ড. আজিজুল আম্বিয়া

  ১৮ অক্টোবর, ২০২৪

মতামত

ড. ইউনূস ও সরকারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা

ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি ছাত্র-জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন। মানুষ ন্যায় এবং সাম্যভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পাওয়ার আশায় বুক বেঁধেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে তার কাছে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই। গত ৮ আগস্ট সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেই দিন রাতে বঙ্গভবনের দরবার হলে তাকে শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। কেউ কেউ বলছেন, এটি মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু সেটি মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে যাওয়া কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। অন্যদিকে অনত উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, তরুণরা রাষ্ট্রের হাল ধরার জন্য প্রস্তুত। সেই সময়ে দেশে ফিরেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই হবে প্রথম কাজ। বিভিন্ন জায়গায় হামলা বা আক্রমণ ষড়যন্ত্রের অংশ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজ সবাইকে রক্ষা করা। প্রতিটি মানুষ আমাদের ভাই, আমাদের বোন। তাদের রক্ষা করা এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা আমাদের প্রথম কাজ।’ তার এই বক্তব্যে মানুষ আশার আলো খুঁজে পেয়েছিল। এখন তিনি দেশ চালাচ্ছেন। স্বভাবত মানুষ মনে করছেন তিনি যেহেতু অর্থনীতি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখেন, তাই দেশের অর্থনীতি এবং বিদেশের সঙ্গে আদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আরো ভালো হবে। কিন্তু বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংক ৬৬৬ কোটি টাকা কর থেকে অব্যাহতি পাওয়া এবং ৫ বছরের জন্য গ্রামীণ ব্যাংককে আর নতুন করে কর দিতে হবে না- এসব রায় হয়তো তার সরকারকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলতে পারে বলে দেশের সুশীল সমাজ মনে করছে। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, যেহেতু তিনি এই ব্যাংকের সঙ্গে জড়িত, তাই তাকেই খুঁজবে জনগণ এই উত্তরের জন্য।

আসুন আমরা এই মহামানব সম্পর্কে জেনে নিই, তিনি ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষুদ্রঋণ ও ক্ষুদ্রবিত্ত ধারণার প্রেরণার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং ২০১০ সালে কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেলসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তিনি সেই সাতজন ব্যক্তির একজন, যারা নোবেল শান্তি পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল পেয়েছেন। ২০১২ সালে তিনি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হন এবং ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি তার অর্থকর্ম সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ করেছিলেন। তিনি গ্রামীণ আমেরিকা এবং গ্রামীণ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা বোর্ড সদস্য, যা ক্ষুদ্রঋণকে সহায়তা করে থাকে। তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব পালন করেন। ২০২২ সালে তিনি উন্নয়ন আন্দোলনের জন্য ইস্পোর্টাস তৈরি করতে গ্লোবাল ইস্পোর্টাস ফেডারেশনের সঙ্গে অংশীদারত্ব করেছিলেন। অনেক গুণে গুণান্বিত এই ব্যক্তির কাছে বাংলাদেশের মানুষের অনেক চাওয়া-পাওয়া রয়েছে। তার কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বর্তমানে বাংলাদেশের একটি পক্ষ তাকে মেনে নিতে চাইছে না। এ অবস্থায় সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক আসার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ২৭ সেপ্টেম্বর মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকাকে তিনি একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেটি ছিল ইংলিশে ১৯ মিনিটের। মোডারেট, সোমিনী সেনগুপ্ত আন্তর্জাতিক জলবায়ু সংবাদদাতা। সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেন। সেই সময় বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আগুন নিয়ে কথা উঠলে তিনি রিসেট বাটন ধারণাটির কথা উল্লেখ করেন। এরপরই তর্ক-বিতর্ক এতদূর গড়িয়ে যায় যে, অনেকেই তাদের ফেসবুক পোস্টে ব্যবহার করে লিখতে শুরু করেন স্টেপ ডাউন ইউনূস। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ডক্টর ইউনূসের নামে চলমান এই সমালোচনায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থকদের বড় সংখ্যা দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, রিসেট বাটন টিপে বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস মুছে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এখন নতুন ইতিহাস তৈরি হয়েছে। এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সমালোচনার ঝড় বইছে বাংলাদেশে। এর ধারাবাহিকতায় তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট স্টেপ ডাউন ইউনূস বলে সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে রিসেট বাটনে এ দেশের জন্ম ইতিহাস মুছে ফেলার প্রতিবাদ করেছেন। তিনি চাকরিচ্যুতও হয়েছেন এই কারণে। এ নিয়ে ফেসবুক বেশ সরগরম ছিল বিগত কয়েক দিন। বাংলাদেশের মানুষ এই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশের সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধসহ বেশ কয়েকটি দাবি আছে। যারা এত দিন মনে করতেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশ নিরাপদ না। তারা আজকে ডক্টর ইউনূস সরকারের কাছ থেকে সেই হিসাব বুঝে নিতে চাইবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা করা যাচ্ছে না। শেয়ারবাজার অস্থির। আগে যারা এক দরবেশ বাবার ইঙ্গিত দিতেন, তিনি তো এখন নেই। তো এখন কারা এসব করছেন? কোন নতুন দরবেশ বাবার জন্ম হয়ে গেল এই কয়েক দিনে? এই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মনে। যদিও এই সরকার খুব বেশি সময় পায়নি তবু মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি। এ ছাড়া আসিফ নজরুল এই সরকারের একজন মুখপাত্র এখন। আর তিনি তার পূর্বের বক্তব্যে প্রায় বলতেন, এ দেশে ভারতের প্রায় ২৬ লাখ লোক কাজ করছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থনে। অথচ এখানে এ দেশের মানুষ কাজ পায় না। তার এই বক্তব্যের সত্যতা জানতে চায় এখন এ দেশের কিছু জনগণ। তিনি এখন সরকারের প্রভাবশালী একজন উপদেষ্টা। তাই এই সরকারকে অনেক কিছুরই হিসাব বুঝিয়ে দিতে হবে জনগণকে স্বল্প সময়ের মধ্যে।

বর্তমানে দেশে যেভাবে গণহারে মামলা চলছে, সেখানে মানুষ প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ সরকার এবং এই অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে তেমন একটা পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছেন না বলে ইতিমধ্যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাহলে বাংলাদেশের জনগণ কোথায় গিয়ে শান্তি পাবে? কোন মহামানবকে তারা বিশ্বাস করবেন? এই প্রশ্ন এখন অনেকের মনে আছে। তাই সুধীজনের পরামর্শ হলো এই সরকারকে সততা এবং সতর্কতার সঙ্গে জনগণের মতামতকে মূল্যায়ন করতে হবে, নতুবা তারা যা অর্জন করেছেন এবং মানুষের বিশ্বাসকে সম্বল করে ক্ষমতায় এসেছেন, তা ধরে রাখতে হয়তো সক্ষম হবেন না। এ ছাড়া বিএনপিকে মানুষ সেই আগের রূপে দেখতে এই কিছু সময়ে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই দেশের কিছু মানুষ এখন শঙ্কিত আছেন। ইতিমধ্যে বিএনপি নেত্রী ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাকে টকশোতে বলতে শোনা যায়, আমি কিন্তু এখন বাংলাদেশকে নিরাপদ মনে করি না। কে কার স্বার্থ হাসিলের জন্য আমাকে নাই করে দেবে জানি না। আমরা সবাই মিলে রাজনীতিকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে এসেছি, তা বিপজ্জনক বলেই তিনি মনে করছেন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ভারত চলে যাওয়ার পর কারাগারের ফটক খুলে দেওয়া হলো। তখন রাজবন্দি থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেয়াদের সাজাপ্রাপ্ত আসামি এবং জঙ্গিসহ প্রায় সবাই বের হয়ে গেল আইনের সাধারণ প্রক্রিয়ার বাইরে। তারা কীভাবে জামিন ছাড়াই বা সাজাভোগ ছাড়াই মুক্তি পেল? এটা সহজভাবে তিনি মেনে নিতে পারছেন না। এই কথাগুলো কী প্রমাণ করে তা অনেকেই সাহস নিয়ে বলছেন না এখন। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন তার দলের লোকরা এবং প্রশাসনের লোকও বেখেয়াল ছিলেন এই কারণেই হয়তো তিনি তার শেষ রক্ষা করতে পারেননি। ঠিক একই অবস্থা বর্তমান সরকারের হোক এটাও কারো কাম্য নয়। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফার যে সংলাপ করলেন, তাতে দ্রুত নির্বাচন কিংবা নির্বাচন কবে হবে- এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ আরেকটু বেড়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। দেশের ভেতর ও বাইরে এ সরকারের কাজ নিয়ে অনেক সমালোচনা শোনা যায়। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘু নির্যাতন, ডাকাতি এবং ভাস্কর্য ভাঙচুরের মতো অপরাধমূলক কার্যক্রমগুলো হঠাৎ করে শুরু হলেও তার সমাপ্তি হচ্ছে না। আর এমন উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মাঝেই দেশের কয়েকটি জেলা বন্যাকবলিত হলো, ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতিও তীব্র হয়ে ওঠে। বিদেশি ঋণের বোঝা ইতিমধ্যেই এই অন্তর্বর্তী সরকারের কাঁধে এসে পড়েছিল। ড. ইউনূস সরকারকে এই বিপর্যয় ও ঋণ মোকাবিলায় সংকটময় সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক দুর্দশা এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সময় দেশবাসী মনে করেছিল, সেখানে তিনি জাতির সামনে নির্বাচনের সময়সীমা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম তুলে ধরবেন। কিন্তু এ রকম কিছু তার বক্তব্যে না আসাতে অনেকেই হতাশ হয়েছেন। ড. ইউনূস ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে সংস্কার ও সংশোধনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠন করেছেন ছয়টি সংস্কার কমিশন। নির্বাচনব্যবস্থা, সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি ও পুলিশ প্রশাসন সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করা হয়েছে। আশা করি, যুক্তিসংগত সময়ে তিনি এসব সংস্কারে সফল হবেন। নির্বাচন কবে হবে তা পরিষ্কার নয় এখন পর্যন্ত। তাই আশা করছি, এ সরকার জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করবে। দেশের জনগণও তাই চান।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close