অলোক আচার্য

  ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৮

নির্বাচন এবং নতুন বছরের ভাবনা

সময়ের কালস্রোতে একটি বছর পার করে এলাম। অনেক চাওয়া পাওয়ার নতুন নতুন হিসাব নিয়ে নতুন একটি বছর শুরু হচ্ছে। এটিই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু অন্য বছরগুলোর তুলনায় ২০১৯ সালের শুরুটা একটু ভিন্ন হওয়ার কথা। কারণ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৮ সালের সমাপ্তি দ্বারপ্রান্তে। ফলে সারা দেশে এখন নির্বাচনী তাপ-উত্তাপ। অন্য অনেক বছরের মতো নতুন বছরের আগমন নিয়ে আবেগ উচ্ছ্বাস অনেকটা কম। তার কারণও জাতীয় নির্বাচন। নতুন বছর মানে যেমন অনেক হিসাব-নিকাশ তেমনি একটি জাতীয় নির্বাচন মানেও অনেক হিসাব-নিকাশ, অনেক শঙ্কা অথবা অনেক আশা।

৩০ ডিসেম্বর যেহেতু জাতীয় নির্বাচনের ভোটগ্রহণের দিন তাই পরের দিন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর যেভাবে থার্টি ফার্স্ট নাইট পালিত হয় সেভাবে হয়ত পালিত হবে না। নিরাপত্তার বিষয়টি এখানে মুখ্য। কারণ নিরাপত্তাই প্রথম কাজ। নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার হাত থেকে দেশের সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা এবং তা ঘটতে না দেয়াই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মূল লক্ষ্য। সুতরাং আশা করাই যায় নতুন বছরের শুরুটাই হবে একটু ভিন্ন। সেই সাথে আমরা পাবো জনগণের ভোটে নির্বাচিত যোগ্য প্রতিনিধি। যার নেতৃত্বে পরবর্তী পাঁচটি বছর আমাদের দেশ এগিয়ে যাবে। জনগণের ভাগ্য পরিচালনার দায়িত্ব যার হাতেই ন্যস্ত হোক না কেন আমাদের দেশের যে অগ্রযাত্রা তা থামবে না তা আশা করতেই পারি।

একেকটি বছর শেষ হবে আর নতুন বছর আসবে। থেকে যাবে কিছু হিসাব-নিকাশ। ভুল এবং ভুল শোধরানোর জন্য থেকে যাবে এসব হিসাব। নতুন বছর মানে সবকিছুকে নতুন করে বরণ করে নেয়া। অতীতের ভুল ক্রটিগুলো শুধরে নতুন করে শুরু করা। প্রতিটি বছরে আমাদের দেশ অর্জন করছে নতুন নতুন সাফল্য। সাফল্যের খাতা ক্রমেই ভারী হচ্ছে। আমরা এগিয়ে চলেছি সামনের দিকে। এ যেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায়, ‘জ্বলে পুড়ে মরে ছাড়খার তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ আমরা মাথা নোয়াইনি কোনো অন্যায়ের কাছে। বাংলাদেশ কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়ায় না। যত বাধা-বিপত্তি আসুক না কেন, আমরা এগিয়ে যাবই। দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসাই আমাদের একদিন চূড়ান্ত অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাবে। ফেলে আসা বছরে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছি। আবার পাশাপাশি রয়েছে অনেক দুঃখজনক-স্মৃতি। যেসব স্মৃতি আমরা ভুলে যেতে চাই। সেসব ঘটনা যেন আর কোনোদিন আমাদের মঙ্গলকে স্পর্শ করতে না পারে সে দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

বড় রাজনৈতিক শক্তির ভেতর টানাপড়েন থাকলেও শেষ পর্যন্ত দেশের ছোট বড় সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এটা আমাদের জন্য আশার। কারণ গত নির্বাচনে বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিমত দেখিয়ে অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। তাই এই নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ আছে বলেই আমরা কিছুটা আশার আলো দেখতে পাই। এতে দেশের মানুষের মনে রাজনৈতিক ভারসাম্যেও আশার সঞ্চার হয়েছে। আর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। যখনই সব দল অংশগ্রহণ করে তখনই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই সবাই কাম্য।

চলতি বছর দেশে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেসব অস্থিতিশীল পরিবেশের নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। কঠোর হাতে দমন করছে সন্ত্রাসী হামলা। এদেশ কোনো সন্ত্রাসীর হাতে থাকবে না। এদেশ সন্ত্রাসী বা জঙ্গিগোষ্ঠীর নয়, এদেশ খেটে খাওয়া মানুষের। এদেশ হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। আমাদের কোনো সন্তান সন্ত্রাসী হবে না। তারা মানুষ হবে। তবে আমাদের কাছে সব থেকে চিন্তার বিষয় ছিল ছাত্রছাত্রীদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে যাওয়া। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত এসব তরুণ-তরুণীরা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িয়েছে। আমাদের এ ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা কেবল দেশ গড়ার কারিগর হয়েই বের হয়। দেশ যেন বিশ্বের সামনে মাথা উঁচু করতে পারে সে প্রচেষ্টাই করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের হবে একেকজন সম্পদ। কারণ বৃহৎ জনসংখ্যার এই দেশে মানুষই হলো বড় সম্পদ। প্রতিটি মানুষকে সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই এদেশ এগিয়ে যাবে দুরন্ত গতিতে।

বিগত বছরগুলোতে আমরা শিশু নির্যাতনের দুঃসহ চিত্র লক্ষ্য করেছি। শিশু ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ২০১২ সালে ২০৯ জন, ২০১৩ সালে ২১৮ জন, ২১৪ সালে ৩৬৬ জন এবং ২০১৫ সালে ২৯২ জন শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অপহরণের পর ১১১ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। ২০১২ সালে ৬৭ শিশু অপহরণের শিকার হয় , যার মধ্যে ১৭ জনকে উদ্ধার করা হয়। মোবাইল চুরির অপরাধে গাছের সাথে বেঁধে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছিল শিশু রাজনকে। তারপর তা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর একেক করে ঘটতে থাকে পাষবিক সব ঘটনা। এসব ঘটনাও মোবাইল দিয়ে ভিডিও করা হয়েছে। আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম নির্যাতনের ভয়ঙ্কর শিকার হচ্ছে শিশুরা। পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়েও কয়েকটি শিশুকে হত্যা এবং হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে। সামাজিক অবক্ষয়ের একটি রূপ হলো এসব নির্মম হত্যাকা-। আমাদের তরুণ সমাজকে বিপথে যাওয়া থেকে আটকাতে হবে। বিপথগামী তরুণ সমাজের কাছ থেকে দেশ কেবল খারাপ কিছু পেতে পারে। ভালো কিছু দুরাশা মাত্র।

আমরা আশা করি এদেশ সন্ত্রাসীদের নয়, এদেশ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের। এদেশ সবার। এদেশের মানুষ ক্রিকেটের মুস্তাফিজ, মাশরাফি, সৌম্যদের নিয়ে গর্ব করতে ভালোবাসে। পতাকা তুলে সারা মাঠ ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে। বিশ্বকে জানিয়ে দিতে ভালোবাসে আমরা দেশটাকে ভালোবাসি। গেল বছরে বাংলাদেশে ক্রিকেটের অসাধারণ সাফল্যে দেশবাসীকে উজ্জীবিত করেছে নতুন গৌরবে। কয়েক বছর ধলে চলতে থাকা উত্থান চোখে পরেছে গত বছরে। বাংলাদেশের ক্রিকেট আজ বাংলাদেশের অহঙ্কার। বাইরের দেশগুলো আজ তাকিয়ে দেখছে আমরা কারো অবহেলার নই। আমরা লড়াই করতে জানি। গত বছরে আমরা অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছি। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনের পর এখন আমরা এসডিজি (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) অর্জনের পথে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি একদিন আমরা সেই অর্জন অবশ্যই করব। খুব শিগগিরই আমরা শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশের প্রত্যাশা করতে পারি। আমাদের দেশে চাকরির নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়েছে প্রযুক্তির ছোঁয়ায়। তথ্যপ্রযুক্তিতে আমাদের দেশ এগিয়ে চলেছে। দেশের চলমান বেকার সমস্যার সমাধান হবে তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরেই। ইতোমধ্যেই দেশে বহু ফ্রি ল্যান্সার তৈরি হয়েছে যারা ঘরে বসেই তাদের চাকরির কাজটি করে চলেছে। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ আজ এক মডেলের নাম। অবকাঠামোগত উন্নয়নেও আমরা এগিয়ে চলেছি। স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান। সড়ক যোগাযোগ, রেল যোগাযোগে উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে চলেছি। কিছু কিছু ঘটনা সাময়িক সমালোচনার জন্ম দিলেও তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ফলে সে ঘটনা সেখানেই থেমে যাচ্ছে।

সবচেয়ে বড় সত্যি হলো এদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ। মাঝে মধ্যে এই অসাম্প্রদায়িক দেশটাতে কিছু উগ্র মানুষ তাদের উগ্রতা তাদের হিংসাকে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সফল হয় না। কিছু মানুষের জন্য আমরা সবাইকে দোষ দিতে পারি না। এদেশ বহুকাল আগে থেকেই হিন্দু মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের মানুষের শান্তিতে বাস করার জায়গা। এখানে কোনো হিংসা থাকবে না। থাকবে হাতে হাত রেখে কাজ করে যাবার প্রত্যয়। সেই প্রত্যয় থেকে বলছি সংখ্যালঘুদের ওপর আর কোনো হামলা যাতে না ঘটে, সবাই যাতে শান্তিতে বসবাস করতে পারে তার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তাদের ওপর হামলা, তাদের বাড়িঘরে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটতে দেয়া যাবে না। আমরা থেমে থাকব না। আমরা এগিয়ে যাবই দুর্বার গতিতে। আমদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে, মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। আমাদের শোষণ নির্যাতন করা পাকিস্তান পর্যন্ত আমাদের সফলতাকে আজ উদাহরণ টানে। এটাই বাংলাদেশ আর আমরা সেই এগিয়ে যাওয়া দেশটার মানুষ। আমরা গর্বিত। আমরা বাংলাদেশের মানুষ সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে চাই, আমরা সবাইকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে চাই।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নির্বাচন,নতুন বছর,ভাবনা,কলাম
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close