশাক-সন্তানের জীবনের ছোটখাটো বিষয়গুলো, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বহীন বিষয়গুলোও মায়ের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবুও আমরা কেন যেন মায়ের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়ি! আমরা ভুলে যাই, প্রতিটি সন্তানের দায়িত্ব মায়ের প্রতি আন্তরিক হওয়া। মায়ের মন, চাওয়া-পাওয়া, ইচ্ছা-স্বপ্ন এবং প্রিয়-অপ্রিয় বিষয়গুলোর প্রতিও সন্তানদের যতœবান হওয়া দরকার।

সন্তানের জন্য মা হলো দুনিয়ার জান্নাত। যারা দুনিয়াতে মা পেয়েছে, তারা যেন দুনিয়াতেই জান্নাত পেয়েছে। সেই মায়ের জন্য একটি দিবস নয়-মায়ের জন্য হবে প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ। মা আমাদের প্রাণের আকুতি। সন্তানের জীবনে আবেগে, অনুভূতিতে, অস্তিত্বে সর্বত্র মায়ের ভূমিকা বিরাজমান। মা দিবসটি যদিও পশ্চিমাদের প্রবর্তন করা, তবুও সম্ভবত মায়ের জন্য সন্তানের অকৃত্রিম ভালোবাসায় বাঙালিরাই সেরা। বাঙালিরাই একমাত্র জাতি, যারা রক্ত ও জীবন বিসর্জন দিয়ে মায়ের মুখের ভাষার অধিকার অর্জন করেছে।

বিজ্ঞান বলছে একজন মানুষ ৪৫ ইউনিট ব্যথা একবারে সহ্য করতে পারে। তার বেশি ব্যথা সহ্য করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু একজন মা সন্তান প্রসবকালে ৫৭ ইউনিটের বেশি ব্যথা সহ্য করেন!! এই ব্যথার যন্ত্রণা ১০টি হাড় একসঙ্গে ভেঙে যাওয়ার ব্যথার চেয়েও বেশি যন্ত্রণাদায়ক!! একবার ভাবুন মায়েরা কত কষ্ট করে তার সন্তান জন্ম দিয়েছেন। একজন মা ৫-১০ জন সন্তান জন্ম দিতে পারেন। অথচ আমরা সেই ৫-১০ সন্তান মিলে একজন মায়ের দায়িত্ব নিতে পারি না! জীবনের শেষ সায়াহ্নে এসে অনেক মা সন্তানদের অনাদর অবহেলার শিকার হন। এর চেয়ে কষ্ট আর লজ্জার কী হতে পারে।

মায়ের পরিচয় শুধুই মা। মাতৃত্বের চেয়ে সেরা সৃষ্টি আর কিসে হতে পারে! আরেকটি গল্প বলি মায়ের। একজন মা পাসপোর্ট করার জন্য অফিসে গেলে অফিসার জানতে চাইলেন, আপনার পেশা কী? তিনি জবাব দিলেন, আমি একজন মা। কী অদ্ভুত তাই না। শুধু মা তো কোনো পেশা হতে পারে না! কারণ এর বিনিময়ে তো অর্থ উপার্জিত হয় না। অফিসার বললেন, ঠিক আছে, আমি লিখে নিচ্ছি গৃহিণী। সেই মা পাসপোর্ট পেলেন এবং সন্তানের চিকিৎসা নিতে বিদেশ গেলেন। তারও অনেক দিন পর, পাসপোর্টটি নবায়ন করার দরকার হলো। আবার পাসপোর্ট অফিসে গেলেন তিনি। এসে দেখেন সেই অফিসার নেই। মা ফরম পূরণ করতে গেলে অফিসার জানতে চাইলেন, আপনার পেশা? মা এবার সাহস করে বললেন, আমি একজন গবেষক। নানা রকম চ্যালেঞ্জিং প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করি। শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ সাধন পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করি। বয়স্কদের নিবিড় পরিচর্যার দিকে খেয়াল রাখি। সুস্থ পরিবার ও সমাজ বিনির্মাণে নিরলস শ্রম দিয়ে রাষ্ট্রের কাঠামো মজবুত করি। কারণ, আমার সামান্য ভুলের জন্য পরিবার, সমাজ তথা জাতির বিশাল ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। কথা শুনে অফিসার নড়েচড়ে বসলেন। শ্রদ্ধায় অবনত নজরে তাকিয়ে অফিসার জানতে চাইলেন, আচ্ছা মা আমাকে বলুন আপনার পেশাটির নাম কী? মা বলতে লাগলেন, আমার রিসার্চ প্রজেক্ট তো দীর্ঘমেয়াদি, চলছে তো চলছেই। আমাকে সার্বক্ষণিক ল্যাবরেটরি এবং বাইরেও কাজ করতে হয়। নাওয়া-খাওয়া এমনকি ঘুমেরও সময় পাই না কখনো কখনো। আমার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আমি তিনবার জীবনের মূল্যবান পুরস্কারে ভূষিত হয়েছি। এখন আমি সমাজবিজ্ঞান, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান আর পারিবারিক বিজ্ঞান-এ তিনটি ক্ষেত্রেই একসঙ্গে কাজ করছি। প্রতিদিন আমাকে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা আবার কোনো কোনো দিন ২৪ ঘণ্টাই আমার ল্যাবে গবেষণা ও কাজকর্ম চলে। পৃথিবীর সব পেশাতেই কাজের পর ছুটি বলে যে কথাটি আছে আমার পেশাতে তা নেই। ২৪ ঘণ্টাই অন কল ডিউটি। শিশু, কিশোর, যৌবন, তারুণ্য, বিয়ে, সংসার জীবন, বিপদ-বিপর্যয় মোকাবিলা, জীবন সাজানো, মধ্য বয়স, বয়স্ক সব পর্যায়ে আমার নিবিড় তত্ত্বাবধানে বিকশিত হচ্ছে জীবন থেকে জীবনে। অফিসারের শ্রদ্ধাবনত অবস্থা দেখে তিনি আরো বলছেন, এই পেশা থেকে আমার কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই। বেতন নেই, প্রমোশনও নেই। অবসরও নেই হয়তোবা। প্রশান্তি আছে, অর্জন আছে, ডিপোজিট আছে। অফিসার অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইলেন- এ কেমন পেশা মা, বেতন নেই, প্রমোশন নেই, কিন্তু ডিপোজিট আর অর্জন আছে। মা হেসে বললেন, আমি যাদের জন্য কাজ করি তাদের সফলতাই আমার শ্রেষ্ঠ অর্জন এবং প্রশান্তি। তারাই তো আমার পৃথিবী, আমার ডিপোজিট। এর পরও কি আমার পেশার বিশেষ পরিচয় দরকার আছে? অফিসার আমতা আমতা করে বলতে চাইলেন, না মানে মা...। অফিসারকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, আমি একজন মা। অতি সাধারণ একজন মা। এর চেয়ে বড় পেশাদার পরিচয় আর কী হতে পারে বলতে পার বাবা? অফিসার মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এই মায়ের কথাগুলো শুনলেন। অফিসারের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। আসলেই তো ‘মা’ একটি মধুর শব্দ ঝংকার। মায়ের আলাদা কোনো উপাধির প্রয়োজন নেই। মা নিজেই একটি বিজ্ঞানাগার। এই মা মাতৃত্বের গবেষণাগারে নিবিড় যতেœ গড়ে তোলেন একেকটি মানবিক নক্ষত্র। সেই নক্ষত্ররাজিরা কি সত্যিই আলোকিত করে মায়ের মুখ!

আমরা যদি দায়িত্বশীল হই। মায়ের প্রতি সহানুভূতিশীল হই। তাহলে আর কোনো মায়ের দুঃখ থাকবে না। আর পৃথিবীতে বৃদ্ধাশ্রম বলে কিছু থাকবে না। বৃদ্ধাশ্রম হলো পৃথিবীর দায়িত্বহীন সব সন্তানের জন্য অভিশাপ আর পৃথিবীর ঘৃণা। আমাদের ধর্মেও মায়ের প্রতি কর্তব্য পালনের ব্যাপারে কঠোরভাবে হুশিয়ার করা হয়েছে। মায়ের মনে কষ্ট দিয়ে কেউই মুক্তি পাবে না। মায়ের মন সন্তানের জন্য সবসময়ই কাঁদে। মা তখনো কাঁদে যখন সন্তান খাবার খায় না আবার মা তখনো কাঁদে যখন সন্তান খাবার দেয় না। আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি, আর কখনো মাকে কাঁদতে দেব না। সবকিছু উজাড় করে দিয়ে সুখী করব প্রিয় মাকে। মায়ের মুখে হাসি ফোটাব। কেননা, আমাদের যা কিছু সবই মায়ের অবদান।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist