মিঞা মুজিবুর রহমান

  ২৩ জুন, ২০১৯

ঐতিহ্য ও উন্নয়নের ধারক আ.লীগ

৭১-এ পা রেখেছে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। বাঙালি জাতির মুক্তির উদ্দেশে যে দলটি গঠন করা হয়েছিল, তারা এখন দেশের শাসন ক্ষমতায়। এই দলের হাত ধরে এসেছে সব থেকে গর্বের অর্জন স্বাধীনতা। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ২২ মাসের মাথায় পুরান ঢাকার রোজগার্ডেনে আত্মপ্রকাশ করে নতুন দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত হয় দলটি। পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজগার্ডেনে ২৩ ও ২৪ জুন অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গঠিত কমিটিতে সভাপতি হয়েছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন শামসুল হক এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সময় শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে বন্দি। বয়স মাত্র ২৯। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘কোথাও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন সাহেবের রোজগার্ডেনের বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল।’ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন রাজনৈতিক নেতারা সেদিন রোজগার্ডেনে উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হলো ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ।’

১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার ‘মুকুল’ প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিব। আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে যাত্রা করলেও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। নতুন নাম হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নাম নেয় দলটি।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনৈতিক সংগ্রাম, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়সহ বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে পঞ্চাশের দশকে আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারণে বর্ষীয়ান নেতা মওলানা ভাসানী দলটি থেকে বেরিয়ে ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ছয় দফা কর্মসূচি আওয়ামী লীগকে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এই ছয় দফার ভিত্তিতে ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে। ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন দখল করে আওয়ামী লীগ ৩১৩ আসনবিশিষ্ট পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং সরকার গঠনে ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নের যোগ্যতা অর্জন করে। প্রাদেশিক পরিষদের আসনের মধ্যে ২৮৮ আসন পায় দলটি। জাতীয় পরিষদের সাতটি মহিলা আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ১০টি মহিলা আসনের সবগুলোতেই জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানানোর পরিবর্তে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে বাঙালির অধিকার নস্যাৎ করার পথ বেছে নেয়। সত্তরের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেও পূর্বঘোষিত ৩ মার্চের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করলে রাজপথে লাখো মানুষ নেমে আসে। শুরু হয় আরেক দফা আন্দোলন। তারপর জাতির জনক ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে তিনি সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক শাসনামলে নির্যাতন আর নিপীড়নের মধ্যে পড়ে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটি। দলের মধ্যেও দেখা দেয় অনৈক্য ও বিভেদ। ১৯৮১ সালের ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে জাতীয় ও দলীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনাকে তার অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। ওই বছরের ১৭ মে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দলীয় সভাপতি হিসেবে দেশে ফিরে কয়েক ভাগে বিভক্ত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করেন। এরপর আন্দোলন শুরু করেন সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে।

২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। পাঁচ বছর শাসনের পর ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। এরপর দেশে নতুন রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে জয়ী হয়ে সরকারে ফেরে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতাসীন হয়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বার নির্বাচিত হয়ে রেকর্ড গড়ে। আওয়ামী লীগই পৃথিবীর একমাত্র দল, যে দল একটি দেশের জন্ম দিয়েছে। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে দেশের উন্নয়ন প্রকল্প একের পর এক পেখম মেলে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। চার লেন মহাসড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পানগাঁও নৌ-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, গ্যাস সংকট নিরসনে এলএনজি টার্মিনাল প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা সমুদ্রবন্দর, রাজধানীর চারপাশে সুয়ারেজ ট্যানেল নির্মাণের মতো অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে।

উন্নয়নের এ কর্মযজ্ঞে যোগ হয়েছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প এবং দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম প্রকল্প। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের কাজ চলছে। এরই মধ্যে কয়েকটি অঞ্চলের কাজের উদ্বোধনও করা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ নিরাপদ এবং পণ্য পরিবহন-খালাস সহজীকরণ করতে নেওয়া আরো কিছু অবকাঠামোর সংস্কার হচ্ছে। একই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও এগিয়েছে দেশ। ১৬ কোটি মানুষের দেশে কয়েক বছরে সক্রিয় মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ কোটি, আর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সম্ভাবনার নবদিগন্তে বাংলাদেশে সংখ্যা সাড়ে ৫ কোটি। দেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ মহাকাশে উৎক্ষেপণ হয়েছে।

এক নজরে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন : ১.পদ্মা সেতু নির্মাণ, ২. সমুদ্র সীমানা বিজয়, ৩. শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, ৪. ফ্লাইওভার নির্মাণ, ৫. জেলেদের খাদ্যসহায়তা প্রদান, ৬. দারিদ্র্যতার হার নিম্নপর্যায়ে, ৭. যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিচার, ৮. বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, ৯. বিনামূল্যে প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীদের হাতে বই বিতরণ, ১০. বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, ১১. কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, ১২. বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, ১৩. দেশের রফতানি আয় বৃদ্ধি, ১৪. মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, ১৫. গরিব শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, ১৬. অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন ব্যবস্থা, ১৭. রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ১৮. মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা প্রদান, ১৯. প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল তথ্য সেবাকেন্দ্র, ২০. বিভিন্ন জেলায় বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ, ২১. বিভিন্ন জেলায় শিল্পপার্ক নির্মাণ, ২২. দেশের বিভিন্ন স্থানে ইকোনমিক জোন নির্মাণ, ২৩. গ্রামীণ রাস্তাঘাট ও কালভার্ট নির্মাণ, ২৪. মোবাইল ও ইন্টারনেট গ্রাহক বৃদ্ধি, ২৫. একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, ২৬. কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, ২৭. কৃষিতে সফলতা, ২৮. জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে সফলতা, ২৯. এশিয়ান হাইওয়ে রোড প্রকল্প, ৩০. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, ৩১. প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদান, ৩২. নারীর ক্ষমতায়ন, ৩৩. বিধবা ভাতা প্রদান, ৩৪. মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধি, ৩৫. বয়স্ক ভাতা প্রদান, ৩৬. মাতৃকালীন ভাতা প্রদান ৩৭. ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যকর, ৩৮. মেট্রোরেল, ৩৯. হাতিরঝিল প্রকল্প, ৪০. এলিভেটেড একপ্রেস প্রকল্পের কাজ চলছে, ৪১. স্যাটেলাইট ৪২. ৪জি-৫জি, ৪৩. মাদক নিধন, ৪৪. ভিক্ষুক মুক্তকরণ, ৪৫. হরতাল মুক্তকরণ, ৪৬. ২০০টির ওপরে মসজিদ স্থাপন, ৪৭. রূপপুরে পারমাণবিক স্থাপন, ৪৮. প্রাইমারি স্কুল সরকারীকরণ।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। অথচ স্বাধীনতার ৪৬ বছরে বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখন তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, সম্পদে ভরপুর এবং সম্পদে উপচেপড়া ঝুড়িতে পরিণত হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে স্বাধীনতা অর্জন এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ, সাহসী, সৎ, যোগ্য নেতৃত্বের ফলে। আশির দশকে বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্পের বিকাশের মাধ্যমে বৈদেশিক অর্থ উপার্জনের সূচনা হয়। কালক্রমে এ শিল্প এখন বিশ্বে অন্যতম প্রধান রফতানিকারক শিল্পে পরিণত হয়েছে। প্রবাসী আয় আজ বার্ষিক ৩২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আজ আমরা শত্রুর মুখে চুনকালি দিয়ে বিশ্ব অগ্রগতির মহাসড়কে। দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছি দুর্বার। এখন সময় বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আ.লীগ,ঐতিহ্য,উন্নয়ন,আওয়ামী লীগ,কলাম
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close