আহমদ রফিক

  ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

বিস্ফোরক একুশে ফেব্রুয়ারি

একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল। পরিবেশ আপাতদৃষ্টিতে শান্ত। ফাল্গুনী ভোরের স্নিগ্ধতা সত্তে¡ও হল-হোস্টেলের ছাত্রদের মনে প্রবল চাপা উত্তেজনা এবং তা ভবিষ্যৎ ঘটনার অনিশ্চয়তার জন্য। আগের রাতে প্রধান ছাত্রাবাসগুলোর মধ্যে যোগাযোগের কারণে ছাত্রদের অজানা নেই, সকালে আর্টস বিল্ডিংয়ের আমতলায় নির্ধারিত ছাত্রসভার কথা। তারা জানে, সেখান থেকেই ১৪৪ ধারা ভাঙা শুরু হবে। ছাত্রসভার সিদ্ধান্ত নিতান্তই আনুষ্ঠানিকতা।

তাই সকাল ১০টার মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আমতলার আশপাশে, মধুর ক্যান্টিনে বিভিন্ন দিক থেকে ছাত্ররা দুজন-একজন করে জড়ো হতে থাকে। বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী সব। বাদ যায়নি স্কুলের ছাত্রও। ছাত্র এলাকায় সেদিন বাস, রিকশা চলছে না। ইতোমধ্যে সামনের রাস্তায় খাকি হাফপ্যান্ট পরা লাঠিধারী ও অস্ত্রধারী পুলিশ, গোটাকয় ট্রাক, পিকআপ ও জিপ রাস্তার ওপর দাঁড়ানো। আপাতদৃষ্টিতে ওরা নির্বিকার, কিন্তু বোঝা যায়, ওরা প্রস্তুত।

আমতলায় ছাত্রসভা শুরু বেলা এগারোটার দিকে ছাত্রনেতা গাজীউল হকের সভাপতিত্বে। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে শামসুল হক তার বক্তৃতায় ছাত্রদের বোঝাতে চেষ্টা করেন, ১৪৪ ধারা ভেঙে সরকারের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু উপস্থিত ছাত্ররা তাদের নিজস্ব যুক্তিতে অটল। তাই তারা বেশিক্ষণ শামসুল হকের যুক্তি ও বক্তব্য শুনতে চায়নি। বলতে গেলে তার দীর্ঘ বক্তৃতা বন্ধ করে দেওয়া হলো।

এরপর ছাত্রসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক আবদুল মতিন দু-চার কথা বলে ১৪৪ ধারা ভেঙে একুশের কর্মসূচি পালনের আহবানন জানান এবং ছাত্ররা সঙ্গে সঙ্গে তাকে সমর্থন জানায়। আবদুস সামাদ আজাদের প্রস্তাবমাফিক দশজনের ছোট ছোট গ্রুপে মিছিল করে ছাত্রছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রক্রিয়ায় রাস্তায় বেরিয়ে যাবে, লক্ষ্য পরিষদ ভবন-এমন সিদ্ধান্তের পর সভা শেষ।

স্লোগান উঠছে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, রাজবন্দিদের মুক্তিচাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’, ‘চলো, চলো অ্যাসেমব্লি চলো’। ইতোমধ্যে পুলিশি জুলুম শুরু হয়ে গেছে। টিয়ার গ্যাসে আমতলা প্রাঙ্গণে বাতাস ভারী ও ঝাঁজালো। ছাত্ররা সবাই পুলিশি তৎপরতায় উত্তেজিত।

এমন পরিস্থিতিতে ছাত্রছাত্রীদের দশজনের মিছিল বেশিক্ষণ নিয়ম মেনে চলতে পারেনি। তাই কে কার আগে ১৪৪ ধারা ভাঙবে, তাই নিয়ে একুশে সকালে ছিল অদ্ভুত এক প্রতিযোগিতা। স্বভাবতই কিছুটা বিশৃঙ্খলা। অন্যদিকে প্রথম দিকে বেরিয়ে আসা ছাত্রদের অনেককেই গ্রেফতার করে ট্রাকে তুলে নিয়েছে পুলিশ। এ প্রক্রিয়ায় পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে নির্বিচারে। ছাত্রীদের গ্রেফতার না করলেও তাদের কেউ কেউ লাঠির আঘাতে কিছুটা আহত হন।

পুলিশের প্রবল বাধা, লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপের কারণে ছাত্ররা আমতলা প্রাঙ্গণে দাঁড়াতে পারেনি, দাঁড়ানোর প্রয়োজন ছিল না। তাদের লক্ষ্য পরিষদ ভবন ঘেরাও। তাই অনেক ছাত্রই বিভিন্ন পথে মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে গিয়ে হাজির-পেছনের রেললাইন ধরে হেঁটে, ভাঙা পাঁচিল ডিঙিয়ে কিংবা খেলার মাঠের কাঁটাতারের বেড়ার ভেতর দিয়ে। আর পুলিশের লাঠির ব্যারিকেডের মধ্য দিয়ে রাজপথ ধরে অনেকে। আপাতত লক্ষ্য মেডিক্যাল হোস্টেল, যে হোস্টেলের অদ্ভুত নাম ‘মেডিক্যাল ব্যারাক’। অনেকটা পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাকের মতো। দেশভাগের পর সরকারি কর্মচারীদের জন্য তৈরি করা হয় সেনাছাউনির চেহারার অনেকগুলো বিশাল ব্যারাক-একই চেহারার মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রদের থাকার জন্য বড় বড় ছাউনি-তবে খুব বিশাল আকৃতির নয়।

পরিস্থিতি সম্পর্কে দৈনিক ‘আজাদ’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের কিছু অংশ- ‘সকাল ৯টা থেকে শহরের স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ও শহরে ১৪৪ ধারা জারির প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শান্তিপূর্ণ এ সভার আয়েজন করে। পরিষদের চলতি অধিবেশনে যোগদানকারী সদস্যদিগকে রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে জনগণের মনোভাব ওয়াকেফহাল করানোই এই সভার উদ্দেশ্য ছিল।’

‘আজাদ’-এ আরো লেখা হয় : ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সভা চলিতে থাকার সময় হইতে চতুর্দ্দিকে রাইফেলধারী পুলিশ মোতায়েন থাকিতে দেখা যায়। ... এই সময় পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। ফলে কিছুসংখ্যক ছাত্র রাস্তার অপর পাশে বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং কিছুসংখ্যক ছাত্রকে দৌড়াইয়া মেডিক্যাল কলেজের দিকে যাইতে দেখা যায়। রাস্তায় বাহির হইতেই ১৪৪ ধারা অমান্য করা হইয়াছে বলিয়া পুলিশ অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করে এবং ছাত্রদের সুদূর তেজগাঁয় লইয়া গিয়া ছাড়িয়া দেওয়া হয়। ৬২ জন ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করিয়া ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আটক রাখিয়াছে বলিয়া জানা যায়।’ (২২.০২.১৯৫২)

অন্যদিকে কলকাতার ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় সংক্ষেপে বলা হয় : ‘ছাত্রগণ ১০ জনের একেকটি দলে ১৪৪ ধারা অমান্য করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ ও মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে বাহির হইয়া আসে। অদ্য হইতেই এখানে ১৪৪ ধারা বলবৎ করা হইয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চতুর্দিকে পুলিশ মোতায়েন করা হইয়াছিল। তাহারা ছাত্রদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। শত শত ছাত্র রাস্তার উপর জামায়েত হয়’ ইত্যাদি (২২.০২.১৯৫২)।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এবং সামনের রাস্তায় ছাত্র-পুলিশ সংঘাত এবং ছাত্রদের অবিরাম ¯স্লোগান ও পরিষদ ভবনের সামনে পৌঁছানোর চেষ্টা সংহত রূপ নেয় তাদের মেডিক্যাল হোস্টেল প্রাঙ্গণে পৌঁছানোর পর। এটা ছিল পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের মোকাবিলার দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্ব পুলিশের হামলায় বিশৃঙ্খলভাবে শেষ হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। দুপুর বারোটার মধ্যেই ছাত্ররা হোস্টেল প্রাঙ্গণে পৌঁছে যায়। তাদের সঙ্গে কিছুসংখ্যক পথচারী ও সরকারি কর্মচারীও ততক্ষণে যোগ দেয়। তাদের অধিকাংশ রাস্তায় এবং খেলার মাঠের পশ্চিম কোনায় জড়ো হতে থাকে। তবে ছাত্রদের সবাই মেডিক্যাল হোস্টেল প্রাঙ্গণে।

এখান থেকে তারা সংঘবদ্ধভাবে পরিষদ ভবনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। অনবরত সেøাগান এবং যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে থাকে। ইতোমধ্যে পুলিশ বাহিনী তাদের পূর্ব-অবস্থান থেকে সরে এসে মেডিক্যাল হোস্টেলের সামনে গোটা ফুলার রোডজুড়ে অবস্থান নিয়েছে এবং পরিষদ ভবনে যাওয়ার পথে শক্ত ব্যারিকেড তৈরি করে রেখেছে।

সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদ তথা আইনসভার বাজেট অধিবেশন। শুরু হওয়ার কথা বিকেল ৩টায়। পরিষদ সদস্যদের কেউ কেউ বা দু-একজন মন্ত্রী এ পথ দিয়ে যাবেনÑএমন সঠিক ধারণা থেকেই ছাত্ররা যানবাহন অবরোধ করতে থাকে। ইতোমধ্যে ছাত্র ও পুলিশের মধ্যে কয়েক দফা ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি চলেছে। স্কুলছাত্রদের কেউ কেউ হোস্টেল থেকে ঢিল ছুড়েছে, পুলিশ পাল্টা ঢিল ছুড়ে জবাব দিয়েছে।

ছাত্রদের অনুমান ভুল ছিল না। মেডিক্যাল কলেজের কয়েকজন তরুণ ছাত্র ঠিকই হোস্টেলের ভেতরে নিয়ে আসে মানিকগঞ্জের এমএলএ আওলাদ হোসেন ও তার সঙ্গী স্থানীয় প্রতাপশালী রাজনীতিক রাজা মিয়াকে। উদ্দেশ্য, বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করানো, প্রৌঢ় আওলাদ হোসেনকে ছাত্রদের দাবি মেনে তবেই মুক্তি অর্জন করতে হয়। মন্ত্রী হাসান আলীকে পুলিশের বেদম লাঠিবাজির কারণে গাড়ি থেকেই নামাতে পারেনি ছাত্ররা।

হোস্টেল প্রাঙ্গণে টিয়ার গ্যাসের ঝাঁজালো ধোঁয়ার মধ্যে অবিরাম উচ্চারণ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’ ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’ ইত্যাদি। পুলিশের সুদৃঢ় বাধার কারণে ছাত্রদের সংঘবদ্ধ চেষ্টা সত্তে¡ও পরিষদ ভবনের সামনে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবু চেষ্টার বিরাম নেই। মাঝেমধ্যে ইটপাটকেল বৃষ্টি-উভয় দিক থেকেই।

বেলা বাড়ছে। দুই পক্ষেই উত্তাপ বাড়ছে। শুধু ¯স্লোগান নয়, হোস্টেলে স্থাপিত কন্ট্রোল রুমের মাইকে মেডিক্যাল ছাত্রদের অবিরাম ঘোষণা, সংগ্রামের আহবান, ছোট ছোট কথিকা ও কবিতা আবৃত্তি চলছে। লক্ষ করার বিষয়, এ পর্যায়ে ছাত্রদের তৎপরতা ছিল একেবারে স্বতঃস্ফ‚র্ত। বেলা যত বাড়ছে এদিকে ছাত্রদের, অন্যদিকে পুলিশের তৎপরতা একইভাবে বেড়ে চলেছে। টিয়ার গ্যাসের ঝাঁজে প্রাঙ্গণের বাতাস ঝাঁজালো। তা সত্তে¡ও অকুস্থলে জনসমাগম বাড়ছে। হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী অনেকেই হোস্টেল-প্রাঙ্গণের জনসংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করেছে।

পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার এমনই এক সংঘাতের পর্যায়ে বিকেল ৩টার কিছুক্ষণ পর বিনা প্ররোচনায় নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের বেশ কয়েক দফা গুলিবর্ষণ। যেমন হোস্টেলে সমাবেশের ওপর তেমনি রাস্তার এক কোণে দাঁড়ানো ছাত্রজনতার ওপর। অকুস্থলে উপস্থিত ঢাকার অবাঙালি জেলা ম্যাজিট্রেট কোরাইশ, সিটি এসপি মাসুদ, বাঙালি পুলিশ ডিআইজি ওবায়দুল্লাহ, এসপি মুহম্মদ ইদ্রিস, ডিএসপি সিদ্দিক দেওয়ান প্রমুখ। গুলিবর্ষণের সিদ্ধান্ত প্রশাসনের শীর্ষ-কর্মকর্তা সবাই মিলে নিয়েছিলেন।

পিডিএসও/মুস্তাফিজ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
একুশে ফেব্রুয়ারি,বিস্ফোরক
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist