ইরানী বিশ্বাস

  ০৮ মার্চ, ২০২০

নারী দিবস প্রতিপাদ্য

নারী সচেতন হলে, পাল্টে যাবে বিশ্ব

আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ মজুরি-বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ এবং কর্মক্ষেত্রে বৈরী পরিবেশের প্রতিবাদ করেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সুতা কারখানার একদল শ্রমজীবী নারী। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের ওপর দমন-নিপিড়ন চালায় মালিকপক্ষ। নানা ঘটনার পর ১৯০৮ সালে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ও রাজনীতিবিদ ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে প্রথম নারী সম্মেলন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সাল থেকে জাতিসংঘ দিনটি নারী দিবস হিসেবে পালন করছে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিনটি নানা আনুষ্ঠানিকতায় উদযাপিত হয়। জাতিসংঘ এ বছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে, ‘আমি প্রজন্মের সমতা: নারী অধিকারের প্রতি সচেতনতা’। আর বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘প্রজন্ম হোক সমতার, সকল নারীর অধিকার’।

প্রতিদিনই বাড়ছে নারীর প্রতি নির্যাতন, হয়রানিসহ নানা ধরনের নেতিবাচক খবর আসে। বিশ্বজুড়ে নারীর অগ্রগতি ও মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্যে অনেক পথ পাড়ি দেওয়া এখনো বাকি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা-নির্বিশেষে মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবি তাই সার্বজনীন। অনেকেই বলছেন, চারদিকে এত ধর্ষণ এত অন্যায় তারপরও কি নারী দিবস পালন করা উচিত!

আমার ছোটবেলায় নারী দিবস ছিল না। গ্রামের স্কুল কলেজে তখনো নারী দিবস নিয়ে কোনো আলোচনা বা জানাজানি হয়নি। তাই বিষয়টি আমার কাছে ছিল সম্পূর্ণ অজানা। বড় হতে হতে জানতে পারি নারী দিবস অর্থাৎ নারী অধিকারের একটি দিন। খুব মনে পড়ে, লেখালেখির শুরুতে প্রতিবছর নারী দিবসের বিশেষ আয়োজনে পত্রিকায় আমার লেখা থাকতো। এরকম এক নারী দিবসের একটি প্রবন্ধ লিখতে বসে, আমার বার বার মনে হতে লাগলো নারী কার কাছে অধিকার চাইবে? সংসারে তো সব অধিকার একজন নারীর হাতে। তাহলে বিশ্বজুড়ে নারী অধিকার নিয়ে এত হৈচৈ কেন, কিসের জন্য? বিষয়টি আমাকে খুব ভাবনায় ফেলে দিলো। আমি বিশ্বের দিকে নয়, আমি আমার নিজের সংসারের দিকে তাকালাম। আমার ঠাকুরমা, আমার মা, আমি, আমার মেয়ে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সবই নারী। আমার বাবা যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতেন, আমার ঠাকুর মাকে জিজ্ঞেস করতেন। আমার ভাই কোনো কিছু করতে হলে আমার মা’কে জিজ্ঞেস করে সিদ্ধান্ত নেয়। আমার ছেলে থাকলে নিশ্চয়ই একইভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করে কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো। আমার মেয়ে যখন কোনো ছেলে সন্তানের মা হবে, তখন নিশ্চয়ই ধারাবাহিকতা বজায় ধাকবে। অথবা আমার ঠাকুর দাদা ও নিশ্চয়ই তার মা’কে জিজ্ঞেস করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন! তাহলে সংসারে তো নারীই অধিকর্তা। যে সংসারের পুরুষ সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন নারীর সিদ্ধান্তছাড়া। সেখানে সেই নারীই কিনা পুরুষের কাছে নিজের অধিকার চাইছে? বিষয়টি সত্যি আমার কাছে হাস্যকর মনে হলো।

মানব সন্তানের জন্মহয় নারীর গর্ভে। সন্তান গর্ভে ধারণ, জন্মদান এবং জন্মের পর সেই সন্তান প্রতিপালন করেন একজন নারী। একই নারীর গর্ভে একজন ছেলে সন্তান এবং একজন মেয়ে সন্তান জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু জন্মের পর থেকে প্রথম দৃষ্টি ভঙ্গি বদলে যায় মায়ের। তিনি জন্মের পর থেকে মেয়েকে মেয়ের মতো এবং ছেলেকে ছেলের মতো দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বড় করে তোলেন। মেয়ে সন্তান হলে মা তার চুলটা একটু বড় করেন। মার্কেট থেকে দুটি ছোট্ট ক্লিপ নিয়ে আসেন। অথবা আরো একটু বড় হলে একটা পুতুল এনে তার হাতে দেন। আবার ছেলের জন্য একটা বল, গাড়ি, ব্যাট এসব কিনে এনে দেন। ছেলে এবং মেয়ের মূল বিভাজন শুরু হয় সংসারে মায়ের হাত ধরেই।


পৃথিবীর সকল মা আদর্শ মা হোক, তাহলে সকল নারীর মুক্তি মিলবে। আপনি একজন ভালো মা হোন, সমাজ পাল্টে যেতে বাধ্য


প্রায় পাশাপাশি বয়সে বেড়ে ওঠা একজন ছেলে এবং একজন মেয়ের মধ্যে মা পার্থক্য তৈরি করে দেন। ছেলে সন্তান যদি বড় হয় তাহলে ছোট বোনকে সব সময় মা বলে দেন, ও তোমার বড় ভাই। ও যা বলবে তা-ই শুনবে। আবার ছেলে যদি ছোট হয়, তাহলে মেয়েকে বলবে, ও তোমার ছোট ভাই ও একটু পাগলামী করবে, তোমাকে সহ্য করতে হবে। তাছাড়া কথায় আছে ছেলেরা মা ভক্ত হয়, আর মেয়েরা বাবা ভক্ত হয়। আমার যতদুর মনে হয়, মায়ের ভালোবাসায় ছেলেরা একটু বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অর্থাৎ মা হচ্ছে শক্তির আধার। ছেলের যতরকম অন্যায় আবদার একমাত্র মা-ই পূরণ করেন। সংসারে বাবাকে না জানিয়ে ছেলে সন্তানের জন্য মা যত অন্যায় আবদার মিটিয়েছেন, বোধ করি কোনো মা তার মেয়ের জন্য তার এক বিন্দুও করেছেন কি না সন্দেহ।

ছেলে বড় হয়েছে, বিয়ে করায়ে একটি মেয়ে ঘরে তুলেছেন একজন মা। কোনো ছেলের কি সাহস হবে, তার মাকে বলবে, মা আমি তোমার চেয়ে বউকে বেশি ভালোবাসি। তাহলে আর রক্ষে নেই। হয় বিবাহ বিচ্ছেদ, না হয় অন্যত্র বসবাস। আবার একই দৃশ্যের ভিন্নচিত্র দেখতে পাই মেয়ের বিয়ে হলে। মেয়ের জামাই যদি তার মাকে ভালোবাসে সেটা মোটেই সহ্য করবেন না মেয়ের মা। তাহলে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? একজন নারীর কাছে শুধুমাত্র তার নিজের ছেলে এবং মেয়ে ভালো পৃথিবীর বাকি সবই খারাপ। অর্থাৎ সমস্ত ঘটনার মূল চালিকা শক্তি সংসারের নারী।

প্রতিদিন সমাজে ধর্ষণের মতো ভয়াবহতা সৃষ্টি হচ্ছে। এর পিছনেও কি একজন নারী নেই? অবশ্যই আছে। কোনো মা যদি ছোটবেলা থেকে ছেলে সন্তানকে শিক্ষা দেন, মেয়েদের কি চোখে দেখতে হবে। সংসারে ছেলে সন্তান বড় হলে, মা তার মেয়ের ভালো-মন্দ অর্থাৎ শাসনের ভার দেন ছেলেটির উপর। সেই থেকে ছেলেটি জেনেই আসছে মেয়ে মানে হচ্ছে ছেলেদের উপর নির্ভরশীল। এটা আমাদের দেশের ৮০% পারিবারের চিত্র।

পরিবার হচেছ সন্তানের প্রথম এবং প্রধান স্কুল। যেখান থেকে সে মগজ নয় মননে শিক্ষাগ্রহণ করেন। স্কুল-কলেজে কাগজে কলমে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়া হয়। আর পরিবারে মা তাকে শিক্ষা দেন, বড়দের সঙ্গে কি ধরনের ব্যবহার করতে হবে। ভাত খাবার আগে হাত ধুতে হয়। টয়লেট থেকে এসে হাত পরিষ্কার করতে হয়। কথা কিভাবে বলতে হয়। সন্তানের বাচন ভঙ্গি, সৌজন্যতা, মাধুর্যতা এ সবই একজন মায়ের কাছ থেকে সন্তান শিক্ষা গ্রহণ করেন। পৃথিবীর কোথাও এসব শিক্ষার প্রতিষ্ঠান নেই। এ জন্যই নেপলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, ‘তুমি আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি একটি শিক্ষিত জাতি দেবো’। এখানে শিক্ষিত বলতে বড় বড় ডিগ্রি নয়। শিক্ষিত বলতে একজন আদর্শ মাকে বলা হয়েছে।

পৃথিবীতে হয়তো এখন এই আদর্শ মায়ের বড়ই অভাব। মাঝে মাঝে আমি অবাক হই দেখে, মা নিজের কাজের সুবিধার্থে ৬ মাসের বাচ্চার সামনে ইউটিউব থেকে কার্টুন বের করে দিচ্ছে! তিনি নিজেই জানেন না, জেনে শুনে এই মা তার সন্তানের হাতে ড্রাগ তুলে দিচ্ছেন। একবার ড্রাগ গ্রহণে যে পরিমাণ ব্রেনে ইফেক্ট হয়, তার চেয়ে দ্বিগুন বেশি ইফেক্ট হয় একটি কার্টুন দেখলে। প্রায় সব মা-ই এখন তাদের বাচ্চাদের হাতে ইউটিউব তুলে দিচ্ছেন। অনেকে নিজের সন্তানের জন্য গর্ব করছেন। কারণ তার সন্তান এখনো অক্ষর চেনে না অথচ ইউটিউব থেকে পছন্দের ভিডিও বের করতে পারে। এটা কতটা যুক্তযুক্ত আমি ঠিক বুঝি না। তবে এতক্ষণ যা লিখেছি এর কোথাও কি একজন পুরুষের ভুমিকা আছে? তাহলে নারী নিজেই নিজের অধিকার ক্ষুণ্ন করছে প্রতিমূহূর্তে। আমি চাইবো পৃথিবীর সকল মা আদর্শ মা হোক, তাহলে সকল নারীর মুক্তি মিলবে। আপনি একজন ভালো মা হোন, সমাজ পাল্টে যেতে বাধ্য।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আন্তর্জাতিক নারী দিবস,কলাম,অধিকার,নারী,মা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close