গাউসুর রহমান

  ২০ আগস্ট, ২০২১

আমিনুল ইসলামের কবিতার প্রবর্তনাসমূহ

কবি হিসেবে অনুভূতির সূক্ষ্ম রূপকার আমিনুল ইসলাম। তিনি যাপিত জীবনের শিল্পিত ভাষ্যকার। স্বজ্ঞা এবং প্রজ্ঞার অদ্ভুত মেলবন্ধন তার কবিতা। স্ব-সমাজ, স্ব-কাল তার কবিতায় অনিবার্যভাবেই ডালাপালা বিস্তৃত করেছে। মানবমনের আশ্রয় অন্বেষণ করেছেন আমিনুল ইসলাম। তার কবিতায় জীবনের মধুর যাপন যেমন আছে, তেমনি আছে জীবনের অন্তঃসারশূন্য অন্ধকার ও কৃত্রিমতা প্রসঙ্গ। প্রেমকে তিনি মিলিয়ে নিয়েছেন ব্যক্তি-অস্তিত্বের সঙ্গে। অব্যাহত আধুনিক এই কবি দীপ্র আত্মভাবনা আর রৌদ্রজ্বলা সমাজ-ভাবনাকে কবিতায় উপস্থাপন করে কোলরিজ কথিত ‘Sunny done’-এর বহির্বৃতিতে ‘Cave of ice’ মেলবন্ধন হিসেবে শব্দে শব্দে বয়ন করেছেন কবিতা। আমিনুল ইসলামের বিষয়-ভাবনা কেবল বিচিত্র বৈভবেই সমৃদ্ধ নয়, পাশাপাশি ইন্দ্রিয়ানুভূতির বিশেষ আবহে অন্তর্জগতের সংকোচন ও সম্প্রসারণে আত্মগত, মনজাগতিক রূপান্তরে সমৃদ্ধ। কবিতার নিরন্তর পরিব্রাজক, স্বদেশ-ভ্রামণিক কবি আমিনুল ইসলাম জীবন ও কবিতার উজ্জ্বল সিলুয়েট হিসেবে পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হন। ‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’, ‘সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ’ বহু বর্ণিল বিভায় দীপ্তিময় হয়ে উঠেছে তার কবিতায়। ফলে দেশপ্রেম, ইতিহাস-ঐতিহ্য চেতনায়ও সাঁতার কাটেন তিনি নিরন্তর। বহির্জীবনের প্রখর রোদ আর অন্তর্জগতের শিশির সম্পাতের অভূতপূর্ব সমন্বয় লক্ষ করা যায় তার কবিতায়। কবিতার জন্য নির্দিষ্ট একটি ‘কাব্যভাষা’ বা ‘Poetic diction’ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।

আমিনুল ইসলাম জানেন যে, সৌন্দর্য ও বিশ্বাসের প্রতিমা দেখা দিয়েই অন্তর্হিত হয়ে যায়। এজন্য তার কবিতার অন্যতম মৌলিক লক্ষণ হলো : ‘Emotional apprehension of thought’; তার কবিতা একই সঙ্গে দৃশ্যময় ও ধ্বনিময়। এই কবির কবিতার অন্যতম থিম হচ্ছে পরিবর্তমান দিন-রাত্রি। পাশাপাশি তার কবিতায় এসেছে ‘Various verse forms’ টুকরো টুকরো ছবি দিয়ে গাঁথা তার কবিতায় ‘Complex expressional rhythm’-এর স্বাদ পাওয়া যায়। গার্ডনার যেটিকে বলেছেন- ‘Complex expressional rhythm’ এরই বৈশিষ্ট্য আমিনুল ইসলামের কবিতায় স্বকীয় ভাষ্যে উদ্ভাসিত। কবিতাকে অর্থপ্রধান করতে গিয়ে আমিনুল ইসলাম কবিতায় ‘Meaning unit’-এর দিকে যেমন জোর দেন, তেমনি তাগিদ অনুভব করেন ভাবার্থ সংহত করার দিকে। কবিতায় বৈচিত্র্যে ও স্থিতিস্থাপকতার দিকে লক্ষ করেই তিনি এটি অবলীলায় করতে সক্ষম হন। আমিনুল ইসলাম তার কবিতার বক্তব্যের যে উপকরণগুলো সংগ্রহ করেন নিজের জীবন ও পরিপার্শ্ব থেকে- পাঠক যখন তা চিনতে শিখেন, তখন কবিতার শব্দ ও বধিরতা থেকে পাঠকদের রক্ষা করে এই চিনতে শেখা। তখন আমরা জীবন ও জগৎকে বিচিত্র উপায়ে প্রত্যক্ষীভূত করার মর্মার্থও অনুধাবন করতে পারি। এই অন্তর্লীন গভীর জীবনবোধের উৎসবকে আমরা পাঠককুল নিজেদের জীবনেও দৃশ্যমান হতে দেখি। তখন অন্তর্লীন চিরকালীনতাও চিহ্নিত হয়ে যায় তার কবিতায় :

‘আঁধারের হাতমোজা পরে পা ছুঁয়ে আছে কে?/যতবারই আগে বাড়ে পা-/ততবারই পেছন থেকে টান;/ধর্ম, রাজনীতি, সভ্যতা- কেউ স্বীকার করে না।/ভূত, যদি নেই, ও বিজ্ঞান, তুমিই বলো-/এই হাত কার? কে টানে পেছন থেকে?।’ (আঁধারের হাতমোজা পরা হাত; শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ)

আমিনুল ইসলামের প্রেমচেতনা অন্তরঙ্গ অনুভূতির বাণীরূপ হয়েও সামষ্টিক জীবনের সমগ্রতায় আবদ্ধ এবং তা অনিবার্যভাবেই। অন্যসব কবির মতো আমিনুল ইসলামও জানেন এবং মানেন যে, মানুষের সৃজনপ্রেরণার উৎস অবশ্যই সমাজ ও সময়। মানুষের সমাজচৈতন্য নির্মিত হয় মানুষের ভাবগত ও বস্তুগত উপকরণপুঞ্জের সুষম ঐক্যে। পরিবেশ-পরিস্থিতি সমাজসম্পৃক্ত হয়ে ব্যক্তির সৃষ্টিশীলতার উৎসলোক হিসেবে আবির্ভূত হয়। কারণ ব্যক্তির চৈতন্য কিংবা সামাজিক চৈতন্য নিঃসন্দেহে ‘Social product’. চেতনার এই সামাজিক নির্মিতিকে কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। আমিনুল ইসলামের কবিতায় ব্যক্তির বেদনা সমষ্টির বেদনা হয়ে যায়। মজ্জায় মজ্জায় কবি অনুভব করেন তার পরিবেশ-প্রতিবেশ। চৈতন্য ও ব্যক্তিস্বরূপকে আশ্রয় করে তার কবিতার জন্ম। সমাজ-সংসার তার কবিতায় কখনোই তামাদি হয়ে যায় না। সময়ের জ্বালা ও ব্যক্তিগত অন্তরপীড়ার রূপায়ণ ঘটে আমিনুল ইসলামের কবিতায়। ব্যক্তিগত ক্রন্দন তাই তার কবিতায় নৈর্ব্যক্তিক মহিমা পেয়ে যায়।

‘রাত-দিন অতঃপর দূষণেই বাঁচা; মানবতা এইসব ধুলোমাখা বাণী/শোনামাত্র দেহমনে বিবিধ অ্যালার্জি। আর কোনো ঔষধ মেলে না/ব্যর্থকাম একে একে ক্যাপসুল, ট্যাবলেট, নামিদামি যতসব তরলের/ডোজ, দুদকের মালিশেও সারে না বেমার! ফলে দেশ-দেশান্তরে/বুশের ইচ্ছার মতো রোগের বিস্তার; পৃথিবী সুসভ্য বলে এভাবে/চলে না। অতএব উচ্চমূল্য মেডিকেল বোর্ড, উচ্চকিত মতভেদ/তথাপি সিদ্ধান্ত- ছুরিকর্ম একমাত্র অবিকল্প পথ। শেষে মিত্রবাহিনীর/মতো কৃতকার্য ছুরিকাম; অথচ আশ্চর্য! আলসার টিউমার মূত্রাশয়ে/ অশ্মরী কোনোটাই নয়। চেরাপেটে পাওয়া গেছে সারমেয় লেজ।’ (ডায়াগনোসিস আফটার অপারেশন; স্বপ্নের হালখাতা)

যেকোনো বিবেচনাতেই কবির প্রতিভা সমাজায়ত। আর কবির প্রতিভার হিরণ্ময় ফসল কবিতা সেই প্রতিভাসঞ্জাত বস্তুজগতের শিল্পিত রূপান্তর। আমিনুল ইসলামের কবিতাও এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। তার কবিতা মানুষের চেতনা এবং সমাজবিন্যাসের উত্তরণের প্রেরণাশক্তি। আমিনুল ইসলাম ভালো করেই জানেন যে, বাক্স্পন্দের বৈচিত্র্য ও স্থিতিস্থাপকতা ছাড়া কবিতায় শিল্পিত সংযম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বলাবাহুল্য, আমিনুল ইসলামের কবিতায় এই শিল্পিত সংযম রক্ষা করার সচেতন প্রয়াস লক্ষ করা যায়। আমিনুল ইসলাম জানেন- প্রকৃতির সবকিছুই সময় বা গতির অধীন। কিন্তু এই সময় ও গতিকে ব্যবহার করে বিকল্প প্রকৃতিবিশ্ব রচনা করতে কবি অঙ্গীকারবদ্ধ। কারণ কবিতাকে তিনি করে তুলতে চান- ‘An object-in-itself’, ‘A self-contained universe of discourses.’ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকৃতি ছেয়ে থাকে আমিনুল ইসলামের কবিতা। তবে সব সময় প্রকৃতি প্রত্যক্ষ রূপ নিয়ে হাজির নাও হতে পারে কবিতায়। আমিনুল ইসলামের কবিতার ক্ষেত্রেও এমনটি লক্ষ করা যায়। আব্রামস্ তার ‘The Mirror and the Lamp’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন- ‘The key event in this development was the replacement of the metaphor of the poem an imitation, ‘a mirror of nature’ by that of poems as heteroecism, a ‘second nature’ created by the poet in an act analogous to Gods ‘creation of the World.’ আমিনুল ইসলাম তার কবিতায় উল্লেখ করেন- ‘যদিও লোমশ নয়, কিংবা বাঘের থাবার মতো নখরে সশস্ত্র নয়,/এই হাত অদ্ভুত আঁধারমাখা;/এই হাতের নগ্নকৈশোর একবার দেখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ,/আর আমি কমপক্ষে তিনবার স্বচক্ষে দেখেছি/তালুসহ পাঁচ আঙুলের প্রাপ্তবয়স্ক ছাপ/সংরক্ষিত আছে সম্রাট সংরক্ষিত ভিভিআইপি রেজিস্টারে।/অথচ ঐ নামগুলোতো জেনেছি, এই সত্য দাবি করি যদি,/চিলের মতো এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যায়/ভয়রঙের পাজরোভরতি দুঃস্বপ্নের কালো কালো সেপাই।’ (দুঃস্বপ্নের সেপাইয়েরা; জোছনা রাত বেদনার বেহালা)

সৌন্দর্যের অন্তরালেও চিরন্তন সৌন্দর্য এবং অসীম সৌন্দর্য আছে, ইন্দ্রিয়চেতনার পক্ষে তা আয়ত্ত করা অসম্ভব। মানুষের অন্তরতম আত্মাই এই সৌন্দর্যনুভূতির অধিকারী। কবিতায় কবি যে সংকেত ব্যবহার করেন, তা কোনোভাবেই ইন্দ্রিয়সর্বস্ব নয়- এ আবেদন অন্তরতম সত্তার কাছে। যখন কবি সংকেত ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠকের কল্পনা আবেগকে জাগ্রত করে দেন, তখন আমাদের অন্তরতম সত্তা বা আত্মা সেই চিরন্তন সৌন্দর্য দেখতে পায়। সংকেত বাইরের সৌন্দর্যের দুয়ার দিয়ে পাঠককে চিরন্তন সৌন্দর্যে এগিয়ে নিয়ে যায়, গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। এই বিশাল জগৎ, ব্যস্ত জীবনে যে অসীম, অদৃশ্য সত্য-সুন্দর বিরাজ করছে, আমাদের অন্তরতম সত্তা সংকেতের মাধ্যমে তার স্পর্শ পায়। স্মৃতির স্বপ্ন, প্রকৃতি ও নিসর্গের রূপপ্রভা আমিনুল ইসলামের কবিতাকে দিয়েছে দার্ঢ্য ও আধুনিক সংহতি। জীবনবাদী এই কবি বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের বিপরীতে জীবনের অনিকেত চেতনা, হতাশা, নিরাশা ও অবক্ষয়ের প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গকে কবিতায় তুলে আনেন অবলীলায়। বিষাদ, যন্ত্রণানুভব, স্বপ্নভারাতুরতা, আত্মকেন্দ্রিক পরিক্রমা, প্রতিবেশ-পৃথিবীবোধ আমিনুল ইসলামের নিরন্তর পদযাত্রাকে পৌঁছে দেয় নির্দয় পৃথিবীর অমানবিকতার কেন্দ্রে। সুন্দরের নিক্বণ-নিস্বনে তুমুল ও প্রগাঢ় এমন একটি মায়াবী জগৎ বসবাস করে আমিনুল ইসলামের মধ্যে। কিন্তু তাই বলে তার কাব্যজগৎ, মানবরহিত-নার্সিসীয়, এমন বলা যাবে না কিছুতেই। বাস্তববোধজর্জর কবিসত্তার মধ্যেও স্বাপ্নিক উদ্দামতার যাত্রা চলতে থাকে।

কবিতা আমিনুল ইসলামের কাছে আপন ভুবনের একান্ত সত্তা। ফলে তার কবিতা হয়েছে স্বকীয়তার প্রামাণ্য দলিল। তার কবিতার আবহমান বাংলার প্রকৃতি ও নিসর্গের রূপপ্রভার অন্তরালে রয়েছে এক ধরনের কাতরতা, এক ধরনের নিভৃতি অথচ গভীর বিষণ্নতা, এক ধরনের কোমলতা। কবিতায় কবি নিজেকেই অনাবৃত করেন নিজের কাছেই। তার কবিতায় যে গূঢ়তা আছে, তার উৎস হচ্ছে অতিগোপন রোজনামচার রস। নিজের সঙ্গে যেন নিজের কথোপকথন। আমিুনল ইসলামের কবিতায় ইতিহাসের প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ আছে, অতীতের নিবিড় কোলাহল আছে, বর্তমানের বিমূঢ় রূপতন্ময়তার কথা আছে। লোকজ ঐতিহ্য আমিনুল ইসলামের কবিতায় বিপুলভাবে সংবর্ধিত। কারণ বাংলার মৃত্তিকার সঙ্গে কবির যে জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক। নিসর্গ নিমগ্নতায় সমর্পিত এই কবি। প্রকৃতি নিসর্গের রূপদৃশ্যময়তাকে কবিতায় টেনে নিয়ে গেছেন আমিনুল ইসলাম। আবহমান বাংলা আর বাংলার প্রকৃতি-নিসর্গের শোভা, চিত্ররূপয়তা এই কবির আরাধ্য। কিন্তু এর মধ্যেও প্রবাহিত হয়েছে অজানা বেদনার গভীরতর ধারা, বেদনার ধারা। তা অনুসন্ধান করে লাভ করেছেন কবি প্রশান্তির হ্রদ। রূপদৃশ্যময়তার পাশাপাশি গূঢ় রহস্যময় অগ্রসরমানতা আমিনুল ইসলামের কবিতাকে দিয়েছে আলাদা মাত্রা ও আয়তন। আমিনুল ইসলাম তার কবিতায় সৃজনশীলতার প্রকৃষ্ট পরিচয়, নতুনত্ব, নিজস্বতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এজন্য তার কবিতাকে আঙ্গিক কুশলতায়ও সিদ্ধি অর্জন করতে হয়েছে। ভাষার বিচিত্র শক্তিকে তিনি নিজস্ব যোগ্যতায় আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। জীবনানুভূতি ও কাব্যানুভূতির স্বাতন্ত্র্যে আমিনুল ইসলাম হয়েছেন সমকালীন বাংলাদেশের একজন উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ কবি। এ ক্ষেত্রে তার নিজস্ব জীবনরুচি ও কাব্যরুচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close