মূল : মোহাম্মেদ আরাফাত * অনুবাদ : ফজল হাসান

  ২০ আগস্ট, ২০২১

ফিলিস্তিনি গল্প

মায়ের সঙ্গে কথোপকথন

আমি ইউএসএর ভার্জিনিয়ায় অবস্থিত পেন্টাগন থেকে সামান্য দূরে একটা ক্লিনিকে কাজ করি। প্রায় কয়েক মিনিট ব্যবধানে একটি হেলিকপ্টার মাথার ওপর দিয়ে বারবার চক্কর দিচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয়েছে যে, নিশ্চয়ই হেলিকপ্টার থেকে আমাদের দালানে বোমা নিক্ষেপ করবে। কিন্তু তারপর বুঝতে পারি, আমি গাজা থেকে ছয় হাজার দশ মাইল দূরে আছি। গাজায় আমার দশ সদস্যের পরিবার বসবাস করে এবং বর্তমানে তারা ইসরায়েলি আক্রমণের শিকার।

গাজায় ২০১৪ সালের ইসরায়েলি শেষ যুদ্ধের সময় আমি সেখানেই ছিলাম। একান্ন দিনের সেই বর্বর হামলা ছিল নির্মম ও বীভৎস। সত্যি বলতে কী, দূর থেকে তা দেখা ছিল কষ্টকর। সেই সময় আমার পরিবার ঝুঁকির মধ্যে ছিল এবং অসহায়ভাবে আমরা দেখতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু বর্তমানের এ সময় সম্পর্কে আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে, আমি যদি তাদের সঙ্গে থাকতাম এবং যদি মারা যাই, তাহলে আমরা সবাই একসঙ্গে মারা যাব। তাই অন্য কারোর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করার জন্য কেউ বেঁচে থাকবে না। বিশেষ করে এটা খুবই কঠিন, কেননা আমি জানি তারা আমাকে সবকিছু খুলে বলছে না। এ কথা সত্যি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজের জীবন সম্পর্কে আমার এমন কিছু বিষয় আছে, যা আমি তাদের বলি না। কেননা সেসব বিষয় বললে হয়তো তারা উদ্বিগ্ন হতে পারে। আমি নিশ্চিত যে, আমার সঙ্গেও তারা একই কাজ করছে।

গতকাল গাড়ি চালিয়ে কাজে যাওয়ার সময় আমার পরিবারের ‘হোয়াটস অ্যাপ’ গ্রুপের একটি ক্ষুদ্র সংবাদ আমার মোবাইলের পর্দায় ভেসে ওঠে। আমাকে ফোন করতে বলেছে, কেননা তারা এখন ইন্টারনেট সংযোগ পেয়েছে।

‘কেমন আছো, আদরের বাছা?’ আমার মা জিজ্ঞেস করেন।

‘মা, আপনাকে নিয়ে আমি বড্ড দুশ্চিন্তায় আছি। আপনারা সবাই কেমন আছেন?’ বেগুনি হিজাবে মোড়ানো মায়ের সুন্দর মুখের প্রতিটি বিবরণ কল্পনায় আনার চেষ্টা করার সময় আমি আমার প্রতিক্রিয়া জানাই। (আমি নিশ্চিত যে, তিনি হিজাব পরেছিলেন। কেননা তিনি জানেন যে, যদি কোনো বিপদ আসে, তবে তাকে দ্রুত বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে।) আমি কল্পনার জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে আনি, যেন আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ মাকে দিতে পারি।

মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে থাকার সময় আমি তার মুখে উদ্বেগ এবং হতাশা দেখতে পাই। আমি জানতাম যে, মায়ের এই অভিব্যক্তির পেছনে অনেক গল্প লুকিয়ে রয়েছে। তবে সেসব গল্প ঠিক কী বিষয়ে আছে, আমি পুরোপুরি তা বলতে পারব না।

মা কয়েক সেকেন্ডের জন্য বুঝতে পারেননি তাকে কোথায় আলাপ শুরু করতে হবে কিংবা আমাকে কী বলতে হবে। আমি জানতাম, সেই সময় তার মনের মধ্যে অনেক কিছু ঘুরপাক খাচ্ছিল।

‘আমরা ভালো আছি!’ অবশেষে মা মুখ খোলেন। তারা ভালো আছেন, কথাটা আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আমি মায়ের প্রচেষ্টাকে প্রশংসা করেছি।

‘না, আপনারা ভালো নেই, মা। আপনারা কী নিরাপদে আছেন?’

‘আমরা ভালো আছি, কিন্তু কে জানে কতক্ষণ ভালো থাকব।’ মায়ের কণ্ঠস্বর শুনে আমি বুঝতে পারি যে, আসলে মা ভয়ে আছেন। তবে তা শুধু তার নিজের জীবনের জন্য নয়, বরং আমার ভাই-বোনের জন্য, যারা আমাদের ভিডিও কলের সময় তার চারপাশে জড়ো হয়েছিল।

আমার মা আমাকে জানিয়েছেন যে, তারা তাদের পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, জন্মসনদপত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট, অন্যান্য নথিসহ তাদের দরকারি কাগজপত্র একটি ছোট ব্যাগে জড়ো করেছেন। কেননা যদি তাদের পালিয়ে যেতে হয়, তবে তারা যেন চটজলদি নিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন। গাজায় এটি একটি সাধারণ চিত্র। ২০১৪ সালের যুদ্ধের সময়, যখন আমরা আমাদের বাড়ি ছেড়ে বাবার-চাচার সঙ্গে তার বাড়িতে থাকতাম, তখন আমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ছাড়া বাকি সবকিছু বাড়িতে ফেলে গিয়েছিলাম।

গত বৃহস্পতিবার থেকে বাবা-মা আমার বিবাহিত বোন এবং তার ছয় সন্তানসহ ৪০ জনেরও বেশি আত্মীয়স্বজনকে আপ্যায়ন করেছেন। এখন, আমার চাচা এবং তার ৯ সন্তানের সঙ্গে, পারিবারিক ভবনটি ৬০ জনেরও বেশি লোককে আশ্রয় দিয়েছে। তারা সবাই নিরাপত্তা খুঁজছে।

মায়ের সঙ্গে আমার কথোপকথন অব্যাহত থাকে। তিনি আমাকে বলেছেন যে, ফ্রিজে তাদের কতটা খাবার রয়েছে এবং বিদ্যুতের অভাবের কারণে সেসব খাবারের কিছুটা কীভাবে নষ্ট হতে পারে। এই দুঃসহ আক্রমণ চলতে থাকলে শিগগিরই খাবারের অভাব দেখা দেবে।

আমি যখন মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন আমি যে মেডিকেল ক্লিনিকে কাজ করি, সেই ক্লিনিকের এক রোগীর বাবা তাদের ছেলের পরিচর্যা সম্পর্কে জানার জন্য ফোন করেছেন। ভদ্রলোক জানিয়েছেন যে, সেদিন তিনি এবং তার ছেলে ক্লিনিকে আসবেন না। কেননা তারা একঘেয়েমি লাঘব করার জন্য কোনো এক পার্কে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন।

আমি যখন গাজার শিশুদের কথা ভেবেছি, যাদের প্রতিদিন তাদের বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে মৃত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে, যাদের অনাথ করা হচ্ছে অথবা এখন যাদের পা বা হাত ছাড়া বাঁচতে হবে, তখন তাদের কথা মনে করে আমি কষ্ট পেয়েছি। আমি যদি সেই শিশুদের বাবা-মাকে বলতে পারতাম যে, ইসরায়েলি ড্রোন বা এফ-১৬ যুদ্ধ বিমানের বোমা বিস্ফোরণের বিকট শব্দ না শুনে গাজার শিশুরা একটি রাত ঘুমাতে চায়। আমি যদি সেসব বাবা-মাকে বলতে পারতাম যে, গাজার শিশুরা শুধু বেঁচে থাকতে চায় এবং তাদের যত্ন নিতে পারার মতো এমনও বাবা-মা থাকা চাই। আমি যদি শিশুদের বাবা-মাকে বলতে পারতাম যে, আমি বিচলিত এবং আমার রাগ হয়েছে। গাজার শিশুরা জানে যে, তাদের মৃত্যুর পালা শিগগিরই আসতে পারে এবং যদি তারা না হয়, তবে হয়তো তাদের পরিবারের অন্য একজন সদস্য হতে পারে।

বাবা-মায়ের বিরক্তিকর ছেলে হিসেবে আমি টেলিফোন রেখে দিই এবং কাঁদতে শুরু করি। অন্য প্রান্তে তখনো আমার মা ফোনের রিসিভার ধরে আছেন।

লেখক পরিচিতি : ফিলিস্তিনি তরুণ গল্পকার, ঔপন্যাসিক, কবি এবং ফ্রিল্যান্স লেখক মোহাম্মেদ আরাফাতের জন্ম ১৯৯২ সালে গাজায়। তিনি ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজা থেকে ইংরেজি সাহিত্যে গ্র্যাজুয়েশন করেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি তার একমাত্র উপন্যাস ‘স্টিল লিভিং দেয়ার’ প্রকাশ করেন। তার একাধিক ছোটগল্প ‘উই আর নট নাম্বার্স’ ওয়েবম্যাগে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় বসবাস করেন এবং সেখানে মাস্টার্সে পড়াশোনা করেন।

গল্পসূত্র : ‘মায়ের সঙ্গে কথোপকথন’ মোহাম্মেদ আরাফাতের ইংরেজিতে ‘অ্যা কনভারসেশন উইথ মাই মম’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি ‘উই আর নট নাম্বার্স’ ওয়েবম্যাগে ২০২১ সালের ২১ মে প্রকাশিত হয় এবং সেখান থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close