আরিফ মঈনুদ্দীন

  ২৬ জানুয়ারি, ২০২৪

ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব ৩)

তাহারা ফিরিয়া আসিলেন

আমার নাম লিলিয়ান। গুড নুন আন্টি। আমি লীরার সঙ্গে দেখা করব।

রাশেদা স্মৃতি হাতড়িয়ে দেখলেন এ মেয়েকে তো তিনি কখনো দেখেননি। ও লীরার বান্ধবী হলো কীভাবে! তা তোমার নিবাস কোথায়। তোমাকে তো চিনতে আমার কষ্ট হচ্ছে?

হ্যাঁ, আপনি আমাকে চিনবেন না। লীরা চেনে। মিসেস রাশেদা আক্তার বাক্যের ভেতর আশ্চর্যবোধক চিহ্ন ব্যবহার করে বললেন, তা তুমি এখন এই ভরদুপুরে...!

বা-রে, বান্ধবীর বাড়িতে আসতে আবার দুপুর-সকাল কী? যখন ইচ্ছে হয় তখনই আসব। বলতে বলতে মেয়েটা তরুণীসুলভ অঙ্গ চালনায় একরকম নেচে উঠল।

মেয়েটার নড়াচড়াতেই রাশেদা আক্তারের খটকা লাগল। এ যেন খুব স্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করতে পারছে না। তাকে খুব ভারী ভারী মনে হচ্ছে। চোখেমুখে একটি কিশোরী মেয়ে হয়তো-বা কৈশোর পেরিয়েছে দু-চার মাস হয়েছে। এ মেয়ের শরীরের পরিবর্তন বা নড়াচড়াটা তার নিজের একসময়ের মতো মনে হচ্ছে। তখন লীরা ছিল তার গর্ভে। আর এক মাস পর ২৮ জুলাই ডাক্তার ডেট দিয়েছে। কথা বলতে বলতে কখন তারা ড্রইংরুমে এসে বসেছেন রাশেদা আক্তারের মনে নেই।

লীরাকে ড্রইংরুমের দিকে আসতে দেখে লিলিয়ান চপলভাবে এগিয়ে গেল। সুন্দরভাবে হালকা হালকা উচ্চারণে পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল, এ পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম তোমার সঙ্গে একটু দেখা করা যাক।

লীরার মনে পড়েছে- ওদের কলেজে একবার একটি অনুষ্ঠানে এ মেয়েকে গান গাইতে আনা হয়েছিল। সংগীতের গলাটা ভালো। তবে পেশাদার সংগীতশিল্পী নয়- ক্লাসের কার জানি পরিচিত। এই সুবাদে এসেছিল। গান শেষ করে সে লীরার দিকে এগিয়ে এল। বলল, তুমি তো দেখতে বেশ সুন্দর। কিন্তু মনে হচ্ছে নিজেকে গুছিয়ে রাখছ। এত রাখঢাক করে কি জীবন উপভোগ করা যায়। তোমার কণ্ঠে তো সুন্দর সংগীতের চাষাবাদ হতে পারে এবং মঞ্চের জন্য শরীরও বেশ লোভনীয়। যাও, যাও না একটা কিছু পারফরমেন্স করে দেখাও।

লীরা নিজের বিশেষণগুলো অনুধাবন করে যদিও বেশ পুলকিত হয়েছিল, কিন্তু অমন কিছু করার চিন্তাভাবনা মাথার ধারেকাছেও আসেনি। সে বলল, তুমি তো বেশ সুন্দর গান করতে পারো। রোজ বুঝি চর্চা করছ।

আরে দূর, চর্চা কোথায়। আমার শুধু খেয়েদেয়েই মজা। ঘোরাঘুরি, চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া এবং শরীরের রোমান্স ফিল করাও আমার জন্য ভীষণ মজার। ধৈর্যের প্রাচীরের ভেতর বসে বসে রেওয়াজ করা! ওটা আমার সয় না। তবে হ্যাঁ, লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হচ্ছে খুব কষ্ট করে। লেখাপড়া মানে স্কুল-কলেজ ছাড়া ভালো বন্ধু পাওয়ার জায়গা কোথায়?

এই কথা, সেই কথা বলতে বলতে লিলিয়ান তখনই ভেবেছিল- ওই অল্প সময়ে লীরা তার বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে। লীরার কথাবার্তাই অমন। পাঁচ মিনিট কথা বললে লিলিয়ান কেন, যে কেউ ধরে নেবে লীরার মাঝে তার সখ্য লেগে গেছে। আসলে কিন্তু তা না। লীরা বন্ধুত্ব করে বেছে বেছে, এটা তার পারিবারিক শিক্ষা এবং কথা বলবার আগে-পরে বিভিন্ন সৌজন্যমূলক শব্দ প্রয়োগ মার কাছ থেকে শেখা। যেমন কেউ বলল স্যরি। লীরা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলে ফেলবে নো ম্যানশন। কেউ বলল, থ্যাংক ইউ। সুন্দর উচ্চারণে সঙ্গে সঙ্গে বলে দেবে, ইট’স মাই প্লেজার। কেউ বলল, এক্সকিউজ মি।

লীরা যতটা সম্ভব সুন্দর উচ্চারণে বলে উঠল, ইয়েস, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ।

লীরার এসব আচরণ লিলিয়ানকে দারুণ মুগ্ধ করেছিল! কথার এক ফাঁকে লিলিয়ান তার নোটবইটা খুলে বলল, দাও তোমার বাসার ঠিকানাটা লিখে দাও।

লিলিয়ানের স্বাভাবিক আচরণ লীরার কাছে ভালো লেগেছিল। বাসায় এসে মা’র কাছে গল্পের মতো পুরো ঘটনাটা বলল।

মা হাসতে হাসতে বললেন, আবার ওসব ঘরছাড়া মেয়েদের প্রেমে পড়িস না যেন।

রাশেদা আক্তার মেয়েটাকে বেশ করে দেখে নিচ্ছেন। মেয়েটার শারীরিক পরিবর্তন তার কাছে তেমন বিব্রতকর মনে হচ্ছে না। কারণ তিনি ভাবছেন ওর স্বামী নিশ্চয়ই আছে। এখানে কোনো কোনো মেয়ে কৈশোরেই বিয়ে করে ফেলে। মুহূর্তের নীরবতা ভেঙে লীরা বলল, মা ওকে চিনছ না- তোমাকে যে গল্প করেছিলাম মনে নেই।

কোন গল্প?

ওই যে, লিলিয়ান- আমাদের কলেজে গান করেছিল।

ও হ্যাঁ মনে পড়েছে, তোদের কলেজের কী জানি একটা অনুষ্ঠানে।

রাশেদা আক্তার ভাবছেন এই মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার সময় লীরা কখন পেল। মেয়েটি যেভাবে কথা বলছে, তাতে মনে হচ্ছে ওরা খুবই ঘনিষ্ঠ। লীরাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রাশেদা আক্তার ওর সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিষয় হলো ওর শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে বৈধতা ও অবৈধতার যোগসূত্র বের করা। তিনি বললেন, তা মা তোমার স্বামী বাবাজি কী করেন?

প্রশ্নটি শুনে লিলিয়ান একটা হোঁচট খেল। আমার স্বামী! না আন্টি, আমার এখনো স্বামী-স্ত্রী হইনি। তবে হবো।

তবে যে তোমার পেটে মনে হচ্ছে নতুন অতিথি! রাশেদা আক্তার নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললেন।

হ্যাঁ, ওতে তো দোষের কিছু নেই। ও আমাদের ভালোবাসার ফসল। ভালোবাসার ফসল তো সব সময় প্রিয় হয়। তাই আমার শারীরিক পরিবর্তনটাও আমার কাছে দারুণ প্রিয়। আমরা লিভ টুগেদার করি। একজন অন্যজনকে চিনতে চেষ্টা করছি। শেষাবধি বিয়ে না হলেও আমাদের আপত্তি থাকবে না। ও যা পেল না-পেল আমি তো লাভবান। একটি সন্তান পাচ্ছি।

রাশেদা আক্তারের চোখেমুখে ঘৃণা আর বিরক্তি এমনভাবে জড়ো হতে থাকল। তিনি মেয়েটির সামনে বসে থাকাটা নিরাপদ মনে করলেন না। নিজেকে সামলানোর জন্য তিনি ভেতরের রুমে চলে এলেন। মেয়েটির কথায় তার যদিও ভীষণ ঘেন্না ধরেছে পরক্ষণেই ভাবলেন এদের জন্য তো এটা কোনো ব্যাপারই না। ওর বাবা-মাও নিশ্চয়ই এমন ছিল। ওরা অমনই। শিয়াল-কুকুরের সঙ্গে ওদের গরমিল শুধু শিয়াল-কুকুর কথা বলে না- ওরা বলে। উদাহরণটা ভীষণ রকম নোংরা হয়ে গেল। তা হোক। একটা ব্যাপারে তিনি এদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ করেন। কিন্তু পরক্ষণেই এদের পশুসুলভ দৈহিক সম্পর্কের জন্য শ্রদ্ধাবোধ ম্লান হয়ে আসে। যেমন দেখা যায়, এদের বেশির ভাগ লোকই নৈতিকভাবে খুবই সরল। মিথ্যা কথা বলবে না। ঘুষ খাবে না। জালজালিয়াতি করবে না। প্রতারণা করবে না। কিন্তু প্রায় অধিকাংশ নর-নারীই অনিয়ন্ত্রিত যৌনজীবন ভোগ করে। এটাকে ওরা পাপের কিছু মনে করে না। এখানে আসলে পাপবোধের চর্চাও তেমন হয় না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভাই-বোনের মধ্যেও যৌন সম্পর্ক বিদ্যমান এবং আশ্চর্যের বিষয়, কোনো কোনো বাবাও নাকি সুন্দরী মেয়ের ওপর লোভ সামলাতে না পেরে নিজের ঔরসজাত মেয়ের শরীরে নিজেই প্রথম দাঁত বসিয়ে দেয় এবং শুধু একবারে ক্ষান্ত হয় না, শুরু করলে প্রাত্যহিক পণ্যের মতোই ব্যবহার করে। এ প্রসঙ্গে রাশেদা আক্তারের একটি সত্য ঘটনা মনে পড়ে গেল...। যেটা শুনতে গল্পের মতোই লাগে-

একটি সুন্দরী ইউরোপিয়ান মেয়ে, টিনএজ অতিক্রম করছে মেয়েটি। এমনই সুন্দরী যে, অভিনয় জগতে যদি সে নেমে পড়ত পর্দাকাঁপানো অনেক সুন্দরী নায়িকার মুখে চুনকালি পড়ত। তার চোখের-মুখের-ঠোঁটের-চুলের সর্বোপরি দেহবল্লরীর তুলনা দিতে হলে গদ্যে সম্ভব নয়- মহাকাব্য লিখতে হবে কয়েকটা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তার ত্বকের রংটা ইন্ডিয়ান সুন্দরীদের মতো। এমন সুন্দরী মেয়ের যদি লম্পট বাবা থাকেন তাহলে উপায়? লম্পট অবশ্য রাশেদা আক্তারের ভাষায়। ঘটনায় কিন্তু ভদ্রলোককে লম্পট বলা হয়নি- বলা হয়েছে অতিরিক্ত দেহলিপসু। মেয়েটিকে তার বাবা উত্ত্যক্ত করতে লাগল। প্রথমে মেয়েটি ব্যাপারটাতে প্রমাদ গুনল- বাবা এটা কি বলতে চায়? বুঝে উঠতে-না-উঠতেই এক দিন বাবা ধরে মেয়ের গালে কষে একটা চুমু খেল। যে চুমুতে স্নেহের নয় দেহের ইঙ্গিত স্পষ্ট। মেয়ের শরীরে যে কম্পন এলো, তা সে সামলাতে পারল না। লজ্জা তখন পালাই পালাই করছে। একসময় সে স্বাভাবিক হয়ে গেল। অবশ্য মেয়েটা তার ছেলে বন্ধুতে অভ্যস্ত ছিল কি না, তা গল্পে উল্লেখ নেই। রাশেদা আক্তারের ধারণা, ছিল। কারণ অমন সুন্দরী মেয়ে এখানকার ছেলেদের পৌরুষকে ফাঁকি দেবে তা সম্ভবই না। সে যাই হোক। মেয়ের লজ্জাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর থেকে বাবা এমন শুরু করলেন যে, সময়ে-অসময়ে মেয়ের ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় শরীরবৃত্তীয় সুবিধায়-অসুবিধায় কোনোই বাছবিচার করছেন না। একসময় মেয়েটা ভীষণরকম ক্ষেপে গেল। বিরক্তির সর্বোচ্চ মাত্রায় তার মেজাজ তখন তুঙ্গে। তার এক বান্ধবী আছে নামটা যেন পত্রিকায় কী লেখা ছিল, সে যাই হোক। যার সঙ্গে খোলামেলাভাবে সব কথা বলা যায়। এ পর্যন্ত জীবনের অনেক ঘটনাই সে বান্ধবীর কাছে বলেছে, শুধু পিশাচ বাবার ঘটনাটা ছাড়া। এবার মেয়েটি ভাবল বান্ধবীর সঙ্গে শলাপরামর্শ করে এটার একটা বিহিত করা দরকার। পুরো ব্যাপারটা মেয়েটি তার বান্ধবীর কাছে বর্ণনা করল। বান্ধবী অবাক হলো না। কারণ এটা এখন তাদের একটি পারিবারিক সমস্যা। যে সমস্যাটার কারণে পারিবারিক জীবনে ধস নামছে। যাচ্ছেতাই যৌনজীবনে অভ্যস্ত ইউরোপিয়ানরা বিয়েকে শৃঙ্খল মনে করে ওমুখো হওয়া ভুলে যাচ্ছে। মেয়েটির বান্ধবী বলল, ব্যাপারটা খুব তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে তো?

মেয়েটি বলল, তাড়াতাড়ি মানে পারলে এক্ষুনি সমাধান চাই।

ঠিক আছে, তুই এক কাজ কর। সমুদ্রসৈকতে আগামী রবিবার তোর বাবাকে নিয়ে বেড়াতে যা। সৈকতের যে জায়গাটায় তোরা থাকবি সেখানে যেন সৈকতচারীর সংখ্যা কম থাকে। পারলে, যেখানে লোকজন নেই- সে জায়গাটা বেছে নিবি। আর হ্যাঁ, তুই এখন থেকে তোর বাবার সঙ্গে সম্ভব সবরকমে ভালো ব্যবহার করবি। ঘটনাটা ঘটবে আগামী রবিবার। আজ বুধবার। মাত্র তিন দিন। শতবিরক্তি আর কষ্ট লাগলেও সয়ে নিবি। বুঝতেই দিবি না, সমুদ্রসৈকতে কী ভয়াবহ ঘটনা আমরা ঘটাতে যাচ্ছি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close