আফরোজা পারভীন

  ২৭ মে, ২০২২

জন্মদিন : শাহীন রেজা

কবিতার মতো একজন

দশক হিসেবে শাহীন রেজা আশির কবি। তবে আমি তাকে কোনো দশকে সীমাবদ্ধ করতে চাই না। তার কবিতার ব্যাপ্তি, আবেদন, বার্তা কোনো দশকে আটকে থাকার নয়। তিনি দেশের একজন প্রতিনিধিত্বশীল কবি। ১৯৬২ সালের ২৯ মে পিরোজপুরের পুখরিয়া গ্রামে তার জন্ম। নিরলস লিখে চলেছেন স্কুলজীবন থেকে। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত প্রথম বইয়ের নাম ‘অগ্নির স্রোতে জল।’

কবির সঙ্গে কবে, কখন পরিচয় হয়েছিল মনে নেই। তবে তার সঙ্গে পরিচয়ের আগে তার কবিতার সঙ্গে পরিচয় আমার। বলা চলে তার কবিতাই পরিচয়ের সেতুবন্ধটি বেঁধে দিয়েছিল।

শাহীনের কবিসত্তা জুড়ে থাকে মানুষ, প্রকৃতি, হৃদয়বৃত্তি। তিনি মনের তাগিদে চালিত হন। প্রেম আর প্রকৃতিতে লগ্ন হন তিনি। তাই তার কবিতায় হৃদয়ের অনুরণন পাই। কখনো জল ভরা মেঘ, কখনো রোদ্রের খরতাপ, কখনোবা বহতা নদী কিংবা ফসলি খেত তার কবিতায় ধরা দিয়ে আমাদের উন্মন করে দেয়। মনে হয়, জল ভরা মেঘ, বহতা নদী স্পর্শ করেছে আমাকে। শরীর স্পর্শ না করলেও মনে করে বলে এমনতরো বোধের জন্ম হয়।

শাহীনের একটি কবিতার বইয়ের নাম ‘খণ্ডিত মেঘের মুখ’। নামটি আমার অসাধারণ লেগেছে। আমি সারাটা জীবন ধরে মেঘের মাঝে মুখ মানুষ ঘর বাড়ি পাহাড় পর্বত সাগর খুঁজেছি। পেয়েছিও। আজও খুঁজি। শাহীনের খণ্ডিত মেঘের মুখেও অনেক কিছু পেলাম। যেমন পেলাম- ‘সন্ধ্যা যখন সন্ধ্যা হয়ে নামে/ঝুপ করে চাঁদ ডুব মারে তার জলে/আমি তখন রাতের বোবাপাখি/স্মৃতির শামুক কুড়াই কৌতূহলে!’

বড় বেশি সুন্দর। বড্ড আপন। সেই আকাশ, খণ্ডিত মেঘ, সন্ধ্যা রাত আর স্মৃতি, স্মৃতির শামুক। এমন আরো আরো কত মুগ্ধ করা কবিতা।

শাহীনের ‘নির্বাচিত ৫০ কবিতা’র বইটি পড়েছি সম্প্রতি। বইটিতে নির্বাচিত ৫০টি কবিতা ছাড়াও স্থান পেয়েছে শাহীন সম্পর্কে লেখা দশজন কবি, কথাকারের মূল্যায়ন। আহা মনে পড়ে কত কত মুখ। আলাউদ্দিন আল আজাদ, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন ও সাযযাদ কাদির। স্মৃতি মোড়ানো সেই দিনগুলো কী ফিরিয়ে আনা যায় না!

৫০ কবিতাতেও সেই মুগ্ধতা!

‘যার যা কিছু ছিল, নিয়ে গেছে/ঘ্রাণহীন ফুলগুলো এবং কয়েকটি বাদামের খোসা/পড়ে আছে স্টেজে!/এ রকমই হয়, সভা ভেঙে গেলে কলরবহীন মাঠে/শুধু উদাসী বাতাস, অজস্র ঝরাপাতার মগ্ন ওড়াউড়ি।’ (কবিতার মতো)। আমাদের এত জানা, এত দেখা, এত সত্য, এত স্বাভাবিক বিষয় শাহীন উচ্চারণ করলেন অক্লেশে, অবলীলায়! অথবা- ‘শহরের সবগুলো বৃক্ষ আমার নয়/আমাকে তাই বাধ্য হয়ে ধার করতে হয় ছায়া, কখনো কার্নিশের নিচে দাঁড়াই/উঁচু বাড়িগুলোও কাজে লাগে বেশ/আর মেঘের জন্য প্রতীক্ষা, সে তো সারা দিনের।/ব্যাংকের ভল্টে থাকা সবগুলো চকচকে নোট/যেমন একা কারো নয় তেমন বৃক্ষের ছায়াগুলোও।’

শেষ দুটি লাইন যেন জীবনের সারসত্য উপস্থাপন করেছে। এ কবিতা সমতার কথা বলে, ন্যায্যতার কথা বলে, মেহনতি মানুষের কথা বলে, না পেয়ে মার খাওয়া মানুষের কথা বলে! পাশাপাশি বলে অন্যকে মেরে যারা উঁচু দালান বানিয়েছে আর ভল্টে টাকা জমিয়েছে তাদের কথাও। এমন করে যিনি বলতে পারেন তিনিই তো কবি!

পৃথিবীব্যাপী মহামারির কবলে বিধ্বস্ত আমরা। কখন আছি, কখন নেই, সবই অনিশ্চিত! হারিয়ে গেল কত কত চেনা-অচেনা মুখ। চারধারে সবই যেন কালো। কালোপর্দা, কালোসময়। কবির কলম বিনাশী সময়ের এই ডাক অস্বীকার করে দৃঢ় প্রত্যয়ে বলে- ‘একটা কালো পর্দা দুলছে চোখের সামনে,/একটা কালো সময়.../মৃত মানুষের চোখ ঘোলাটে হয়; কুয়াশা-কুয়াশা/আমি তোমার দিকে তাকাচ্ছি, তুমি আমার দিকে/অথচ কেউ ভয় পাচ্ছি না; দুজন দুজনকে দেখতে/পাচ্ছি স্পষ্ট; সুবীর ময়রা মোটা চশমার মধ্য দিয়ে/যেভাবে দেখতে পেতেন লাল মোহনের রঙ।/আজ করোনাকালে হানা দিচ্ছে শিশুকাল; শৈশব/সূর্য ডুবলেই যেমন বাড়ি...বাড়ি/ফিরে যাবার ডাক এলে কেমন লাগে?’

এই কবিতার সুবীর ময়রা, তার মোটা চশমা আর লাল মোহনের মধ্য দিয়ে খুঁজে পেলাম মফস্বল শহর নড়াইলের কালি ময়রা আর তার রসে ডোবা পান্তুয়া, জিলাপি। কবিতা সর্বজনীন তখনই হয় যখন পাঠক কবিতার পঙ্ক্তিতে নিজেকে খুঁজে পায়, ফিরে পায়। আর এই করোনাকালে শৈশবই তো ডাকছে, যেমন সন্ধ্যে হলে বাড়ি ফেরার ডাক। কিন্তু কবি ফিরবেন না। তার হাতে বোশেকের আলতা, লাটাই। ওড়াতে চান জলের ঘুড়ি। আমরাও চাই একটি করোনা অতিক্রান্ত সুসময় যেখানে ফেরার ভয়ে তটস্থ থাকবে না বিশ্বমানবকুল।

আমাদের জীবনের পরতে পরতে, চাইতে না চাইতে যার অনুভব তিনি আমাদের রবীন্দ্রনাথ। আমাদের আশ্রয়, আমাদের প্রশ্রয়, আমাদের জীবনানন্দ। এই কবি এড়াতে কী পারেন বলেশ্বর নদীর পাড়ে যে কবির জন্ম তার ভালোবাসার চোখ! পারেন না। ‘তিনি ছিলেন তাই আমাদের জানালায় মুনিয়ার ঝাঁক, তিনি আছেন/বলেই কবিতার যৌবনে এত জৌলুশ।/রবীন্দ্রনাথ আমাদের ফুলের আগেই যেন বসন্ত, শব্দ সুরুয়ায়/ডোবা চাঁদ।’

অসাধারণ চিত্রকল্প, উপমা আর শব্দবিন্যাস। ‘শব্দের সুরুয়ায় ডোবা চাঁদ’ এক অদ্ভুত মায়াবী চাঁদ তুলে ধরে চোখের সামনে। রবীন্দ্রনাথকে বোঝার জন্য এই ছোট্ট কবিতার অল্প কিছু লাইন যেন বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর গভীরতা।

শাহীন রেজার কবিতা বাঙময়, প্রাণময়। তার কবিতা অন্তরে আঁচড় কাটে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close