প্রণব মজুমদার

  ২৩ এপ্রিল, ২০২১

শামসুজ্জামান খানের গল্পযাত্রা ও লোকসাহিত্য

শামসুজ্জামান খান (২৯ ডিসেম্বর ১৯৪০ - ১৪ এপ্রিল ২০২১)

জীবনকাল ৮৪ বছর। এরই মধ্যে ৬৯ বছরই সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা সৃজনে ব্যাপৃত ছিলেন তিনি। আমৃত্যু ধারাবাহিকভাবে নিমগ্ন ছিলেন বাঙালি সংস্কৃতি ঐতিহ্যের লোকজ পরিভ্রমণে। সাহিত্যের দীর্ঘ প্রান্তরে শাখা-প্রশাখায় শেকড় সন্ধানে মগ্ন চৈতন্যে আবিষ্ট থেকেছেন সৌম্য প্রকৃতিতে। সৃজনের ব্যাপ্তি এতটায় লম্বা ছিল যে, তার নামের আগে-পরে পদবি বা বিশেষণ অনেক যোগ হয়। শব্দের সমষ্টিতে আপাদমস্তক বাঙালি হিসেবেও শামসুজ্জামান খানকে সংজ্ঞায়িত করা যায়। তিনি জীবদ্দশাতেই ছিলেন কিংবদন্তি বরেণ্য সাহিত্য সাধক। তিনি গল্পকার, কবি, রাজনীতিবিদ, অধ্যাপক, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ব্যবস্থাপক, পৃষ্ঠপোষক, প্রশাসক, লোক কাহিনিবিদ, শিক্ষাবিদ ও গবেষক প্রভৃতি। এ প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে স্বল্প পরিসরে কী লেখা সম্ভব?

শিশুতোষ সাহিত্য, গল্প, প্রবন্ধ ও বাংলা লোকসাহিত্যের উৎস থেকে ইতিহাস ও ঐতিহ্যভিত্তিক গবেষণায় শামসুজ্জামান খানের মৌলিক কাজের সন্নিবেশিত গ্রন্থসংখ্যা সত্তরের বেশি। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে বর্তমান সময় অবধি বাঙালি সংস্কৃতির যে অভিযাত্রা, তার সুবিশাল রূপায়ণ হয়েছে তার লেখা বইয়ে।

কৈশোর বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু তার! বিদ্যালয় পড়াকালে যৌথ সম্পাদনায় বের করেন হাতে লেখা সাহিত্য পত্রিকা পূর্বাভাষ। গল্প লিখে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করলেও স্থিত হন প্রবন্ধ ও গবেষণায়। ১৯৫৭ সালে তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদের মুকুলের মাহফিলে, তা ছিল ভাষা শহীদ রফিকের জীবনভিত্তিক লাল শার্ট নামের একটি গল্প। গল্পটির বিষয় ছিল ভাষা আন্দোলনে প্রথম শহীদ রফিকের জীবন। শামসুজ্জামান খান রফিককে বেশ ভালোভাবে চিনতেন। দুজন একই এলাকা মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের মানুষ।

অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি উদার মানবতাবাদ, ইহজাগতিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং কুসংস্কার ও গোঁড়ামিমুক্ত আধুনিক জীবনবোধ শিরোধার্য করে তিনি সর্বদা লেখনী সঞ্চালন করেছেন। আজীবন ছিলেন মুক্তচিন্তার ধারক, বিজ্ঞানমনস্ক ও আধুনিক। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি, আকাশ সংস্কৃতির সর্বগ্রাসী প্রভাব এবং বিশ^ায়নের দাপটে বাঙালি সংস্কৃতি যখন অস্তিত্ব সংকটে, তখন শামসুজ্জামান খান ব্রতী হয়েছেন সেগুলোর অন্বেষণ অনুসন্ধিৎসা এবং সংরক্ষণের কাজে। বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতি, ফোকলোর, বাংলা সন, রস রচনা, শিশুসাহিত্য, জীবনী, ক্রীড়াবিষয়ক লেখা, ভ্রমণকাহিনি, ইতিহাস ঐতিহ্য মূল্যবোধ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ভাষা-আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, বঙ্গবন্ধুসহ নানা বিষয়কে সাবলীল ভাষাভঙ্গিতে তুলে এনেছেন তিনি। এর বাইরে রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতি এবং ধর্ম নিয়ে গভীর অনুসন্ধানধর্মী অনেক লিখেছেন। তার সাধনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বাঙালি মুসলমানের চিন্তা-চেতনার রূপ, রূপান্তর, সামাজিক অগ্রগতি ও সাংস্কৃতিক বিকাশ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জসীমউদ্দীন কিংবা মীর

মশাররফ হোসেনকে তিনি একেবারেই ভিন্ন আঙ্গিক ও উদ্ভাবনাময় স্বাতন্ত্র্যে উপস্থাপন করেছেন।

বাংলার লোকজ সাহিত্য থেকে বাঙালির উৎসব, রাজনীতি থেকে সংস্কৃতি, রাষ্ট্রচিন্তা থেকে ঢাকাইয়া রসিকতা, লোকগল্প, শামসুর রাহমান. শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক স্মারকগ্রন্থ, রবীন্দ্রসংগীত থেকে বাংলার গণসংগীত, ধর্মচর্চা থেকে ফুটবল বিশ^কাপ, গল্প, কবিতা, রূপকথা কোথায় নেই শামসুজ্জামান খান। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন সম্পাদনা ও প্রকাশের পেছনে তার ভূমিকা ছিল অসামান্য। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বই দুটির ভূমিকায় কৃতজ্ঞচিত্তে সে কথা উল্লেখ করেছেন।

সংবাদপত্রে এক সাক্ষাৎকারে শামসুজ্জামান খান তার কর্মজীবনে লোকসাহিত্যে অধিক মনোনিবেশের নেপথ্যে লোকসাহিত্য বিশারদ ও গবেষক অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিনের সান্নিধ্য লাভের কথা উল্লেখ করেছেন।

শামসুজ্জামান খানের উল্লেখযোগ্য কাজ হলো বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা শিরোনামে ৬৪ খ-ে ৬৪ জেলার লোকজ সংস্কৃতির সংগ্রহমালা সম্পাদনা এবং ১১৪ খন্ডে বাংলাদেশের ফোকলোর সংগ্রহমালা সম্পাদনা।

সাহিত্যে তার সৃষ্টি ছিল সব শাখায়। নিঃসংকোচে বলা যায়, তিনি সব্যসাচী লেখক। সব ধারায় তার পান্ডিত্য ছিল। সাহিত্যের মধ্যে তিনি শিশুসাহিত্যকে বেশি ভালোবাসতেন। শিশুসাহিত্যেও তিনি লোককথা সংযুক্ত করেছেন। ২০১৭ সালের ২৪ মার্চ। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চন্দ্রাবতী অ্যাকাডেমি থেকে প্রকাশিত শামসুজ্জামান খানের কিশোরসমগ্র প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন ছিল বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মিলনায়তনে। অসুস্থতার মধ্যেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এসেছিলেন শিশুসাহিত্যিক শামসুজ্জামান খানের ভালোবাসার টানে। চন্দ্রাবতী অ্যাকাডেমির উদ্যোগে আয়োজিত সে প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সব্যসাচী লেখক শামসুজ্জামান খান আক্ষেপ করে বলেছিলেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যপুস্তক শিশুদের জ্ঞানের জন্য যথেষ্ট নয়। ভালো শিশুসাহিত্যের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। প্রগতিমনস্ক সাহিত্য সারথির এমন মন্তব্য সমকালীন বাস্তবতা। ভবিষ্যতের সুন্দর দেশ বিনির্মাণে আমাদের শিশু-কিশোররা কী সঠিক পথে হাঁটছে? এটাও শামসুজ্জামান খানের চিন্তা ও গবেষণা কর্মের ফলাফল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close