মো ঃ শাহ আলম, খুলনা

  ১১ মে, ২০২২

অতিরিক্ত চাষাবাদই কাল হলো খুলনার তরমুজ চাষিদের!

দরপতনে মাঠেই পচছে তরমুজ!

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

গেলবছর তরমুজের দাম ভালো পাওয়ায় এ বছর অনেকে বেশি জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন খুলনার কৃষকরা। কিন্তু এবার হঠাৎ দরপতনে বেশ ক্ষতিতে পড়েছেন তারা। এদিকে, দাম না পাওয়ায় মাঠেই পচে যাচ্ছে রসালো ফল তরমুজ।

হঠাৎ দরপতনে তরমুজ নিয়ে স্বপ্ন দেখা চাষিদের চোখেমুখে হতাশার ছাপ। এদিকে ঘূর্ণিঝড় অশনি চোখ রাঙাতে শুরু করায় বেশির ভাগই খরচের টাকা তুলতে পারা না পারাটা এখন ছেড়ে দিয়েছেন ভাগ্যের ওপর।

পানির দরে তরমুজ, নীরবে চোখের পানি ফেলছেন দরিদ্র কৃষকরা। এ বছর বাম্পার ফলন হওয়ার পরও বিক্রি করতে না পেরে এখন দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন কৃষকরা।

ক্ষেতে তরমুজের কোনো ক্রেতা নেই। তাই বেচা-বিক্রিও বন্ধ। ক্ষেতে বিক্রি করতে না পারায় কৃষকরা তরমুজ নিয়ে ঢাকায় ও খুলনায় আসছেন। কিন্তু সেখানেও কাঙ্খিত দাম মিলছে না। এ কারণে জেলার দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটার কৃষক সর্বশান্ত হতে চলেছে।

কৃষক মনোতোষ রায় বলেন, বড় ক্ষতি হয়েছে গত বছরের দাম। গত বছর এমন দামে বিক্রি হয়েছিল যে এবারও আমরা ভেবেছিলাম, ভালো দাম পাব। এ জন্য প্রথম দিকে কম দামে আমরা খেত ছাড়িনি। এখন তো ওই টাকাও পাওয়া যাবে না।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের তথ্য মতে, ২০২১ সালে এ জেলায় সাত হাজার ৫১২ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়। লাভজনক হওয়ায় এ বছর ১৩ হাজার ৯৭০ হেক্টর জমিতে এর চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয় প্রায় সোয়া চার লাখ টন তরমুজ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাকোপে সাত হাজার ৬২৫ হেক্টরে। এছাড়া বটিয়াঘাটায় তিন হাজার ৬শ’, পাইকগাছায় এক হাজার ৫১০, কয়রায় ৮৯৫, ডুমুরিয়ায় ৩৫০, রূপসায় পাঁচ, তেরখাদায় তিন ও ফুলতলা উপজেলায় এক ও মেট্রো থানায় আরও এক হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে। কিন্তু ভালো দাম না পাওয়ায় এখন পর্যন্ত ৪০ ভাগ জমির তরমুজ মাঠেই পড়ে আছে।

দাকোপের আনন্দনগর এলাকার কৃষক বাবুল শেখ বলেন, এক বিঘা জমিতে তরমুজ উৎপাদনে ৩০ হাজার টাকা থেকে ৩৫ টাকা খরচ হয়। কিন্তু এখন তরমুজের দাম পাওয়া যাচ্ছে না। এক মাস আগেও তরমুজর দাম ছিল রমরমা। এখন দাম না পাওয়ায় তরমুজ মাঠেই ফেলে রাখতে হচ্ছে।

দাকোপের চাষি গোলাম মোস্তফা বলেন, মাঠে গাছ নেই। কিন্তু বড় বড় তরমুজ পড়ে আছে। আগে বিঘাপ্রতি লাখ টাকা লাভ হলেও এখন দামেই পাওয়া যাচ্ছে না। আনন্দনগর, ছোট চালনা, পানখলী, মৌখালী, তীলডাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকার মাঠে তরমুজ নষ্ট হচ্ছে। ব্যাপারী না আসায় কৃষকরাই তরমুজ নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ছুটছেন। কিন্তু মোকামে দাম মিলছে না।

বানিশান্তার কৃষক উৎপল সানা বলেন, তরমুজ উৎপাদনে বিঘাপ্রতি ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়। তবে ব্যবসায়ীরা এখন ২০ হাজার টাকাও দাম বলেন না। খুলনা শহরে নিয়েও বিক্রি করা যাচ্ছে না। মোকামেও প্রত্যাশিত দাম মিলছে না।

কৃষক দেবাশীষ বাইন বলেন, গত বছর লাভ দেখে এ বছর ১১ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছি। কিন্তু এবার ৭ বিঘার তরমুজ বেচে খরচ ওঠেনি। আরও চার বিঘা জমির তরমুজ মাঠেই পড়ে আছে।

খুলনার দাকোপের আনন্দনগর গ্রামের তরমুজ চাষি শেখ আবু সাঈদ বলেন, ৫-১০ কেজি ওজনের একটি তরমুজ ক্ষেত থেকে ১০-২০ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে। সেই তরমুজ বাজারে ৩০-৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চাষির কাছ থেকে কম দামে তরমুজ কিনে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।

একই গ্রামের চাষি কামরুল ইসলাম বলেন, ১০ বিঘা তরমুজ কেটে বসে আছি। কোথায় যাবো, কী করবো ভেবে পাচ্ছি না। এখন হতাশ হয়ে পড়েছি। ঢাকা নিয়ে যেতে ২৫-৩০ হাজার টাকা পরিবহন খরচ। তরমুজের কোনো দাম নেই। যা খরচ করেছি তার চার ভাগের একভাগও দাম পাচ্ছি না।

চালনার চাষি বাবুল শেখ বলেন, আমি পাঁচ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছিলাম। তরমুজ বিক্রি করতে পারিনি। কেউ দামই বলে না। বাজারে তরমুজের দাম হলেও ক্ষেত থেকে তরমুজ নিতে কোনো ব্যাপারি আসেননি। ক্ষেতেই তরমুজ পচে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। খরচ ওঠাতে পারব কিনা সে দুশ্চিন্তায় আছি।

বটিয়াঘাটার গঙ্গারামপুরের চাষি আরুণী সরকার বলেন, ৮ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছিলাম। এখন তরমুজ ক্ষেতেই পড়ে রয়েছে। কেউ কিনতে আসছে না।

পাইকগাছা উপজেলার গড়ইখালী এলাকার চাষি শাফায়াত হোসেন বলেন, মাঠে তরমুজের ঢল, বাজারমূল্য একেবারেই নেই। দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে তরমুজ। আড়তে নিয়েও দাম পাচ্ছে না কৃষক।

তিনি বলেন, ক্ষেত থেকে ট্রাকে আড়তে পৌঁছাতে ২০-২৫ হাজার টাকা, আড়তদারি ১০ শতাংশ, লেবার খরচ, আড়তে বিক্রির পর ভাড়া মেটাতে পারছে না কৃষক। আড়ত থেকে পালিয়ে আসছে কৃষক।

বটিয়াঘাটার গঙ্গারামপুরের কায়েমখোলা গ্রামের চাষি মো. আসাদ গাজী বলেন, গত বছর তিন বিঘায় চাষ করে চার লাখ টাকা লাভ হওয়ায় এবার সাড়ে চার বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছি। সব মিলিয়ে সাড়ে চার বিঘায় খরচ হয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার টাকা। খেতে তরমুজ বিক্রি করতে না পারায় খুলনার আড়তে তরমুজ নিয়ে এসেছেন। দেড় বিঘার তরমুজ মোকামে আনতে আবার খরচ হয়েছে সাড়ে আট হাজার টাকা। সেই তরমুজ গত দুই দিনে বিক্রি করতে পারেননি তিনি।

পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের ফুলবাড়ী গ্রামে কৃষক অনাথ মন্ডল বলেন, গত বছর দুই বিঘা জমিতে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা লাভ করেছিলেন। এবার ৩ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে তরমুজ করেছি। কিন্তু এবার বিক্রি করতে গিয়েই মাথায় হাত।

ডুমুরিয়ার শরাফপুরের আকড়া গ্রামের কুদ্দুস গাজী বলেন, যদি কেজিতে সাত-আট টাকাও পেতাম, তাহলে খরচ উঠে কিছু লাভ থাকত। এখন মাঠে যা আছে, তা আর আনার চেষ্টাও করব না। খরচ দিয়ে পারা যাবে না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খুলনার উপ-পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, রমজানের শুরুতে তরমুজ লাভজনক ছিল। ঈদের পর পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। তাই কৃষকরা হতাশ হয়েছেন।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
তরমুজ,খুলনা,কৃষক
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close