হাফিজ উদ্দীন আহমদ

  ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯

ভ্রমণ

বিলাতে স্টোরি টেলিং শপ

দেশ ছাড়ার আগেই প্রেটিকে জানিয়ে রেখেছি, কোথায় কোথায় যেতে চাই। জবাবে প্রেটি বলেছিলÑ

: আব্বু, এসব তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও। আমিই তোমার ট্যুর প্রোগ্রাম সেট করবো।

আমি সানন্দে সায় দিয়েছিলাম।

আজ কাক্সিক্ষত ব্রিটিশ মিউজিয়াম দেখার দিন। আমাদের দেশে একসময় প্রচলিত ছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত যায় না। প্রায় পৃথিবীজুড়েই ছিল ব্রিটিশ রাজ্য। ছলে-বলে-কৌশলে পৃথিবীকে পদানত করেছিল তারা। তাদের অধীনস্থ কোনো দেশে সূর্য অস্ত গেলে, সময়ের পার্থক্যের জন্য তাদের অন্য দেশে হতো সূর্যোদয়। এক স্থানে দিন থাকলে অন্য স্থানে হতো রাত। এ জন্যই ছড়িয়ে পড়েছিল এ প্রবাদ। পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা তাদের বিপুল সাম্রাজ্যের যেখানে যে জিনিস তাদের আকর্ষিত করেছে, তাই তারা নিয়ে এসে এক জায়গায় জড়ো করেছে, তৈরি করেছে জাদুঘর। লোকে তাই বলে, ব্রিটিশ মিউজিয়াম দেখলে দুনিয়াই দেখা হয়ে যায়। সকাল ১০টা ৩০ থেকে বিকাল ৫টা ৩০ পর্যন্ত জাদুঘর খোলা থাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি, প্রেটি কিচেন রুমে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিছু পরেই ডাইনিং রুমে ডাক পড়ল আমারÑ

: আব্বু, নাশতা রেডি, খেতে আসো।

দেখি ইতোমধ্যে প্রেটির বর নাহিদ টেবিলে চলে এসেছে। একটু পরে প্রেটি কিচেন থেকে থালাবাটি হাতে বেরিয়ে টেবিলে আমার বিপরীত দিকে বসল। প্লেটে খাস্তা মচমচে পরোটা তুলে দিল সে। সঙ্গে খাবার জন্য বড় বাটিতে এই মাত্র দুধ দিয়ে তৈরি করা সুজির হালুয়া। মাঝে মাঝে তার পেস্তা, কিশমিশ উঁকি দিচ্ছে। দারুণ লাগছে খেতে।

: শাহজালাল (রহ.) ওর দরগাহর হালুয়ার লাখান লাগে।

বলল সিলেটি নাহিদ। পরোটা-হালুয়া ছাড়াও আছে ডিম, কমলা, আঙুর, আপেল, পিচ, ফ্রেশ মিল্ক, চা ও কফি। তৃপ্তির সঙ্গে ব্রেকফাস্ট খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম।

আজকে তাপমাত্রার অঙ্ক ভালোই। ১৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এটা খুব কম তাপমাত্রা নয়, তবে বিপদ ঘটিয়েছে প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস। ঝড়ের গতিতে তা বইছে। মনে হচ্ছে, শতসহস্র বরফের শীতল ছুরি বিদ্ধ হচ্ছে শরীরে। নাহিদ জানাল, হ্যারিকেন আলি চলছে। সম্ভবত কিংবদন্তি মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলির মুষ্টাঘাতের মতো তীব্র বায়ুপ্রবাহ বলেই তার নাম ব্যবহার করে ঝড়ের নামকরণ হয়েছে। শীতের প্রকোপে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ঘর থেকে বাইরে পা দেওয়ার সাহস হলো না। এবার একটু রোদ উঠেছে। রোদ উঠলেও শীত তেমন কমেনি। নাহিদ বলল, সে পোস্ট অফিসে যাবে। এ দেশের পোস্ট অফিস দেখতে হবে। আমি তার সঙ্গী হলাম। ১০টায় পোস্ট অফিস খুলবে। আমরা যেতে যেতে খুলে যাবে।

কালো রঙের ওডি সিক্স মুহূর্তে প্রাণ পেল নাহিদের হাতে। আমি ঠান্ডায় কুঁকড়ে আছি দেখে সে শুধু গাড়ির নয়, সিটের হিটারও অন করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে আসনে বসার ও হেলান দেওয়ার জায়গা কুসুম কুসুম গরম হয়ে সারা শরীরে আরামদায়ক অনুভূতি এনে দিল। কিন্তু তা শুধু সামান্যক্ষণের জন্য, কিছুদূর যেয়েই তার অটোগিয়ারের গাড়ি পার্কিংয়ে রেখে আমাকে নামতে ইশারা করল। আমরা ফুটপাত ধরে এগিয়ে চললাম। বেশ কিছুদূর হেঁটে যেতেই হাতের ডানদিকে পড়ল মাঝামাঝি আকারের খোলা মাঠ। নাহিদ চিনিয়ে দিলÑ

: ইটা অইলো বিনোদন পার্ক।

মাঠে চেয়ার-টেবিল পাতা। ইচ্ছা করলে বিকালে অফিস ছুটির পর এখানে বসে আড্ডা দেওয়া যায়। অদূরে এক কোনায় একটা ছোট দোকান। গালগল্পের ফাঁকে ফাঁকে সেখান থেকে যে কেউ চা-কফি, হালকা খাবার কিনে নিতে পারে। মাঠ অতিক্রম করে আরো কিছুদূর এগিয়ে যেতেই হঠাৎ নজরে এলো, ফুটপাতসংলগ্ন চমৎকার এক বুক শপ। রাস্তার দিকের দেয়াল পুরাটাই গাঢ় কাচের। তার মাঝে ছাগল, গরু, মাছ, বিড়াল, খরগোস, পাখি ইত্যাদির রং-বেরঙের জামা পরা দর্শনীয় কার্টুন আঁকা। ছবির নিচে লেখাÑ Art work by Axel Scheffler, copy right: Julia Donaldson and Scheffler 2017.

জুলিয়া ডোনাল্ডসনের বই এবং এর চিত্রশিল্পী : এক্সেল শেফলার। থ্রিডিতে রঙিনভাবে বইটিকে উপস্থাপনা করা হয় ভেতরে। বড় করে কাচের ওপর লেখাÑ A WORLD INSIDE A BOOK. Gruffalos, Dragons and other creatures.

জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত এটা চলবে লেখা। এরপর ছোট হরফে ম্যাকমিলান চিলড্রেন বুকস, স্কলাস্টিকা চিলড্রেন বুকস ও ম্যাজিক লাইট পিকচার্সকে সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়েছে। ইংল্যান্ডের আর্টস কাউন্সিলের আশীর্বাদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া ম্যারিয়া-ম্যারিনা ফাউন্ডেশনেরও সাহায্য পায়।

কাচের দেয়াল ভেদ করে বাইর থেকেই নজরে আসছে ভেতরে ঠাসা রং-বেরঙের অসংখ্য মনোলোভা শিশু-কিশোরের বই। বাহারি বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার পা আটকে গেল ফুটপাতে আঠার মতো। কোথায় যাচ্ছিলাম ভুলে গেলাম। সম্বিৎ ফিরে পেলাম নাহিদের কণ্ঠস্বরে। আমাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে সে বললÑ

: ইটা স্টোরি টেলিং শপ।

: স্টোরি টেলিং শপ?

এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। এ রকম কোনো দোকান আছে নাকি দুনিয়াতে, যেখানে অনূর্ধŸ আট বছর পর্যন্ত শিশুকে মজার গল্প শোনান একজন এবং নানা উপকরণ তথা অভিনয়ের মাধ্যমে তা জীবন্ত করে বাচ্চাদের চিত্তহরণ করেন। টিকিটের হার ৩-৭.৩৫ পাউন্ড। শিশুদের সঙ্গে পারিবারিক সদস্যরাও উপস্থিত থাকতে পারেন। কৌতূহল আর দমন করা গেল না। চম্বুকের মতো আকর্ষণ করল এটা আমাকে। দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লাম ভেতরে। থাকে থাকে সাজানো নানা ধরনের আকর্ষণীয় চিত্রযুক্ত বই। চারদিকে সাজানো মজাদার বই মুহূর্তে আমাকে অন্য জগতে নিয়ে গেল। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। দেখলাম, দু-একজন সুদর্শনা শ্বেতাঙ্গিনী সব তদারকির কাজ করছে। এখানে চমকপ্রদ শিশু কাহিনিগুলো কবিতা আবৃত্তির মতো আকর্ষণীয়ভাবে পাঠ করে ছোটদের শোনানো হয় ও সেই সঙ্গে অভিনয় করে দেখানো হয়। নানা চমকপ্রদ উপকরণ সহযোগে ছোটদের নাটকও মঞ্চায়িত হয়। শিশুরা তাদের কল্পনার চরিত্রদের হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে দারুণ মজা পায়। তবে চাঁদা দিয়ে সদস্য হতে হয়। শুধু সদস্যদের জন্য এটা উম্মুক্ত। খবর নিয়ে জানলাম, এখানে গল্প শোনানোর জন্য মিনিস্ট্রি অব স্টোরিজ আছে। সত্যি এটা বিস্ময়কর! গল্পের জন্য মন্ত্রণালয়! তাদের যে সেøাগান সেটা আরো আকর্ষণীয়-We champion the writer in every child ও লেখক তৈরি করার কি চমৎকার প্রচেষ্টা। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গল্প শোনানোর কাজে নিয়োজিত। এদের কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে ধারণা দেওয়ার জন্য সিটি একাডেমি নামে এ রকম একটি গল্প শোনানোর প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন তুলে ধরছিÑCity Academy, Date 17 Jan-14 Feb, Day: Thu, Time: 1900-21-30. Duration: 5 weeks, Tutor: Tim Faulkner, Venue: Urgang 2, EC1, Price: 238.00

ছোটবেলা যখন জামালপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে নিচের শ্রেণিতে পড়তাম, তখন কোনো বৃষ্টির দিনে ক্লাসে ছাত্র সংখ্যা কম হলে বা কোনো দিন নির্দিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে, অন্য কোনো শিক্ষক এসে তখন অপ্রস্তুত অবস্থায় না পড়িয়ে গল্প বলার সুযোগ দিতেন। একজন গল্প বলত অন্যরা শুনত। এখন বুঝি ছোটদের চিন্তাশক্তি এবং বলার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গল্প শোনা ও বলার গুরুত্ব অপরিসীম।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close