শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি

  ১৩ নভেম্বর, ২০২১

ঝুরি সাঝ তৈরি করে স্বাবলম্বী ছিন্নমূল শতাধিক নারী

নারীরা ঝুরি সাঝ তৈরি করতে ব্যস্ত- প্রতিদিনের সংবাদ

যমুনার ভাঙনে নিঃস্ব শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরি ইউনিয়নের দুর্গম হাটপাঁচিল গ্রামের প্রায় শতাধিক নারী। ছিন্নমূল এই নারীরা আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ মেলায় বহুল প্রচলিত মুখরোচক খাবার ঝুরি সাঝ তৈরি করে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করছেন।

ঝুরি প্রস্তুত ও বিক্রি করে হাটপাঁচিল গ্রামের দুস্থ, অসহায়, ছিন্নমূল, আত্মপ্রত্যয়ী কর্মঠ এসব নারীরা পরনির্ভরশীলতার নাগপাশ ডিঙিয়ে স্ব-নির্ভর ও স্বাবলম্বী হয়েছেন।

কর্মশূন্যপ্রায় হাটপাঁচিল গ্রামের অসহায় ওইসব নারীদের জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়া ও সফলতা দেখে যমুনা অধ্যুষিত পার্শ্ববর্তী পল্লীগ্রামের অনেক সহায়-সম্বলহীন নারীরাও ঝুরি তৈরির কাজে ঝুঁকছেন। হাটপাঁচিল গ্রামের এক সময়ের চির অবহেলিত সর্বস্ব হারা ভাগ্যবিড়ম্বিত ওইসব নারীদের কষ্ট অতীতে কেউ বুঝতে চায়নি। নিজ উদ্যোগে তারাই বাস্তবতার সাথে লড়াই করে তাদের ভাগ্য উন্নয়ন করছেন। তারাই এখন নিজ উদ্যোগে জয়িতা। সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন দুগর্ম হাটপাঁচিল গ্রামের শতাধিক ঝুরি প্রস্তুতকারক স্বাবলম্বী নারী।

ওই গ্রামের বয়োবৃদ্ধা মইতন, মমতাসহ বেশ কয়েকজন ঝুরি প্রস্তুতকারী নারীরা জানান, তাদের বাড়িঘর, জমিজমা, সহায়-সম্বল তিনবার, চারবার বা তারও বেশিবার রাক্ষুসী যমুনার কড়াল গ্রাসে বিলীন হওয়ায় সর্বস্ব হারা হয়েছিলো। যমুনার তীরবর্তী এ গ্রামটি চরাঞ্চল হওয়ায় এখানে কোন ফসলের আবাদও হয়না। পাশের গ্রামগুলোতেও জীবিকা নির্বাহের জন্য উল্লেখযোগ্য কোন কাজও সচরাচর পাওয়া যায়না। যমুনার ভাঙনে তাদের মতো কর্মহীন নারীর দিন কাটছিলো অতিকষ্টে, অর্ধাহারে, অনাহারে। দিনে দিনে যমুনায় সব হারিয়ে তারা পথের ভিখারিতে পরিণত হয়েছিলো। এমতাবস্থায় নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জন্য দুবেলা দুমুঠো ভাতের যোগান দেওয়াটাই তাদের জন্য হয়ে উঠেছিলো কষ্টসাধ্য।

সেখানকার অনেক পুরুষ তাদের স্ত্রী পরিজন ফেলে অন্য জায়গায় ঘর বেধেছে। স্বামীহারা এসব নারীরা এক সময় জীবিকা তাগিদে ঝুরি তৈরি ও বিক্রির কাজ বেছে নেন। এরপরেই তাদের জীবনে দিনবদলের পালা শুরু হয়। ঝুরি বিক্রি করে তারা লাভের মুখ দেখতে শুরু করেন। এরপর থেকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি তাদের।

জীবিকা নির্বাহ করার পাশাপাশি অনেকেই তাদের সন্তান-সন্তানাদিকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন, শিক্ষিত করে তুলতে। আবার অনেকেই ঝুরি তৈরির পাশাপাশি বাড়িতে গরু-বাছুর, ভেড়া-ছাগল প্রতিপালন করে অধিক আয় করছেন।

এ গ্রামের ঝুরি প্রস্তুতকারক নারীরা আরও জানান, দিনে একজন নারী পরিবারের সদস্যদের নিয়ে প্রায় ১ মণ ঝুরি তৈরি করতে পারছেন যার বর্তমান বাজার মূল্য মণপ্রতি প্রায় তিন হাজার পাঁচশ টাকা। কেজিপ্রতি তারা ঝুরি বিক্রি করছেন ৮৫ থেকে ৯০ টাকায়। এতে কেজিতে তাদের ১০ থেকে ১৫ টাকা আয় হচ্ছে যা মণ প্রতি হিসাবে দাঁড়াচ্ছে প্রায় তিনশ আশি টাকা থেকে প্রায় পাঁচশ টাকা। শাহজাদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের তৈরি ঝুরির বেশ চাহিদা থাকায় বিক্রিতে কোন বেগ পোহাতেও হচ্ছেনা।

তবে ঝুরি প্রস্তুতের প্রধান কাঁচামাল আলা চালের দাম বাজারে বৃদ্ধি পাওয়ায় অতীতের তুলনায় বর্তমানে তাদের লাভ একটু কম হচ্ছে বলে জানান তারা।

ঝুরি প্রস্তুতকারক সুফিয়া জানান, প্রথমে আলো (আলা) চাউল ড্যাগের (পাতিল) মধ্যে সিদ্ধ কইর‌্যা বৈঠা দিয়্যা ঘুঁইট্যা ঘুঁইট্যা দলা বানাইয়্যা ঝাঁঝুর দিয়ে ঝাঁইড়্যা কাঁচা ঝুরি বানাই। পরে হেই ঝুরি রোইদে শুঁকাইয়্যা গরম বালি দিয়্যা ভাঁজি। ভাঁজা ঝুরি বেইচ্যা যা থাকে তা দিয়্যা ছাওয়ালপালগরে পাইলব্যার পাইরতেছি।

পাইকারি ঝুরি ব্যবসায়ী হারেছ জানান, নানা পালা-পার্বনে, উৎসবে, গ্রামীণ মেলায় আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাবার ঝুরির দেশব্যাপী ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ফলে ঝুরি বিক্রিতে নারীদের কষ্ট করতে হচ্ছে না। লাভও যা হচ্ছে তা একেবারেই মন্দ না!

শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, হাটপাঁচিল গ্রামের নারীরা বেশ কর্মঠ। তারা নিজ উদ্যোগে এ কাজ করে বেশ এগিয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে এ গ্রামের নারীরা আবহমান গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঝুরি শিল্পকে আজও একটি সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পে পরিণত করতে পারেনি।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ছিন্নমূল নারী,ঝুরি সাঝ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close