কাজী খোরশেদ আলম

  ০৭ অক্টোবর, ২০১৯

রেমিট্যান্সকন্যাদের দিকে দৃষ্টি দিন

আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে পুরুষের পাশাপাশি নারীও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তারা ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে দেশের গণ্ডি পার হয়ে প্রবাসের মাটিতে নিয়মিত যুদ্ধ করছেন। নিজের ভাগ্যবদল করতে স্বামী-সন্তান ও বাবা-মা, ভাই-বোন ছেড়ে দূর-দূরান্তে প্রবাসী হয়েছেন। দেশের মায়া ত্যাগ করে একান্ত ভাগ্যের ওপর ভরসা করে পরদেশে নিজের শরীরের ঘাম ও রক্ত পানি করে অর্থ উপার্জন করছেন। কত দুঃখ-কষ্ট বুকে চাপা রেখে গৃহকর্তা ও অফিসের কর্মকর্তাদের অসহ্য নির্যাতন সহ্য করে সংসারের চাহিদা মেটানোর জন্য অর্থ পাঠিয়ে থাকেন।

পুরুষ যেমন রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করেন সে ক্ষেত্রে নারীও কোনো অংশে কম নেই; তারাও জীবনে ঝুঁকি নিয়ে বিদেশের মাটিতে কঠোর পরিশ্রম করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে চলেছেন। দেশের পোশাকশিল্পে যেমন নারী যথেষ্ট ভূমিকা রাখছেন; তেমনি রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতেও তারা পিছিয়ে নেই। তবে তারা যেভাবে কঠোর পরিশ্রম করে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করছেন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন। কিন্ত তাদের বিপদে-আপদে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কিংবা দেশের কর্তাব্যক্তিরা সন্তুষ্টজনক ভূমিকা রাখছেন না বলেই অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যথাযথভাবে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখলে হয়তো রেমিট্যান্সকন্যাদের নির্যাতন ও হয়রানির পরিমাণ কিছুটা কম হতো।

আমাদের দেশের যেসব নারীকর্মী প্রবাসে যান, তাদের বেশির ভাগই অল্প শিক্ষিত। তারা গৃহস্থালি কাজে প্রবাসের বাড়িতে সংযুক্ত হন। গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীর মন জয় করতে পারলে রক্ষা; অন্যথায় বিভিন্ন কলাকৌশলে নির্যাতনের শিকার হয়। নারীকর্মীদের প্রবাসে গমনের আগে সংশ্লিষ্ট বিভাগের যাচাই-বাছাই করা উচিত; তাদের প্রকৃতপক্ষে কোন কাজে নেওয়া হচ্ছে অথবা তাদের সঠিক কাগজপত্র ও চুক্তিপত্র সই-স্বাক্ষর করে নেওয়া হচ্ছে কি না। দালাল চক্রের সদস্যরা এ দেশের সাধারণ নারী ও গরিব মেয়েদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে অনেক সময় প্রবাসে বিক্রয় করে দেয় কিংবা খারাপ গৃহকর্তার হস্তগত করে দেয়। এতে করে সেই মেয়েটি অথবা নারীটি দিনের পর দিন যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু প্রতিকার পাওয়ার কোনো পথ খোলা থাকে না। তাই একান্ত বাধ্য হয়ে সব নির্যাতন সহ্য করেন। নির্যাতনের মাত্রা অতিরিক্ত হয়ে গেলে অনেক সময় আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হন।

পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে গিয়ে নির্যাতিত সৌদি প্রবাসী নারীকর্মীরা চিকিৎসাও পান না। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার বিধবা কাবিরুন নাহার। সৌদিতে তার মহিলা নিয়োগকর্তা তিন তলা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দেয়। প্রায় তিন মাস হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সেইফ হোমে আশ্রয় নেন পঙ্গু কাবিরুন নাহার। তিনি জানান, সেইফ হোমে আরো ২৪০ জন নির্যাতিত নারী রয়েছেন। ঢাকার জুরাইনের সেতু বেগম, বগুড়ার মাসুদা, লালমনিরহাটের শিরিনা বেগম, বি-বাড়িয়ার রোজিনা বেগম, নাটোরের রেবেকা খাতুন, বরিশালের কুলসুম, সিলেটের জোৎস্না, গাজীপুরের নাসিমা বেগম। তাদের অভিযোগ সেইফ হোমে আসার পরও তারা তেমন কোনো সহযোগিতা পান না, বরং তাদের দেশ থেকে পাঠানো টাকা দূতাবাসের ড্রাইভার ও পিয়নরা আত্মসাৎ করে ফেলেন। অপরদিকে মুন্সীগঞ্জ সদরের জহুরা বেগম নিজের একমাত্র সন্তানকে একটু ভালোভাবে মানুষ করার আশায় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে যান তিনি। কিন্তু মাত্র তিন মাসের মাথায় ২০১৮ সালের ১৩ মে তিনি আত্মহত্যা করেন বলে সৌদি আরব থেকে খবর আসে, তবে বোনের সন্তান যেন শেষবার মায়ের মুখ দেখতে পারেন তাই জোহরার মরদেহ ফেরাতে মাসের পর মাস বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন শামীম মিয়া। তার চেষ্টায় মৃত্যুর ৯ মাস পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জহুরার লাশ আসে দেশে।

শুধু জহুরা নয়, ২০১৮ সালে ১৭ জন বাংলাদেশি নারীর লাশ এসেছে; যারা বিদেশে কাজ করতে গিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। যারা ছিলেন দেশের রেমিট্যান্স সৈনিক, একটু ভালো থাকার আশায় গিয়েছিলেন বিদেশে। গত কয়েক বছরে বিদেশে নারীকর্মীদের মৃত্যুহার যেমন বেড়েছে; তেমনি বেড়েছে আত্মহত্যার সংখ্যাও। ২০১৬ সাল থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত এ সংখ্যা ৫৩ জন। বিষয়টি উদ্বেগজনক বলছেন অভিবাসনসংশ্লিষ্টরা। তবে প্রবাসী দেখভাল-বিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, প্রবাসী নারীকর্মীদের আত্মহত্যা বাড়ছে বলে তেমন কোনো পরিসংখ্যান তাদের কাছে নেই। যদিও তিন বছরের যে সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের হিসাব। তথ্যমতে, এ বছরের প্রথম ছয় মাসে ৬০ নারী গৃহকর্মীর মরদেহ দেশে আসে। এদের মধ্যে ১৭ জন আত্মহত্যা করেন, ২০ জন স্ট্রোকে, দুর্ঘটনায় ১০ জন, স্বাভাবিকভাবে পাঁচজন এবং অন্যান্য কারণে আটজনের মৃত্যু হয়।

বিমানবন্দরে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে মাত্র একজন নারীকর্মীর আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করা হয়। এরপর ২০১৭ সালে তা বেড়ে ১২ জন, ২০১৮ সালে ২৩ জনে দাঁড়ায়।

দরিদ্র পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষের মৃত্যু তাদের জন্য নতুন বিভীষিকা নিয়ে হাজির হয়েছে। পরিবারের অভিযোগ, তারা আত্মহত্যা করেননি বরং তাদের হত্যা করে আত্মহত্যার তকমা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এদিকে শামসুন নাহার নামে আরেক নারীকর্মী আত্মহত্যা করেছেন, তা মানতে রাজি নয় তার ছেলে একরামুল মোল্লা। একরামুলের যখন আট বছর বয়স তখন বাবাকে হারান। মা অনেক কষ্টে তাকে বড় করেন। ২০ বছরের একরামুলকে বিয়েও দেন। কিন্তু এনজিও থেকে নেওয়া লোন পরিশোধ করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়েছিলেন যশোরের মনিরামপুরের শামসুন নাহার। তাই প্রতিবেশীদের দেখাদেখি তিনিও পাড়ি জমান সৌদি আরবে। কিন্তু জহুরার মতো তিনিও কয়েক মাসের মাথায় সেখানে আত্মহত্যার করেন বলে বাড়িতে খবর আসে।

বাংলাদেশ নারীশ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, প্রত্যেকটি শ্রমিক সুস্থভাবে বিদেশ যান। তার প্রমাণ মেডিকেল ফিটনেস নিয়ে প্রবাসে গমন করেন। নিশ্চয় সেখানে গিয়ে তাদের এমন কোনো পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, যাতে তারা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। এ শ্রমিকদের দেখাশোনার জন্য সরকার কোনো ব্যবস্থা করতে পারেনি। অথচ রেমিট্যান্স যোদ্ধারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। রেমিট্যান্স দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নে সবার শীর্ষে রয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বর্তমানে প্রায় ৯০ লাখের বেশি জনশক্তি বিশ্বের ১৫৭টির অধিক দেশে কর্মরত আছেন। প্রবাসী বাংলাদেশীরা তাদের সততা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি করতে কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদিশিক মুদ্রানীতি বিভাগের প্রতিবেদন সূত্রে পাওয়া যায়, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিট্যান্স ১৬০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে; যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২১ জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা ১ হাজার ৬০৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। প্রবাসী আয়ের এ পরিমাণ অতীতের যেকোনো বছরের চেয়ে বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য থেকে আরো জানা যায়, ২০১৮ সালে ব্যাংকিং চ্যানেলে ১ হাজার ৫৫৭ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা; যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০৪ কোটি ডলার বা প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। ২০১৭ সালে এসেছিল ১ হাজার ৩৫৩ কোটি ডলার। এর আগের বছর ২০১৬ সালে ছিল ১ হাজার ৩৬১ কোটি ডলার। ২০১৫ সালে এসেছে ১ হাজার ৫৩১ কোটি ডলার। আর ২০১৪ সালে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৯২ কোটি ডলার। আসন্ন ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে রেমিট্যান্স পাঠানোর ওপর প্রবাসী বাংলাদেশিদের ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

যাদের ত্যাগ ও কঠোর শ্রমের বিনিময়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়। তাদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনী যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে নারীশ্রমিক যারা তারা যেন কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার না হন। বাংলাদেশ থেকে নারীশ্রমিক প্রেরণের আগে সংশ্লিষ্ট নিয়োগকর্তা অথবা নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সঠিকভাবে প্রদানের শর্ত রেখে সঠিক পন্থায় চুক্তি সম্পাদন করার ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। যাদের ত্যাগ আমাদের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছে, তাদের সুবিধার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। তাই রেমিট্যান্সকন্যাদের সোনালি দিবসের প্রতিক্ষায়-তাদের প্রয়োজনীয় সুবিধা প্রদানে অগ্রাধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিদের সুদৃষ্টি দেওয়ার প্রত্যাশা রইল।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রেমিট্যান্স,কলাম,প্রবৃদ্ধি,নারী
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close