আলমগীর খোরশেদ

  ০৮ মার্চ, ২০২৪

গ্রামীণ ঐতিহ্য

পানদানি

গ্রামে জন্ম ও বেড়ে উঠা যাদের, তারা ছেলেবেলায় দেখেছে- কেউ বেড়াতে এলে কাছারিঘরে বসতে দিত। মুড়ি, পিঠা বা সামান্য কিছু নাস্তা দিয়ে পান দিত। পানদানি থাকত ঘরে ঘরে। শুকনা সুপারি না থাকলেও কাঁচা সুপারি কেটে দেওয়া হতো পানদানিতে। পানের বোঁটা ছোট টুকরা করে কেটে চুনের ছোট পাত্রে ডুবিয়ে রাখা হতো, তা দিয়ে চুন খাওয়ার জন্য।

সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা এই বাংলায় গ্রামের পর গ্রাম, মাঠের পর মাঠ, বন-বনানী, খাল-বিল নিয়ে গ্রামীণ জনপদ। গ্রামের বাড়িতে মেহমান বা কেউ এলে তস্তরি বা পিরিচে বা পিতল, অ্যালুমিনিয়াম বা কাঁচের পানদানিতে পান, সুপারি, চুনসহ আপ্যায়ন করা হতো। সঙ্গে দুটো বাতাসা অথবা মেছরি অগত্যা তা না থাকলে একটু চিনি দেওয়া হতো। জিহবা লাল, নিঃশ্বাস সুরভিত, ঠোঁট লাল করতে পান খাওয়া, যা পরে অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় মানুষের। বিয়ের বিষয়ে কনে পছন্দ হয়ে গেলে বরপক্ষ যেদিন কনের বাড়িতে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, সেদিন পান চিনি অনুষ্ঠান হয়। পান, সঙ্গে সুপারি, মিষ্টি জর্দা, যেকোনো মিষ্টি দেওয়া অত্যাবশ্যকীয় ছিল। পান ছাড়া কোনো মজমা, আসর, মেহমানদারি হতো না। ৪০০ খৃস্টপূর্বাব্দে মানুষ পান খেয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার পর পান চিবিয়ে খাওয়া হয়, সঙ্গে চিকন করে কাটা সুপারি। শাহাদাত আঙুলের আগায় থাকত চুন। আর্যরা পানকে ‘তাম্বুল’ বলতেন। পান একধরনের লতাজাতীয় গাছ। কাউকে পান দেওয়া কেবল পানপাতা নয়, সঙ্গে সুপারি, খয়ের, চুন, ‘পাতা’ হিসেবে খেত তামাক পাতা। পাতা জিনিসটা নেশার উদ্রেক করে। দক্ষিণ এশিয়া এবং তাইওয়ানে পান খাওয়া এবং এর কদর ছিল অনেক আদি সংস্কৃতি। লখনৌ নবাবদের নর্তকিরা পানদানি বহন করত। এসব পানদানি সোনার প্রলেপ দেওয়া খাঁটি রুপা দ্বারা তৈরি ছিল। ১৯১১ সালে ভারতে সফরের সময় রানী মেরিকে পানদানি উপহার দেওয়া হয়, যা ১৯১২ সালে জাদুঘরে রাখা হয়েছিল। পান চিবানোর প্রাচীন ঐতিহ্য ফিলিপাইনের। পালাওয়ান দ্বীপের ডুয়ং গুহায় একটি সমাধির গর্তে পান খাওয়ার পাত্র মানে পানদানি পাওয়া যায়, যা খৃস্টপূর্ব ৪ হাজার ৬০০ বছরের মধ্যে বলে ধারণা করা হয়।

গুহায় প্রাপ্ত কংকালের দাঁতে সুপারি চিবানোর দাগ ছিল, গুহায় চুনের পাত্র পাওয়া যায়। যাতে তখনো চুনের উপাদান মিলেছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে সুমাত্রা, জাভা এবং মালয় উপদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়ের সঙ্গে ব্যবসায়ীরা যোগাযোগের সময় পান চিবানোর রেওয়াজ ছিল। বঙ্গোপসাগরে ব্যবসায়ীর মাধ্যমে কাশ্মীরেও পৌঁছে যায় পান, পান খেতে বা কাউকে দিতে স্বাভাবিকভাবেই পানদানির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। পান চিবানোর ঐতিহ্য ভারত থেকে প্রশান্ত মহাসাগর অবধি। বিশ্ব পরিব্রাজক ইবনে বতুতা তার বর্ণনায় পান চিবানোতে সুপারি, চুনা পাথর ব্যবহারের কথা উল্লেখ আছে। ষোড়শ শতাব্দীতে পানের ওপর সুগন্ধি ছিটিয়ে জাফরান, গোলাপজলসহ মেহমানকে দেওয়া হতো। দক্ষিণ ভারতে কোনো শুভ অনুষ্ঠানে অতিথিদের পান, সুপারি, চুন, জর্দা বা সুগন্ধি তামাক পাতা মসলা-নারিকেলসহ পরিবেশন করা হতো। যা পানের স্বাদ বহুগুণে বাড়িয়ে দিত। গ্রামে পান খাওয়া মানুষের পাশে বসলে জর্দার সুগন্ধি সুবাস মুগ্ধতা বাড়িয়ে বয়স্ক মানুষের ঠোঁট লাল হয়ে যেত। বুড়ো মানুষরা পান সুপারি চেঁছে টুকরো টুকরো করে খেতেন। চিকন বাঁশের চোঙায় পান সুপারি চুনসহ দিয়ে তারপর লোহার টুকরা দিয়ে গোঁতা দিয়ে চূর্ণ করা হতো পান সুপারি। পানে প্রোটিন, চর্বি, খনিজ, ফাইবার, কার্বোহাইড্রেট, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি রয়েছে। পান একটি উদ্দীপকজাতীয় উদ্ভিদজ খাবার, এটি অ্যান্টিসেপটিক এবং শ্বাস ফ্রেশনারের কাজ করে। পানের ভেষজগুণ অনেক। পান খেলে হজম শক্তি বাড়ে। ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস কমায়। রোজ ১০-১২টি পানপাতা পানিতে পাঁচ মিনিট জ্বাল দিয়ে ছেঁকে ঠাণ্ডা করে মধু মিশিয়ে কুসুম গরম খেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। তবে খয়ের, চুন ক্ষতিকর। যা ফুসফুসে ইনফেকশন তৈরি করে। বেশি চুন দাঁতের ক্ষতি করে। গ্রামে পানের অনেক গুরুত্ব। কেউ সমাদার না করলে বলে, ‘একটা পানও খাওয়াইতে জানে না, বেডা ছুডুলোকের বাইত বিয়া করানো বা দেওয়া যাইব না’। সময় পাল্টে গেছে, গ্রামে এখন পান খাওয়া বা দেওয়া নেই বললেই চলে। হারিয়ে গেছে পানথাল বা পানদানি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close