কাজী সিরাজুল ইসলাম

  ১৫ জানুয়ারি, ২০১৭

দুর্নীতি

খাদ্যপণ্যে ভেজাল জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি

নকল-ভেজালের বিরুদ্ধে বছরজুড়ে অভিযান চললেও কাক্সিক্ষত সুফল মিলছে না। লঘু সাজার কারণে ভেজালকারীদের দৌরাত্ম্য কিছুতেই থামছে না। সারা দেশে অবাধে বিক্রি হচ্ছে মানহীন পণ্য। এর ফলে ক্রেতারা যেমন প্রতারিত হচ্ছে, তেমনি হুমকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য।

এমনিতেই মানহীন কিংবা ভেজাল পণ্য উৎপাদকদের শাস্তি খুব একটা হয় না। এ ছাড়া পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর দক্ষতারও অভাব আছে। দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর থাকলেও তার তৎপরতাও সীমিত। ভেজাল ও মানহীন পণ্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযান অনেকাংশে রাজধানীতেই সীমিত। ঢাকার বাইরে তৎপরতা নেই বললেই চলে। ভেজাল বন্ধে নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ। নকল ও ভেজালের জন্য দায়ীদের অপরাধের দণ্ড বাড়াতে হবে।

খাদ্যে ভেজাল এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, কোনো সচেতন মানুষের পক্ষে কোনো খাদ্যই স্বস্তির সঙ্গে খাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। বাজারে যেসব জুস ও পানীয় বিক্রি হয় তার সিংহ ভাগই মানসম্মত নয়। নামিদামি কোম্পানির তৈরি করা মিষ্টি কতটা স্বাস্থ্যসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বাজারে যে ঘি, বাটার অয়েল ও ভোজ্যতেল বিক্রি হয় তার সিংহ ভাগই নকল-ভেজাল। শিশুখাদ্যের মানও এখন প্রশ্নবিদ্ধ। দুধে ভেজালের রাজত্ব বিরাজ করছে যুগ যুগ ধরে। এখন যেসব প্যাকেটজাত দুধ বিক্রি হয় তার বেশিরভাগই মানসম্মত নয়। আম, কলা, আপেল, খেজুর ইত্যাদি ফল খেতে ভয় পায় এমন মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো ফল পুষ্টির বদলে মানুষকে আরও রোগাক্রান্ত করছে।

খাদ্যপণ্যে ভেজাল জনস্বাস্থ্যের জন্য এ মুহূর্তে এক নম্বর হুমকি। এ হুমকি রোধে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও সামাজিক সচেতনতার অভাবে তা কোনো কাজে আসছে না। খাদ্যে ভেজাল নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তা দিনে দিনে বাড়ছে। দেশের সচেতন মানুষরা আজকাল বাজার থেকে কোনো পণ্য কিনেই স্বস্তি পাচ্ছেন না।

খাদ্য সামগ্রী ও কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রণের খবর ছড়িয়ে পড়ার ফলে দেশের সাধারণ ভোক্তারা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি হাইকোর্ট খাদ্যে ব্যাপক ভেজাল মেশানোর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের কাছে এ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। হাইকোর্ট বলেছেন, বারবার বলার পরও ভয়ঙ্কর এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। সরকারের ঢিলেঢালা মনিটরিং ব্যবস্থা এবং ভেজালের বিরুদ্ধে আইনের যথার্থ প্রয়োগ না হওয়ার কারণেই খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর প্রবণতা অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

খাদ্যে নকল ভেজাল বন্ধে সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। এ জন্য দরকার সামাজিক সচেতনতা। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠলে এ আপদ থেকে সহজেই নিস্তার পাওয়া যাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে নকল ভেজালের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। খাদ্যে ভেজালকারীদের সামাজিকভাবে চিহ্নিত করে কঠোর সাজার ব্যবস্থা করতে হবে। ভেজাল বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগ নেবে আমরা তেমনটিই দেখতে চাই।

কারাদণ্ডের পাশাপাশি অর্থদণ্ড এমনভাবে বাড়াতে হবে যাতে অপরাধীরা ভয় পায়। প্রতিটি জেলার জেলা প্রশাসক ও পুলিশপ্রধানকে পণ্য ভেজাল রোধের দায়িত্বে সম্পৃক্ত করতে হবে। দেশে নকল ভেজালের দৌরাত্ম্য কীভাবে বাড়ছে তার প্রমাণ মেলে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা পণ্যে। সেখানে যেসব খাদ্যপণ্য পরীক্ষার জন্য যায় তার দুই-পঞ্চমাংশের মধ্যে ভয়াবহ ভেজালের প্রমাণ পাওয়া যায়। শিশুখাদ্যেও চলছে যথেচ্ছভাবে ভেজাল। জনস্বার্থে এ ব্যাপারে সরকারকে আইনগত ব্যবস্থা যেমন জোরদার করতে হবে, তেমনি নকল ও ভেজাল প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোতেও লোকবল বাড়াতে হবে।

কোন পণ্যে কী ভেজাল তা এত বেশি আলোচিত যে, সাধারণ মানুষেরও মুখস্থ হয়ে গেছে। যেমন ‘মাছে ও দুধে মেশানো হয় ফরমালিন। ফলমূল পাকাতে ব্যবহৃত হয় কার্বাইড। মুড়িতে ইউরিয়া, শুঁটকি তৈরিতে ডিডিটি, গুঁড়া মসলা, চানাচুর ও রঙিন খাবারে ব্যবহার করা হয় শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর কাপড়ের রং, সবজিতে সরাসরি কীটনাশক স্প্রে করা হয় এবং কীটনাশক সক্রিয় থাকতেই সেগুলো বাজারজাত করা হয়। মুরগির খাবার বা পোলট্রি ফিড তৈরি হয় ট্যানারির বর্জ্য দিয়ে। তাতে থাকে ক্রোমিয়ামসহ নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য। মুরগির মাংসের মাধ্যমে সেগুলো মানবদেহে চলে আসে। থাকে অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি। এমনি আরও কত কী! সাধারণ মানুষের এ ক্ষেত্রে করার কী আছে? বাঁচতে হলে তাদের এসব পণ্যই কিনে খেতে হবে। এসব খেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে হবে। জনমানুষের উদ্বেগ ও ভেজালের ভয়াবহ ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে উচ্চ আদালত থেকেও একাধিকবার সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ যে বিশেষ কিছুই হয়নি তার প্রমাণ জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের গবেষণাগারে সাম্প্রতিক সময়ের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল। সেখানে দোকান থেকে সংগ্রহ করা মিষ্টির সব নমুনাই ভেজাল এবং সয়াবিন তেলের সংগৃহীত নমুনায় ৭৫ শতাংশই ভেজাল পাওয়া গেছে। কমবেশি ভেজাল পাওয়া গেছে সরিষার তেল, লবণ, হলুদের গুঁড়া, মধু, গুড়, বিস্কুট, ডাল, সেমাই, জেলিসহ অনেক খাদ্যপণ্যে। তাহলে মানুষ খাবে কী? জীবনধারণ করবে কীভাবে? সাধারণ মানুষের পক্ষে এসব ভেজাল খাদ্যদ্রব্য চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব। তাই তারা কি শুধু নীতিজ্ঞানহীন কিছু মানুষের অত্যন্ত ক্ষতিকর লোভের শিকার হতেই থাকবে? এর আগেও বিভিন্ন সময় খাদ্য পরীক্ষায় প্রায় একই ধরনের তথ্য উঠে এসেছে। খাদ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত ডিডিটিসহ কার্বামেড, কার্বাইড, ক্রোমিয়াম, অ্যালড্রিন, আর্সেনিক, ফরমালিনের মতো অনেক বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এগুলো মানবদেহে ক্যানসার সৃষ্টি, লিভার ও কিডনি অকেজো করে দেওয়াসহ বহু প্রাণঘাতী রোগের কারণ হচ্ছে। এসব কারণ থেকে মুক্তি পেতে হলে সমাজে বসবাসকারী সব মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু তারা এলেই কি ‘মুক্তি’ দোরগোড়ায় এসে কড়া নেড়ে বলবে, ‘দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, আপনারা এখন ভেজালমুক্ত’। না, এটা নিছক এক স্বপ্ন বিলাস ছাড়া আর কিছুই হবে না।

জনগণ হচ্ছে অনেকটা কচুরিপানার মতো। যেদিকে যায় কচুরিপানাও সেদিকে যাবে। এখানে প্রয়োজন হবে একজন বৈপ্লবিক নেতার। যিনি মনে করবেন দেশকে ভেজালমুক্ত করার কাজটি নিঃসন্দেহে একটি বৈপ্লবিক কাজ। আর সে কারণেই প্রয়োজন সেই নেতার। যার পেছনে কচুরিপানার মতো জনগণও এগিয়ে যাবে।

কোনো ইতিবাচক কিছু পেতে বা কল্যাণকর কিছু পাওয়ার জন্য আমরাও আশা করতে পারি। এ কাজে আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই পেতে আগ্রহী। তার নেতৃত্বে সরে যাক যত জঞ্জাল, ভেজালমুক্ত হোক বাংলাদেশ।

লেখক : উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
খাদ্যপণ্যে ভেজাল,জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist