সম্পাদকীয়
অপরিমিত উন্মাদনা
উন্মাদনা এমন একটি শব্দ যার দুটো দিকই সমানভাবে শক্তিশালী। আমি ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকের কথা বলছি। আবেগের সূতিকাগার থেকে বেরিয়ে আসা এই শব্দটি একাধারে যেভাবে ধ্বংস করতে পারে, পারে নির্মাণও করতে। আমরা জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের অপরিমিত উন্মাদনা যেমন দেখেছি, দেখেছি ১৯৭১-এ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পরিমিত উন্মাদনা। অপরিমিত উন্মাদনা কেবল ধ্বংসকেই ডেকে আনতে পারে। আর পরিমিত উন্মাদনা ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে গড়ে তুলতে পারে মানবিক বোধের এক মহাপ্রাচীর। যে প্রাচীর আমরা গড়েছি একাত্তরে। নির্মাণ করেছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। আর এই রাষ্ট্র বিনির্মাণে পুঁজি বলতে আমাদের ব্লাড ব্যাংকে জমা ছিল একটি আবেগ। যাকে আমরা বলতে পারি, পরিমিত উন্মাদনায় গড়া আমাদের বোধ। যে উন্মাদনা আমাদের বোধকে ক্রমেই শাণিত করেছে। আমাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যারা আমাদের ৩০ লাখ স্বজনকে হত্যা করেছে তাদেরও উন্মাদনা ছিল, তবে সে উন্মাদনা ছিল নেতিবাচকতায় পরিপূর্ণ এবং অপরিমিত।
বিশ্বজুড়ে ফুটবলও মাঝেমধ্যে এই উন্মাদনায় আক্রান্ত হয়। আর বিশ্বকাপ ফুটবলকেই ঘিরে এই উন্মাদনা। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় সম্ভবত বাংলাদেশে এর মাত্রা বেশ কিছুটা বেশি। অন্যান্য দেশ বলতে যারা বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করেছে তাদের কথা আলাদা। তারা তাদের দেশের হয়ে উন্মাদনা দেখাতেই পারেন। মাঝেমধ্যে সেখানে অপরিমিতি বোধের প্রাদুর্ভাবও ঘটতে পারে। বিষয়টিকে আমরা শতভাগ নেতিবাচক নাও বলতে পারি। তবে যে সময় কোয়ালিফাই করেনি এমন দেশের সমর্থকরা যদি উন্মাদনায় আক্রান্ত হয় এবং তা হয়ে ওঠে নেতিবাচক... ; তখন!
তখন আর আমাদের বলার কিছুই থাকে না। বলার থাকে না বলেই বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনায় পুড়তে হয়েছে আমাদেরই ১০ স্বজনকে। যারা এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এরা সবাই তাদের প্রিয় দলের পতাকা ওড়াতে অথবা আরো ভালোভাবে ওড়ানোকে নিশ্চিত করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পর্শে আহত হয়েছেন। এদের একজন তৌহিদুল ইসলাম সুমন। বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রিয় দলের পতাকা ঠিক করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পর্শে তিনি এখন ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন। এরই মধ্যে তার দুটি পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। হাসপাতালের আইসিইউতে বসে সুমনের মা বলেছেন অপ্রিয় সত্যটি। তিনি তার কষ্টের কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, ‘আর্জেন্টিনা আমাদের কে? তারা কি আমাদের চেনে! তাহলে কেন এই উন্মাদনা!’
অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এই নেতিবাচক উন্মাদনা কারো জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। সুমনের মা একজন স্কুলশিক্ষিকা। তার উপলব্ধির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আমরাও বলতে চাই, ‘আমরা যেন পরিমিত উন্মাদনায় ফিরে আসতে পারি এবং অপরিমিতকে পরিত্যাগ করে নিজকে এবং সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারি।
পিডিএসও/হেলাল