সাইদুল ইসলাম শুভ

  ৩০ এপ্রিল, ২০১৮

সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কারা?

কিছুদিন পূর্বে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে বাসায় ফিরছিলাম। এমন সময় ফ্লাইওভারের খুব সংকীর্ণ স্থানে একটি লেগুনা আমাদের বাসকে ওভারটেক করে। লেগুনাটি এমনভাবে ওভারটেক করেছিল যে, মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটা সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র।

চালকদের ওভারটেকিং এর প্রবনতার কারনে প্রতিদিন ঘটছে নানারকম দুর্ঘটনা। কখনো একটি বাস আরেকটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দিচ্ছে, কখনো পাশ থেকে। দুই বাসের চাপায় দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে সাধারণ পথচারীরা। চালকদের এই বেপরোয়া মনভাবের একটি কারন রয়েছে। সেটি হল তাদের সময়ের বড় অভাব। কারন তাদের কাছে যত বেশি ট্রিপ, তত বেশি টাকা। তাই তারা দ্রুত যাত্রা শেষ করতে মরিয়া হয়ে থাকে। টাকার মোহে তারা সময়কে বেশ গুরুত্ব দেয়। তাহলে কি সাধারণ মানুষের জীবনের চেয়ে সময়ের মূল্য তাদের নিকট বেশি?

গত ১৬ই এপ্রিল দুইবাসের চাপায় ডান হাত হারানো রাজিব মারা গেলেন। কাকতালীয়ভাবে তিনি আমাদের এলাকাতেই থাকতেন। তার দুই ভাই এখানকার স্থানীয় তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসার ছাত্র। কথায় আছে অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়। তাদের পিতা-মাতা আগেই মারা গিয়েছিল। এবার পরিবারের একমাত্র অভিভাবক এবং উপর্জনক্ষম ব্যক্তি বড় ভাই রাজিবকে হারিয়ে দুই ভাই এখন নিঃম্ব। কিভাবে চলবে তাদের পড়ালেখা? কে নিবে তাদের ভরণ-পোষনের দায়িত্ব? ভেবেছিলাম রাজিবের অকাল মৃত্যুর পরে বাসচালকদের টনক নড়বে। তারা বাস চালানোর সময় একটু সাবধান হবেন। কিন্তু না, তা বোধ হয় আর হচ্ছে না। রাজিবের মৃত্যুর ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ২৮ এপ্রিল মারা গেলেন বাসের ধাক্কায় পা হারানো রোজিনা। এভাবে আর কত? আর কত লাশ পড়লে টনক নড়বে এইসব ঘাতক বাসচালকদের?

সড়ক দুর্ঘটনার এমন উদাহরণ নতুন কিছু নয়। প্রতি বছরই কয়েক হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনাতে মারা যায়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যান সমিতির রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনাতে নিহতের সংখ্যা ৭ হাজার ৩৯৭ জন এবং আহতের সংখ্যা ১৬ হাজার ১৯৩ জন। হতাহতের এই পরিসংখ্যানেই বোঝা যাচ্ছে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কতটা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। প্রতিবছরই দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যাটা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সড়ক দুর্ঘটনার জন্য তাহলে দায়ী কারা? অবশ্যই বেপরোয়া চালক। কিন্তু এটি একটি একতরফা ধারণা। সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু চালকই দায়ী থাকেন না। এজন্য ফিটনেসবিহীন গাড়ি, পথচারীদের অসতর্কতা, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করা, সড়ক নির্মানে ত্রুটি ইত্যাদি বহু কারন জরিত থাকে। তবে চালকদের ভূমিকাই এক্ষেত্রে বেশি। তাদের দ্রুত গন্তব্যে পাড়ি দেওয়ার আকাঙ্খা, অদক্ষতা, বিপদজনক ওভারটেকিং, খামখেয়ালীভাবে গাড়ি চালানো এসকল কারনে সড়ক দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। গাড়ি চালকদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে তারা গাড়ি চালাচ্ছেন, উড়োজাহাজ নয়।

রাজধানীতে যেসব লেগুনা চলাচল করে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় সেগুলো চালাচ্ছে কিশোর অথবা তরুণ চালক যারা প্রায়ই অদক্ষতার দরুন নানারকম দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। আবার শিশুরা সেসব লেগুনার হেলপার থাকে। তারা এমনভাবে লেগুনার পেছনের ফটকে ঝুলে থাকে যে, যেকোন সময় সেখান থেকে ছিটকে পরে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে। আবার যাত্রীরাও কম যান কিসে? তারাও বেশি তাড়া থাকলে হেলপারের সাথে বাদরঝোলায় অংশগ্রহন করেন। আগে দেখতাম কেউ কেউ বাসের ছাদে চড়ে যাচ্ছেন। এখন আর তেমনটা দেখি না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যাত্রীরা সচেতন হয়ে গেছেন। কিন্তু আসলে তা নয়। এখনো লোকাল বাসগুলোতে দেখা যায় যাত্রীরা এমনভাবে দরজার হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে যায় যে, একটু অসাবধান হলেই ছিটকে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

সড়কে আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, রাস্তা পার হওয়ার সময় পথচারীরা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করেন না। যদিও আলসেমির কারনে তারা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে চান না, কিন্তু যুক্তি হিসেবে তারা সময়ের অভাবকে দায়ী করেন। যেন ফুটওভার ব্রিজ পার হতে কয়েক ঘন্টা সময় ব্যয় করতে হয়। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যদি চালকদেরকে জরিমানা আরোপ বা মামলার আওতায় আনা হয়, তবে যেসব পথচারী সড়কে ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও তা ব্যবহার করতে চান না তাদেরকেও জরিমানার আওতায় আনা প্রয়োজন। কয়েক বছর আগে দেখেছিলাম ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করায় পুলিশ পথচারীদেরকে জরিমানা করছে। কিন্তু এখন আর সেই উদ্যোগের দেখা নেই। তাদের সকল উদ্যম-উৎসাহ ভেস্তে গেছে।

সড়কের দুইপাশে সাধারণ জনগনের চলাচলের জন্য ফুটপাত থাকে। একদল অতি চালাক মানুষ সেই ফুটপাতের জায়গাটুকুর পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিতের নিমিত্তে সেটি দখল করে ব্যবসা শুরু করে। তাহলে পথচারীরা হাটবে কোথায়? ফুটপাতের এই দখলদারিত্বের কারনে সাধারণ মানুষকে বাধ্য হয়ে ফুটপাত ছেড়ে রাস্তা দিয়ে হাটতে হয়। সেক্ষেত্রে থাকে দুর্ঘটনার ভয়। পেছন থেকে আবার কোন ব্যস্ত গাড়িচালক কখন ধাক্কা দিয়ে চলে যায়!

বেশ কয়েকবছর ধরেই দেখছি মাঝে মাঝে ফিটনেসবিহীন গাড়ি উচ্ছেদ নিয়ে বেশ জোরেশোরে অভিযান চলে। কিছুদিন পর আবার সেটা কোন এক অজানা কারনে থেমে যায়। আজও যখন সড়কে বের হই, এমনসব বাস চোখে পরে যেগুলো দেখলে বহুদিন ধরে রোগাক্রান্ত ব্যক্তিও বলবে আমি এই বাসের চেয়ে যথেষ্ট সুস্থ আছি। এসব বাস সড়কে কিভাবে চলাচল করতে পারে সেটা বেশ একটা গবেষণার বিষয়ই বটে। কর্তৃপক্ষ কি সেই গবেষণাকর্মটি ঠিকঠাক মত করছেন?

সড়ক নির্মানের ত্রুটি নিয়ে আর বেশি কিছু বলার নেই। ছয়মাস সাধারণ জনগনকে ভোগান্তি দিয়ে একটি রাস্তা সংস্কার হতে দেখেছি। তার ছয়মাস পরে সেটি জায়গায় জায়গায় ভেঙেও যেতে দেখেছি। সড়ক নির্মানে কোন পর্যায়ের ত্রুটি হলে ছয়মাসের মাথায় এভাবে একটি সড়ক ভেঙে যেতে পারে তা আমার জানা নেই। ভাঙা সড়কের খানাখন্দের কারনে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

মহাসড়কগুলোতে দুর্ঘটনার হার আরো বেশি এবং সেই দুর্ঘটনাগুলো অনেক বেশি ভয়াবহ হয়ে থাকে। কারন এসব দুর্ঘটনায় একসাথে হতাহতের পরিমান অনেক বেশি থাকে। কখনো দুটি বাস বা ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে, কখনো আবার সেগুলো উল্টে খাদে পরে যায়।

আমরা সড়ক দুর্ঘটনার বেশ কিছু কারন সম্পর্কে জানলাম। কিন্তু শুধু জেনে বসে থাকলেই চলবে না। এগুলো থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করতে প্রথমত, চালকদেরকে গাড়ি চালানোর সময় অনেক বেশি যতœশীল এবং সতর্ক হতে হবে। তারা গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে যত বেশি যতœশীল হবেন তত বেশি সড়ক দুর্ঘটনার হার হ্রাস পাবে। দ্রুত গন্তব্যে পাড়ি দেওয়ার আকাঙ্খা এবং ওভারটেকিং এর মানসিকতা থেকে বের হতে হবে। তাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যাত্রীদের এবং সড়কের পথচারীদের জীবনের দায়িত্ব সম্পূর্ণ তাদের উপর। তাদেরকে এই দায়িত্ব অবশ্যই সুষ্ঠুভাবে পালন করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। পথচারীদেরকে মনে রাখতে হবে সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। তাই যতই তাড়া থাকুক না কেন, অবশ্যই তাদের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করা উচিত। যেখানে ফুটওভার ব্রিজ নেই সেখানে রাস্তা পারাপারে অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। যাত্রীদেরকে বাস কিংবা লেগুনার দরজায় বাদরঝোলা হয়ে ঝুলে থাকার প্রবনতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কারন একটি বাস গেলে আরেকটি বাস আসবে। শুধু শুধু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝুলে ঝুলে যাওয়ার কোন মানে হয় না।

তৃতীয়ত, কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই পর্যবেক্ষণ করতে হবে যেন সড়কে কোন ফিটনেসবিহীন গাড়ি না থাকে এবং কোন অদক্ষ বা অনভিজ্ঞ চালক সড়কে গাড়ি নিয়ে বের না হতে পারে। এজন্য সড়ক নিরাপত্তা বাহিনী গঠন করা যেতে পারে। পথচারীদেরকে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করার জন্য জরিমানার আওতায় আনতে হবে। ফুটপাত দখলদারদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। মহাসড়কে দুর্ঘটনা এড়াতে গাড়ি চলাচলের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করতে হবে এবং সবাই যেন সেটি মেনে চলে তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। সড়ক নির্মান এবং সংস্কারের সময় অবশ্যই ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে সড়ক নির্মান করতে হবে যেন ত্রুটি এড়ানো সম্ভব হয়।

শিক্ষার্থী

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

পিডিএসও/রানা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist