আলমগীর খোরশেদ

  ০৫ জানুয়ারি, ২০২৪

গ্রামীণ ঐতিহ্য

গরুর গাড়ি

গ্রামীণ জনপদে বাহন হিসেবে গরুর গাড়ি স্মৃতিময় একটি অনুষঙ্গ। ষাটের দশকেও যাদের জন্ম, শৈশব-কৈশোর কেটেছে পাখির কলরবে, নদী-বিলে জড়িয়ে রাখা ছায়াময় গ্রামে, তারা বলতে পারবে গরুর গাড়ি কী, কেমন ও এর ব্যবহার। তখন যাতায়াতব্যবস্থা ছিল হেঁটে বা গরুর গাড়িতে। সাইকেল সবার কাছে সহজপ্রাপ্য ছিল না। এমন এক দিন ছিল কৃষিপণ্য, মালামাল ও মানুষ বহনে একমাত্র বাহন ছিল গরুর গাড়ি। কাছাকাছি কোথাও মালামাল পরিবহনে ঘোড়া ব্যবহার হতো। দূরে পরিবহন করতে হলে ডাক পড়ত গরুর গাড়ি আনার। বিয়েতে বরপক্ষের লোকজন অনেক গরুর গাড়ি সাজিয়ে রওনা হতো। লাইন ধরে চলত গরুর গাড়ি। নিরাপত্তা বিধানে কয়েকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে গরুগাড়ির আগে-পেছনে অবস্থান নিত। বউ আনা-নেওয়ার জন্য, নাইওর যেতে আবদার থাকত গরুর গাড়ি।

গরুর গাড়ির ইতিহাস অনেক পুরোনো। নব্যপ্রস্তর যুগ থেকেই গরুর গাড়ি ব্যবহার হতো। ফ্রান্সের ফঁতান অঞ্চলে আল্পস পর্বতের উপত্যকায় একটি গুহায় গরুর গাড়ির যে ছবি পাওয়া যায়, তা বিশ্লেষণে জানা যায়, খ্রিস্টজন্মের ৩১০০ বছর আগে ব্রোঞ্জ যুগেও গরুর গাড়ির অস্তিত্ব ছিল। খ্রিস্টজন্মের ১৬০০ থেকে ১৫০০ বছর আগেই সিন্ধু অববাহিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল।

গ্রামে দেখেছি, আখভর্তি গরুর গাড়ি চলছে স্থানীয় সুগার মিলগুলোয়। সারা পাড়া বা গ্রামে গুটিকয়েক গরুর গাড়ি ছিল, ফলে আগে থেকেই শিডিউল দিতে হতো, অমুক দিন আমার গাড়ি লাগবে। মেয়েকে নাইওর আনতে বাবা-ভাইকে মেয়ের গরুর গাড়ির বায়না থাকত। ধান মাড়াইয়ের সময় ভাটি এলাকায় তখন ধানবোঝাই করে গরুর গাড়ির লাইন যেত গৃহস্থ বাড়িতে। গ্রীষ্মকালে কাঁঠাল, কলার ছড়ি, ধান, পাটবোঝাই করে বাজারে যেত গৃহস্থ। দূরের বেপারিরা ওইদিন এলে এসব পণ্যের ভালো দাম পেতেন কৃষকরা।

গরুর গাড়ি দুই চাকার একটি যান, যা গরু বা বলদ দিয়ে টানা হয়। লম্বা একটি লোহার ডান্ডা যাকে স্থানীয় ভাষায় ডলনা বলে, তাতে বড় বড় দুটো কাঠের তৈরি চাকা লাগানো থাকে। চাকাগুলোয় বাইরের দিকে গোলাকার লোহার রিম পরানো হয়। মবিল তেল লাগাতে হয় ডলনাতে, যেখানে চাকা ঘুরে, তাহলে আর ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হয় না। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’-এ গরুর গাড়ির বর্ণনায় দেখেছি- নায়ক দেবদাস গরুর গাড়িতে চড়ে পার্বতীর বাড়ির দিকে চলছে। তার শরীর খুব খারাপ। বারবার গাড়িয়ালকে জিগ্যেস করছে, ‘গাড়িয়াল ভাই আর কতদূর’? গাড়িয়াল উত্তরে বলছে, ‘এই তো বাবু, এসে গেছি।’ পথ আর ফুরায় না দেবদাসের।

গরুর গাড়ির সামনের দিকে হাল টানার মতো জোয়াল লাগিয়ে তাতে বলদ দুটো জুড়ে দেওয়া হয়। গরুর গাড়ির চালককে বলে গাড়িয়াল। এ নিয়ে অনেক সাহিত্য, গান রচিত হয়েছে। যেমন- ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই...কত আর রবো পন্থের পানে চাইয়া’...। ভাওয়াইয়া গানটি অনেক জনপ্রিয় হয়ে আছে। চালক সামনে বসেন আর যাত্রীরা পেছনে। রোদ, বৃষ্টিবাদল থেকে বাঁচতে গাড়িতে ‘ছই’ বানিয়ে দেওয়া হয়। গাড়ির পাটাতন বাঁশ বা কাঠের দ্বারা নির্মিত হতো। গ্রামের কৃষকরা তাদের ফসল পরিবহন ও ছেলেমেয়ের বিয়েতে গরুর গাড়ি ব্যবহার করতেন। গাঁয়ের বধূরা বাপের বাড়ি বা স্বামীর বাড়িতে গেলে গরুর গাড়িতে যেতেন। গাড়ির ছইসহ পুরোটা কাপড় দিয়ে ঘিরে পর্দা দেওয়া হতো। পিঠার ডেকচি, ছেলেমেয়ে, বউ যেত। পর্দার আড়ালে থেকে বারবার গাড়িয়ালকে জিজ্ঞেস করা হতো- ‘গাড়িয়াল ভাই, বসমতপুর আর কতদূর?’ গাড়িয়াল বলতেন, ‘মাগো ওইতো দেখা যায়, সামনের গেরামটা পেরোলেই।’

মেয়েটির অপেক্ষা যেন শেষ হতো না। ওই তো দেখা যায়, গাড়িয়ালের মিথ্যা আশ্বাস মেয়েটিকে আরো উতলা করে দিত।

কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে গরুর গাড়ি। আজকের প্রজন্ম জাদুঘরে যেতে হবে গরুর গাড়ি দেখার জন্য।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close