সাবরিনা শুভ্রা

  ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

নির্যাতনের বৃত্তে গৃহকর্মী

গৃহপরিচারিকাদের ওপর নির্যাতন কোনো কোনো গৃহকর্ত্রী বা গৃহস্বামীর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তারাও যে মানুষ এ উপলব্ধিও হারিয়ে ফেলেছেন কেউ কেউ। বিশেষত শিশু গৃহপরিচারিকাদের ওপর নির্যাতন যেভাবে বাড়ছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। যৌন হয়রানির শিকার হওয়া তো নারী গৃহপরিচারিকাদের একাংশের জন্য নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমনকি শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। যারা শিশুদের ওপর কথায় কথায় নির্যাতন চালায়, তাদের মানসিক সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। নির্যাতন যেন তাদের কপালের লিখন। সামান্য ত্রুটি হলেই নির্যাতিত হতে হয়। তিনবেলা ভাত খেতে পাবে, শুধু এই আশায়ই সব নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। অথচ ওসব বাড়িতেই হয়তো একই বয়সী ছেলেমেয়ে আছে। এই গৃহকর্মীদের অনেকেরই ভালো বিছানায় ঘুমানোর অধিকার নেই। বাড়ির লোকদের সঙ্গে কথা বলা, টেলিভিশন সেটের সামনেও বসতে পারে না অনেকে। শিশু বয়সে যে কাজ করা সম্ভব নয়, এমন ভারী কাজও এসব শিশু গৃহকর্মীকে দিয়ে করানো হয়। ফলে তার স্বাভাবিক বেড়ে ওঠাটা বাধাগ্রস্ত হবে এবং তাদের অনেকেই পুষ্টিহীনতায় ভুগবে- এটাই স্বাভাবিক।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে এমন অসুস্থ মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। গৃহপরিচারিকা বিশেষত শিশু গৃহশ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের ক্ষেত্রে কেউই পিছিয়ে থাকছেন না। সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে যারা জড়িত, তারাও জড়িত হচ্ছেন নির্যাতনের মতো বর্বরতার সঙ্গে। বাদ যাচ্ছেন না ক্রীড়া জগতের নন্দিত খেলোয়াড়রা। মুখে যারা মানবাধিকারের বুলি আওড়ান তাদের অনেকের ঘর শিশু নির্যাতনের আখড়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী দেশে গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার। এদের এক বড় অংশকে প্রতিনিয়তই নির্যাতনের শিকার হতে হয়। দেশে শিশু শ্রমিকদের সুরক্ষায় আইন না থাকায় নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধে তা ভ‚মিকা রাখতে পারছে না। কোনো কোনো নির্যাতনের ঘটনায় নির্যাতকদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত আপসের চোরাবালিতে তা ঢাকা পড়ে যায়। গরিব গৃহপরিচারিকা ও শিশুশ্রমিকদের অভিভাবকরা মামলা চালিয়ে আরো হয়রানি হওয়ার চেয়ে আপস করাকেই স্বস্তিদায়ক বলে মনে করেন। গৃহপরিচারিকা ও শিশু গৃহশ্রমিকদের নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধে কড়া আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার।

আইন করে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা হলে নির্মমভাবে এত শ্রমিককে প্রাণ দিতে হতো না। তাই অবিলম্বে আইন করে এ শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সরকারের প্রতি জোর দাবি জানানো যেতে পারে। ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করেও বহু গৃহশ্রমিক নিস্তার পায় না। গৃহকর্তার কাছে অনেক গৃহশ্রমিক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। তার পরেও চাকরি হারানোর ভয়ে গৃহকর্তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারে না অনেক শ্রমিক।

আবার কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। নেহাত পেটের দায়ে পরের বাড়িতে কাজ করতে আসা শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক কর্মীরা গৃহকর্তা বা কর্ত্রীর বিচিত্র নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। শুধু আমাদের দেশের ভেতরেই নয়, আরব তথা গোটা মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক গৃহকর্মে নিয়োজিত রয়েছে। তাদের প্রায় আশি ভাগই নারী। তাদের মধ্যে অনেকেই নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি ও অত্যাচারের শিকার হচ্ছে। আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী তাদের অধিকার রক্ষা করা হচ্ছে না।

অতএব বাংলাদেশ সরকারকে যেমনিভাবে দেশীয় গৃহপরিচারীকাদের স্বার্থরক্ষা, অধিকার প্রতিষ্ঠা ও কল্যাণ সাধন করতে হবে, ঠিক একইভাবে প্রবাসী গৃহপরিচারীকাদেরও স্বার্থরক্ষা, অধিকার প্রতিষ্ঠা ও কল্যাণ সাধনে রাখতে হবে বলিষ্ঠ ভ‚মিকা। বিশেষ করে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার স্বার্থে আমরা চাই তাদের আইনি সুরক্ষা। উল্লেখ করা যায়, গৃহকর্মে যারা সহায়তা করেন, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় তাদের সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তারা কোনো কৃতদাস বা দাসী নয়। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় গৃহকর্মী বা পরিচারিকাদের বেতনভুক্ত স্টাফের মর্যাদা দেওয়া হয়।

আমাদের বাংলাদেশে এখনো এক শ্রেণির শিক্ষিত বিবেকবান সচ্ছল গৃহস্থ বা সম্ভ্রান্ত পরিবার আছেন যারা বাড়িতে কাজের ছেলে বা মেয়ে রাখলেও পরিবারের অন্য সদস্যদের চেয়ে খুব একটা পার্থক্য নির্ণয় করেন না। তবে এ দেশে অর্ধশিক্ষিত, বিবেকহীন, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নব্য ধনী ও মধ্যবিত্ত সংসারে গৃহকর্মীর ওপর বর্বর নির্যাতন অতিমাত্রায় দৃশ্যমান বিধায় এর সঙ্গে মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা কিংবা অনেকের অহংবোধের বিকারগ্রস্ততা থাকলেও থাকতে পারে। আবার পরিবার ও সমাজব্যবস্থা অন্য অনেক কিছুর মতো প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। এই ভাঙা-গড়ার ঘূর্ণাবর্তে এমন আরো অনেক সামাজিক সমস্যা দেখা দেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তবে আমাদের মতো দেশে গৃহশ্রমিকদের অবশ্যই আইনী সুরক্ষা দেওয়াটাই আজ সময়ের দাবি।

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
গৃহকর্মী,গৃহপরিচারিকা,গৃহকর্ত্রী,গৃহকর্মী নির্যাতন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist