ডা. এস এ মালেক

  ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

জনগণ কেন নৌকায় ভোট দেবে

কেন জনগণ নৌকায় ভোট দেবে? এ প্রশ্নের উত্তর খুবই সহজ। এ দেশের ইতিহাস এর জবাব দিয়েছে। ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বাংলার মানুষ নৌকায় ভোট দিয়ে সরকার গঠন করে তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাকিস্তানি সরকারকে জানিয়ে দিয়েছিল পূর্ব বাংলার মানুষ স্ব-শাসন চায়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনের কর্তৃত্ব তাদের পছন্দনীয় নয়। অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রশ্নে পূর্ব বাংলার জনগণ যে স্বতন্ত্রবোধ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে শাসনকার্য পরিচালনা করেছিল তাতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ভীত হয়ে ’৫৮ সালের সামরিক শাসন জারি করে তার মোকাবিলা করে। পাকিস্তানের সংবিধানে তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠন করেছিল এবং তখন সংবিধানের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল তাকে বানচাল করার জন্য স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান নানা ছক আঁকে।

যুক্তফ্রন্ট সরকার ২১ দফাভিত্তিক যে শাসন প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন তা ছিল সু-শাসন। এই ২১ দফার বেশ কয়েকটি দফার পরবর্তীতে ৬ দফার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সুতরাং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে স্বায়ত্তশাসনের দাবি সংশ্লিষ্ট করা হয়েছিল। নৌকায় ভোট দেয়ার কারণে এটা সম্ভব হয়েছিল। তারপর...; নৌকায় ভোট দেয় জনগণ ১৯৭০ সালে। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্যই ১৯৭০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেই নির্বাচনে ৬ দফাকে ম্যানডেট হিসেবে ব্যবহার করে পূর্ব বাংলার ১৬৯টি আসনের ভেতর ১৬৭টি আসন নৌকায় ভোট দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে একচ্ছত্রভাবে বিজয়ী করে গোটা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ করে দেয়। বঙ্গবন্ধু জানিয়ে দেন, তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব চান না। তিনি বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে চান। ফলে পাকিস্তান বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সেই ঘোষণাভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধ শুরু। ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়। নৌকায় ভোট দেয়ার কারণে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের একচ্ছত্রভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। তাই নৌকায় ভোট দেয়া হয়েছিল বলেই ৭৩-এর নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম সংসদীয় সরকার গঠন করা হয়।

আসলে ৭৫ থেকে ৯৬ পর্যন্ত এমন কোনো ভোট পর্ব অনুষ্ঠিত হয়নি যেখানে স্বাধীনভাবে নৌকায় ভোট দিয়ে জনগণ সরকার গঠন করতে পারত। ১৯৯৬ সালে গণআন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা আবার নৌকায় ভোট দেয়ার অধিকার আদায় করেন এবং সেই সুবাদে বাংলার জনগণ তাকে প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত করেন। প্রথমবার ক্ষমতারোহণ করেই তিনি পঁচাত্তরের বাংলাদেশ যে প্রতিবিপ্লবী ধারায় পরিচালিত ছিল তিনি তা থেকে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় ফিরিয়ে আনেন। শুরু হয় উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা। মাত্র ৫ বছরে তিনি বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে দেন। কিন্তু ২০০১ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এক গভীর চক্রান্তের কারণে নৌকা পরাজিত হয়। ২০০১-০৮ পর্যন্ত বাংলাদেশ আবার প্রতিবিপ্লবের ধারায় ফিরে যায় ২০০৮ সালের গণ রায়ে আবার নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ক্ষমতাসীন হন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় আছেন। আর এই ১০ বছরে মানুষ স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছে নৌকায় ভোট দিলে তাদের প্রাপ্তী ঘটে। জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় ও তাদের কল্যাণ সাধিত হয় আর নৌকায় ভোট না দিলে বিপর্যয় ঘটে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে বিগত ১০ বছর হচ্ছে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে উন্নয়নের এক দশক। একটা স্বাধীন দেশের উন্নয়ন বলতে যা বোঝায় তা সর্বক্ষেত্রে তিনি সফল রাখতে সক্ষম হয়েছেন। মাত্র ১০ বছর আগে ২০০৮ সালে আর্থসামাজিক বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল কোথায়। আর আজ সেই অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, আমরা নি¤œ আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। এরপরে দুই দশকে আমরা উন্নত দেশে পরিণত হবো। আজ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের আয় ১ হাজার ৭০০ ডলার। জিডিপি ৭.৮ মুদ্রাস্ফীতি ৫.৬ বাৎসরিক বাজেটে ৪ লাখ ৬৪ হাজার লাখ কোটি টাকা। শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষিতে আমরা ব্যাপক পরিবর্তন এনেছি। বিশ্বসভায় আজ বাংলাদেশ সমাদৃত। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের অন্যতম প্রধান নেত্রী। নৌকায় ভোট দেয়ার কারণে এটা সম্ভব। বাংলাদেশ আজ উদীয়মান ব্যাঘ্র। স্বাধীনতার সময় দেশটি পৃথিবীর দরিদ্রতম ১০টি রাষ্ট্রের তালিকায় ছিল। বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক দেশ মন্তব্য করেছিল, দেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। সেই অবস্থা আজ আর নেই। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি দেখে বিশ্বের প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদরা মন্তব্য করছেন উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২০তম অর্থনৈতিক শক্তিধর রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করবে।

সুদীর্ঘ সময় পর আবার নৌকায় ভোট দেয়ার সুযোগ এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে এবার জনগণ নৌকায় ভোট দেবে কেন? এর উত্তর খুব সহজ। চারদিকে তাকিয়ে দেখুন, তাকান আকাশের দিকে, তাকান সমুদ্রের দিকে এবং বাংলার জনগণের দিকে। সবকিছু বলে দেবে কেন জনগণ নৌকায় ভোট দেবে। ভোট দেবে এ কারণে উন্নয়নের গতি অব্যাহত রাখতে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। তিনি তার কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন দক্ষ, প্রাজ্ঞ, সৎ নিবেদিত প্রধানমন্ত্রী, দেশ পরিচালনায় সুদক্ষ কারিগর। জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে সক্ষম। তিনি এদেশের জনগণের একমাত্র ভরসাস্থল। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণ সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম। এদেশের কৃষক, শ্রমিক তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ভবিষ্যতে আরো টেকসই উন্নয়ন প্রতিষ্ঠিত করতে হলে, শেখ হাসিনাকে আবারো ভোট দিয়ে ক্ষমতায় রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর মতো তার কন্যা গরিব-অসহায় ভূমিহীন মানুষের দিকে। তার দৃষ্টি আকর্ষিক বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দিকে। শিক্ষা ব্যবস্থায় তিনি আমূল পরিবর্তন এনে প্রতিটি স্কুলে বিনামূল্যে বছরের প্রথম সপ্তাহেই ৩৮ কোটি বই বিতরণ করেছেন। গ্রামের গরিব-দুঃখী মানুষের স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ করে দিয়েছেন। অন্তঃসত্ত্বা নারীরা ভাতা পায়, বিধবা ভাতা পায়, বয়স্ক ভাতা পায়, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পায়। দেশের নিপীড়িত জনগণকে এর পূর্বে আর কোনো সরকার সাহায্য করেনি। তাই জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হলে শেখ হাসিনাকে আবার ভোট দিয়ে চলমান উন্নয়নের গতিকে সচ্ছল রাখতে হবে। নৌকায় ভোট দিলেই শেখ হাসিনা জয়-যুক্ত হবেন আর জয়যুক্ত হলেই তার কাক্সিক্ষত সোনার বাংলা দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

চারদিকে দেখেশুনে মনে হচ্ছে জনগণ নৌকায় ভোট দেয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া। বাধা হচ্ছে ষড়যন্ত্র। যে গভীর চক্রান্তের জাল মানুষকে বার বার বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে, সে চক্রান্ত এখনো চলছে। ষড়যন্ত্র সন্ত্রাসী চক্রের, ষড়যন্ত্র আইএসএর, ষড়যন্ত্র দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী, ষড়যন্ত্র আন্তর্জাতিক চক্রের। যারা বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট নয়, তলাবিহীন ঝুড়ি বলে গালি দেয়ার অবস্থায় যারা বাংলাদেশকে দেখতে চেয়েছিল। একটা সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তার সবকিছুই সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার ক্ষমতায় থাকলেও তার ব্যবহার করছেন না। সব দায়িত্ব ইসির ওপর দেয়া হয়েছে। প্রধান ইসি বলেছেন নির্বাচনী পরিবেশ ঠিক আছে, নির্বাচনী হাওয়ায় সুবাতাস বইছে। জনগণের পছন্দমতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করে একটি নির্বাচিত সরকার গঠনের সময় এসেছে। তার অভিমত তারই কমিশনার বিতর্কিত করেছেন। অন্যদিকে সেই আদি কৌশল গোয়েবলসের কায়দায় বার বার মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করবার অপচেষ্টা। একেকবার একেক কথা বলা হচ্ছে। পুলিশ, প্রশাসন দিয়ে নির্বাচন করবেন, নির্বাচনে কারচুপি হবে, সাধারণ লোকেরা ভোট দিতে পারবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। নির্বাচন সম্পর্কে তারা যা দাবি করেছেন সরকার তাই মেনে নিয়েছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে সরকার, প্রশাসন, আ’লীগ সব এক হয়ে তাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে।

প্রশাসন তো আর আ.লীগের নয়, তাই প্রশাসন যারা পরিচালনা করে তারা যদি সবাই আপনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকে তাহলে ভাবুন তো কেন এই অবস্থা। রাষ্ট্রের প্রতি যদি আস্থা থাকে তাহলে প্রশাসন আপনাদের পক্ষাবলম্বন করতে পারে। যেহেতু স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভিন্ন রূপ দিতে চাচ্ছেন। যার কারণে প্রশাসন বিভাগ আপনাদের ক্রিয়াকলাপ পছন্দ করেন না। এটা কোনো দলের প্রতি সমর্থন নয়। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখা প্রয়োজন, আজ প্রতিটি মানুষ তা উপলব্ধি করছে। তাই রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যদি আপনাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকে তাহলে আপনারাই দায়ী। আ.লীগ রাষ্ট্র নয়, রাষ্ট্র একটা পৃথকসত্ত্বা। সেখানে সবার অধিকার রয়েছে। যদি কেউ সে অধিকার অপব্যবহার করে তাহলে রাষ্ট্রপক্ষ কীভাবে তাদের পক্ষে থাকবে। তাই আগামী নির্বাচনে বিএনপি এবং ড. কামালের যে বিবৃতি তাতে মনে হয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন কি না, কে জানে। যাকে তারা পক্ষপাতিত্ব বলে অভিহিত করছেন। পুলিশের দায়িত্ব পালনে নির্বাচনকালীন হত্যা করা হবে, বোমাবাজি করা হবে, সন্ত্রাসী তৎপরতা চলবে। উদ্দেশ্য একটাই নির্বাচনের রায় অগ্রহণযোগ্য করা। এরূপ বাস্তবতায় রাষ্ট্রযন্ত্র নীরব থাকবে কি করে। পুলিশ, বিজিবি নেমেছে, গতকাল থেকে আর্মিও নেমেছে। সবাই তো মাঠে নেমে কাজ করবে। এরপরেও বিএনপি রাষ্ট্রের ওপর আক্রমণাত্মক হচ্ছে কেন। আস্থাহীন হওয়ার কারণে যে পথে তারা এগোচ্ছেন সে পথ জনগণের নয়। ষড়যন্ত্রের পথ হলো, উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রতিরোধের পথ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করার পথ, ওই পথে মানুষ যেতে চায় না।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জনগণ,নৌকা,ভোট,নির্বাচন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close