রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৭ জুলাই, ২০১৮

রেল ও আমাদের যাত্রীসেবা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশে দেশে সড়কপথের বিস্তার ঘটেছে। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু রেলওয়ের মাধ্যমে একসময় বেশি পরিমাণ মালামাল পরিবহনের সুবিধা, যানজট সমস্যা না থাকায়, ভূমির পরিমিত ব্যবহার, জ্বালানি খরচ সাশ্রয়, নিরাপদ যাতায়াত এবং অপেক্ষাকৃত কম পরিবেশ দূষণ করার কারণে পৃথিবীজুড়ে সব দেশেই রেলকে আবার গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেওয়া শুরু হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে এই খাতটি এখনো পর্যন্ত অবহেলার মধ্যে রয়েছে। প্রাচীন এই যোগাযোগমাধ্যমটিকে ব্যাপক দরিদ্র জনগোষ্ঠী, শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে কীভাবে টিকিয়ে রাখা যায় এবং আধুনিক ও যুগোপযোগী করা যায়, সেই লক্ষ্যে ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ প্রত্যেকের নিজস্ব অবস্থান থেকে কাজ করা অত্যন্ত জরুরি এবং এ দাবির পক্ষে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সমর্থন তৈরি আজকের সময়ের প্রথম দাবি। যেকোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা তথা দীর্ঘস্থায়ী এবং নিরাপদ যাতায়াতের ক্ষেত্রে রেলের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবেশবান্ধব, জ্বালানি সাশ্রয়ী নিরাপদ যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে রেল একটি জনপ্রিয় পরিবহন। আমাদের সীমিত সম্পদ, জনসংখ্যার আধিক্য, নিম্ন আয় ও কৃষিনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থায় রেলের গুরুত্ব ব্যাপক।

রেলব্যবস্থাকে ভারত উপমহাদেশের ক্ষেত্রে বলা হয় আধুনিকতার পথে প্রথম পদক্ষেপ। শিল্পায়ন, নগরায়ণ, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও এ দেশের আর্থ-সামাজিক অচলায়তনের ধারা ভেঙে পুঁজি ও শিল্পনির্ভর সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণে রেলওয়ে পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অর্থাৎ পুরো সমাজ জীবনে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে রেলপথের সুবাদেই। সেই ধারাবাহিকতায়ই ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার দর্শনা জগতী সেকশনে ৫৩ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপনের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের এ অঞ্চলে রেলের গোড়াপত্তন। শুরু থেকেই রেল এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নে পালন করছে যুগান্তকারী ভূমিকা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ২০০ বছরের শাসনকাল থেকে যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে রেলপথ ছিল কেন্দ্রীয় ভূমিকায়। এরই মধ্যে ঘটেছে শিল্পায়ন, নগরায়ণ, বেড়েছে জনসংখ্যা। তার সঙ্গে সংগতি রেখে বেড়েছে জনগণের চাহিদা, সড়কপথের ঘটেছে অভূতপূর্ব বিস্তার। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমাদের শহর জীবন হয়েছে জনাকীর্ণ, অতি যান্ত্রিকতায়পূর্ণ এবং এখানে জনসংখ্যা বেড়েছে অতিমাত্রায়। ফলে সড়কপথের ওপর পড়ছে অতিরিক্ত চাপ, প্রাইভেট গাড়ির আধিক্যও কম নয়। গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে ঠিক কিন্তু দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে তালে তাল মিলিয়ে।

পরিবহনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে কিছু সামাজিক দায়-দায়িত্বও পালন করতে হয়, যা রেলওয়ে ছাড়া আর কোনো মাধ্যমে এত সহজে করা সম্ভব নয়। যেমন রেলওয়েকে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্য এবং যাত্রীকে অতি স্বল্পমূল্যে পরিবহনে সাহায্য করতে হয়। অনেক সময় লাভজনক নয়, এমন লাইন চালু রাখতে হয় দেশের জনগণের যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত করতে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোনসহ যেকোনো দুর্যোগকবলিত এলাকার মানুষের সাহায্যার্থে ত্রাণ ও পুনর্বাসনসামগ্রী নামমাত্র মূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হয়। কখনো কখনো বিনামূল্যেও সরবরাহ করা প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয় সামরিক বাহিনীর মালামাল সাধারণ মূল্য অপেক্ষা কমমূল্যে আনা-নেওয়া করা। যে সুবিধা অন্য কোনো মাধ্যম থেকে পেতে হলে আরো অনেক বেশি অর্থলগ্নি করা প্রয়োজন হবে। তার পরও রেলওয়ের মতো সুবিধা পাওয়া সম্ভব হবে না।

রেলওয়ে দেশের সেবা খাতগুলোয় যে সুবিধা দিয়েছে, তার যদি একটি আর্থিক মূল্যায়ন আমরা দাঁড় করাই, তাহলে দেখা যাবে, রেল কোনোদিনই অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল না। রেলের একটি কামরায় অনেক মানুষ যাতায়াত করতে পারে। এখানে পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে একটি আন্তরিক পরিবেশে যাতায়াত করা যায়। আবার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষও একই কামরায় থাকে। তাদের মধ্যে ভাববিনিময় হয়, আদান-প্রদান হয় সংস্কৃতির। গড়ে ওঠে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং পারস্পরিক সহমর্মিতাবোধ, যা একটি মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সুতরাং দেশের জনগণের স্বার্থে এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই রেলওয়েকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। রেলওয়ের সমস্যা অনেক। একদিকে সময় বেশি লাগে, সাটার লাগে না, বাথরুম অপরিষ্কার, সিটগুলো ময়লা, ছেঁড়া, ফাটা, জানালা নেই, পরিবেশ নোংরা। এসব হয়েছে দীর্ঘদিনের অবহেলার কারণে। বড় বড় কর্তারা লুটপাট করে এর ব্যবসা নষ্ট করে দিচ্ছে। তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করে না। কোথায় কী প্রয়োজন সেসব খেয়াল রাখে না। ফলে জনগণের এ বাহনটি ক্রমেই অজনপ্রিয় একটি বাহনে পরিণত হচ্ছে।

ইতোমধ্যে পৃথিবীজুড়ে রেলওয়ে এক শক্তিশালী ও সম্ভাবনাময় পরিবহন মাধ্যম হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। আমাদের দেশেও এর ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনাকে জাতীয় স্বার্থেই বাস্তবায়ন করতে হবে। তার জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো, দক্ষতার সঙ্গে ট্রেনের সময় ব্যবস্থাপনা করা, সেবার মান বৃদ্ধি করা, সর্বস্তরের দুর্নীতি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া ও টিকিট চেকের ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করা, দক্ষ লোকবল বৃদ্ধি করা, পর্যায়ক্রমে ঢাকার কাছাকাছি জেলাগুলোয় ট্রেনের যোগাযোগ সম্প্রসারিত করা আজ গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। ওপরের সব উদাহরণ টেনে এক কথায় যদি বলি, দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত এবং জ্বালানি সংকট নিরসনে রেলব্যবস্থার উন্নয়ন খুবই জরুরি। রেলব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া হলে আপামর জনসাধারণের যাতায়াত ব্যবস্থা আরো সর্বজনীনতা অর্জন করবে।

উল্লেখ্য, রেল সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষিজাত, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে উৎপাদিত পণ্য কম খরচে ও সহজে বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের সার্বিক যাতায়াতের ক্ষেত্রে রেল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে গণ্য হবে। ফলে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু ও পরিবেশ দূষণ কমে আসবে। রেলব্যবস্থার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। গ্রাম এবং শহরের সঙ্গে চমৎকার সমন্বয় হবে। আমরা রেলকে পাব যোগাযোগের একটি সুন্দর মাধ্যম হিসেবে এটাই জাতির প্রত্যাশা। আজকের যে বৈশ্বিক বাস্তবতা সেখানে বিশ্বের উন্নত, অনুন্নত দেশগুলো ব্যাপক জনগোষ্ঠীর যোগাযোগ সুবিধার জন্য সেবা খাত হিসেবে রেলওয়েকে চিহ্নিত করা হয় এবং এর উন্নয়নের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করছে প্রতিনিয়তই। সেখানে আমাদের দেশে রেলব্যবস্থাকে বেসরকারীকরণের চিন্তাভাবনা চলছে। অথচ রেলযাত্রীর ৯৮ ভাগ স্বল্প আয়ের মানুষ। শুধু তাই নয়, এ ব্যবস্থাটি দরিদ্র মানুষদের জীবিকার্জনের মাধ্যমও বটে। এ রকম বাস্তবতায় রেলওয়েকে বেসরকারীকরণ ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে সেবা থেকে বঞ্চিত করার জন্য এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের আর একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো এর অধিকাংশ যন্ত্রাংশ এখনো বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। এমনকি এই যন্ত্রাংশগুলো নষ্ট হলে মেরামতের জন্যও বিদেশের ওপর নির্ভর করতে হয়। রেলওয়ের প্রত্যেকটি যন্ত্রাংশই দামি। এগুলো যদি বারবার পরিবর্তন করতে হয় বা মেরামতের জন্য বাইরের দেশের প্রতি নির্ভরশীল হতে হয় কিংবা আমাদের সীমিতসংখ্যক ট্রেনের মধ্য থেকে কোনো ট্রেন বন্ধ রাখতে হয়, তাহলে এর বিস্তার কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। অথচ আমাদের বিশাল জনবল থাকা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে নিজস্ব প্রযুক্তি গড়ে তোলার যে প্রচেষ্টা, সেখানে রয়েছে ঔদাসীন্য। সবশেষে যে বিষয়টি বলা দরকার তা হলো, রেলওয়ের যে আন্তঃবিভাগগুলো রয়েছে, তার মধ্যে সমন্বয়হীনতা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়, যা রেলওয়ে বিকাশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, আধুনিক উন্নয়ন চিন্তার কেন্দ্রীয় বিষয়গুলো হলো দীর্ঘস্থায়ী ও নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা।

লেখক : বিশ্লেষক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
যাত্রীসেবা,রেল,কলাম,ট্রেন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist