গাজীপুরের টঙ্গীতে রেললাইনে অবৈধ বাজার ও বিনোদন কেন্দ্র বসায় দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে। এসব স্থানে আইনের কঠোর প্রয়োগ বা জন সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তেমন কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করছে না রেলওয়ে প্রশাসন। ফলে ক্রমশ বাড়ছে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর সংখ্যা। দিন দিন ভারি হচ্ছে এই তালিকা।

রেল সূত্র জানায়, গত ১০ জানুয়ারি টঙ্গীর পূর্ব আরিচপুর রেল ব্রিজসংলগ্ন এলাকা ও আরিচপুর গাজীবাড়ির রেললাইনে পৃথক স্থানে ট্রেনে কাটা পড়ে দুই নারী নিহত হন। এর কয়েকদিন পর ২২ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে টঙ্গী পূর্ব থানার মধুমিতা রেল ক্রসিংয়ে অটোরিকশা যাত্রীসহ পার হওয়ার সময় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা জয়দেবপুরগামী তুরাগ ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষে অটোরিকশা যাত্রী নুরে আলম নোমান (৮) নিহত হন। এসময় অটোরিকশাটি দুমড়ে-মুচড়ে যায় এবং এর চালক মফিজুল ইসলাম (৩০), আবদুল হাকিম (৩০) নাজমুল ইসলাম (১৬), অজ্ঞাত পুরুষ বয়স অনুমান (৪০)সহ চারজন গুরুতর আহত হন। এর কিছু দিন পর ১৩ মার্চ টঙ্গীর বর্নমালা এলাকার রেল গেট পার হওয়ার সময় সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হন আজাহারুল ইসলাম (৬৫) নামে কৃষি ব্যাংকের এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এভাবে হরহামেশাই টঙ্গীর আরিচপুর বউ বাজার, মধুমতী রেলগেট, বর্ণমালা রেলগেট ও হায়দাবাদ এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

টঙ্গী রেলওয়ে ফাঁড়ির তথ্য মতে, গত এক বছরে টঙ্গীর আরিচপুর বউ বাজার, মধুমতী রেলগেট, বর্ণমালা রেলগেট ও হায়দ্রাবাদ এলাকায় প্রায় ১৮ জন ট্রেনে কাঁটা পড়ে মারা গেছেন। এসব মৃত্যুর অধিকাংশ ঘটনা অসতর্কতার করণে ঘটেছে বলে জানান তারা।

সরেজমিনে দেখা যায়, টঙ্গীর বর্ণমালা ও আরিচপুর রেললাইন দুই জায়গাতেই প্রতিনিয়ত মানুষের উপচেপড়া ভিড় থাকে। বিশেষ করে বিকেল থেকে রাত অবধি এসব স্থানে লোকজনের সমাগম হয় বেশি। আরিচপুর এলাকার রেললাইনের উপর অবৈধ বাজার থাকায় সেখানে টঙ্গী ও উত্তরার সর্বসাধারণ বাজার করতে আসেন। হুটহাট ট্রেন চলে এলে লাইন থেকে সরে দাঁড়ানোর তেমন জায়গা পাশে না থাকায় ঘটে প্রাণহানির ঘটনা।

একই অবস্থা টঙ্গীর হায়দ্রাবাদ রেললাইন এলাকায়ও। প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত অবধি তরুণ-তরুণীরা এখানে এসে ভিড় জমায়। তাদের কেউ কেউ রেললাইনের উপর টিকটক ভিডিও বানাতে ব্যস্ত থাকেন। কেউ বা আবার যুগলবন্দি হয়ে লাইনের উপর রোমান্টিকতায় মশগুল থাকেন। রেললাইন থেকে একহাত পাশেই চটপটি-ফুচকার বেশ কিছু দোকান। এসব দোকানে চলে চটপটি-ফুচকার রমরমা ব্যবসা। মর্মান্তিক দুর্ঘটনার জন্য এটিও একটি অন্যতম কারণ বলে জানান এলাকাবাসী।

টঙ্গীর বর্ণমালার হয়াদ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা, ফরহাদ মিয়া বলেন, সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রেললাইনের উপর ভিড় জমান তরুণ-তরুণীরা। অনেক সময় লাইনের উপর হাঁটাহাঁটি করেন। টিকটক ভিডিও বানান। অসতর্ক সময়ে ঘটে যায় রেলে কাটা পড়ে মৃত্যু।

হায়দ্রাবাদ এলাকায় ঘুরতে আসা ইউসুফ আহমেদ নামের একজন বলেন, পড়ন্ত বিকেল আর পাশেই বিল, আর রেল লাইনের ধার ঘেঁসে চটপটি-ফুচকার দোকান। সব মিলিয়ে এই জায়গাটি এখন পর্যটনকেন্দ্রের মতো মনে হয় সবার কাছে। বিকেলের সুন্দর সময় উপভোগ আর সূর্যাস্ত দেখতে প্রিয় মানুষের সঙ্গে এখানে এসেছি। সব মিলিয়ে এখানকার পরিবেশ আমাদের কাছে অনেক প্রিয়। এখানে যান্ত্রিক শহরের কোলাহলমুক্ত পরিবেশ পাওয়া যায়। তাই এখানে ছুটে আসি। যদিও জানি, এখানে মৃত্যু ঝুঁকি অনেক বেশি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) গাজীপুর মহানগর শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরিফ চৌধুরী বলেন, প্রতিনিয়ত হায়দ্রাবাদ রেল গেট, টঙ্গীর আরিচপুর রেলগেটে প্রাণহানির ঘটনা বাড়ছে, তাই এখন থেকেই সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশাসন ও সামাজিক সংগঠনগুলোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। তা না হলে ক্রমশই মৃত্যুর তালিকা বড় হতে থাকবে। আমাদের সবার উচিত, জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করা।

টঙ্গী রেলওয়ে ফাঁড়ির ইনচার্জ নূর মোহাম্মদ বলেন, জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। তবুও এসব এলাকার মানুষ চলাফেরার ক্ষেত্রে উদাসীন। গণমাধ্যমের মাধ্যমে সবাইকে অনুরোধ করবো রেললাইনে চলা ফেরার ক্ষেত্রে বিশেষ সর্তকতা অবলম্বন করার জন্য।

উল্লেখ্য, শুক্রবার চট্টগ্রামের মীরসরাই লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় ১১ শিক্ষার্থী নিহত হয়। এর ঠিক পাঁচ দিন আগে গাজীপুরের শ্রীপুর লেভেল ক্রসিংয়ে রেলের ধাক্কায় প্রাণ যায় ৪ শ্রমিকসহ ৫ জনের। তার ৩ দিন আগে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী কাগদি লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের নিচে ভটভটি চলে গেলে নিহত হন ৫ দিনমজুর। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে লেভেল ক্রসিংয়ে ২১ জনের মৃত্যু। আর সেভ দ্য রোডের তথ্য মতে চলতি বছর রেলপথে ১ হাজার ৫২টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৭৮ জন এবং আহত হয়েছেন ১১৭০ জন।