রহিমা আক্তার মৌ

  ৩০ আগস্ট, ২০১৯

বিরহের বিভোরে নজরুল

নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ/যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।

নারীর বিরহ দহনে জ্বলে-পুড়ে পুরুষ যেন নতুন করে সৃষ্টি হয়। আবার নারীর প্রেম-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে পুরুষ লাভ করে নবজন্মÑ এটাই জগতের নিয়ম। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। নজরুলকে কবি হিসেবে গড়ে তুলতে নারীর প্রেম, বিরহ যে বিশেষ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে, তা বলার অপেক্ষা থাকে না।

সবার জীবনেই প্রেম আসে, আর প্রেম যে সব সময় সার্থক হবে, তা কিন্তু নয়। বিরহ ও বঞ্চনা প্রেমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বর্তমান সময়ের প্রেমে ব্যর্থ হলে প্রেমিক-প্রেমিকার মনে ধ্বংসাত্মক কিংবা প্রতিশোধপ্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু আমাদের নজরুলের ক্ষেত্রে তা হয়নি, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বিরহকে সম্বল করে তিনি সাহিত্য রচনা করেছেন, ভারী করেছেন নিজের সাহিত্যের ভান্ডার। অন্তর্নিহিত প্রেমের আনন্দ অনেক সময় প্রাপ্তির আনন্দকেও ছাড়িয়ে যায়। প্রেমিকাকে পাওয়ার পর অনেক সময় না পাওয়ার বেদনা উপলব্ধি করা সম্ভব হয় না। নজরুল বারবার প্রেমে পড়েছেন, ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থ হয়েছেন বলেই আমরা এত সব বিরহী গান ও কবিতা পেয়েছি।

বহু বর্ণ, বহু বিচিত্র নারী চরিত্রের সংস্পর্শে এসেছেন নজরুল। তাদের ভালো বেসেছেন, ভালোবেসে বিরহে কাতর হয়েছেন, অশ্রু বিসর্জন করেছেন, কিন্তু ভালোবাসার ব্যক্তিকে অভিশাপ দেননি কখনো। পক্ষান্তরে সেই বিরহী মন নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন, লিখেছেনÑ ‘বিদায় সখি, খেলা-শেষ এই বেলা-শেষের খনে!/এখন তুমি নতুন মানুষ নতুন গৃহকোণে।’

পরিস্থিতি মোকাবিলায় মানুষ বিদ্রোহী হয় আবার বিরহী হয়। নজরুলের মাঝে এই দুই ছিল বিদ্যমান। সমসাময়িক অবস্থা বা প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করে সাহিত্যিকরা সাহিত্য রচনা করেন। কাজী নজরুল ইসলাম তার ব্যতিক্রম হবেন কী করে? দেশের এমন এক সংকটময় মুহূর্তে নজরুলের আগমন হয়েছে; যখন মুক্তি সংগ্রামের সেøাগান আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে। এ আন্দোলন-সংগ্রামের প্রভাব পড়েছে তার কাব্যে। দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়ার নেশায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন উন্মাদ। দেশমাতৃকাকে ভালোবেসে হয়েছেন মহাবিদ্রোহী। আবার ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষকে কাছে না পেয়ে তিনি হয়েছেন বিরহ বিভোর। তাইতো নজরুল মানুষের কবি, সাম্যের কবি, তার বড় পরিচয় তিনি সাম্যবাদী কবি।

নজরুলের জীবনে যে কয়েকজন নারী বিশেষভাবে প্রভাব ফেলেছিল। তাদের সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসা সম্পর্ক গড়ে উঠলেও সেসব প্রেম-ভালোবাসা পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেনি। আর তা থেকেই প্রেম-ভালোবাসার কবিতা ও গানে আনন্দ, আকাক্সক্ষা, বিরহ বেদনার সৃষ্টি ঘটিয়েছেন। অনেকের মতে, নজরুলের জীবনে প্রেম মূলত তিনবার এসেছিল। প্রথম প্রেম নার্গিস, দ্বিতীয় স্ত্রী প্রমীলা দেবী এবং তৃতীয় বেগম ফজিলাতুন্নেসা। তবে অনেক ক্ষেত্রে উমা মৈত্রের নামও ওঠে এসেছে। উমা মৈত্রের ডাকনাম ছিল নোটন। সে সময়কার ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের মেয়ে উমা। গান শিখাতে গিয়ে নজরুল নোটনের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন বলে অনেকের ধারণা। কেননা, কবির বিরহী প্রেমে নার্গিস-ফজিলাতুন্নেসার পাশাপাশি উমা মৈত্রের কথাও বলেছেন অনেকে। বলা হয়ে থাকে, উমা মৈত্রের কথা কবি তার ‘শিউলিমালা’ গল্পটিতে বর্ণনা করেছেন শিউলি নামে রূপকভাবে। এর মাঝে ফজিলাতুন্নেসার প্রতি কবির অনুরাগ কিংবদন্তিতুল্য। ভালোবেসে না পেয়ে লিখেছেনÑ ‘বুকে তোমায় নাইবা পেলাম, রইবে আমার চোখের জলে। ওগো বধূ! তোমার আসন, গভীর ব্যথার হিয়ার তলে।’ এভাবে নজরুলের অসংখ্য কবিতা ও গানে প্রেম ও বিরহ প্রকাশ পেয়েছে।

নারী ছাড়া নজরুলের কবিতা কল্পনা করা প্রায় অসম্ভব। তিনি নারী চরিত্রগুলো নিজের দুঃখে, অশ্রুজলে, হাসিতে, কান্নায় সৃজন করেছেন। নিজেই নিজেকে ভেঙেছেন, আবার নিজেই গড়েছেন। ‘নারী’ কবিতায় লিখেছেনÑ ‘বিশ্বে যা কিছু এলো পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি,/অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।/নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান?/তারে বলো, আদি পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।’

বিরহে কাতর হয়ে কবি তার রচিত অগ্নিবীণা কাব্যের অভিশাপ কবিতায় লিখেছেনÑ ‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে/অস্তপারের সন্ধ্যা তারায় আমার খবর পুছবে/বুঝবে সেদিন বুঝবে!’

কবির হৃদয়ে যে ভালোবাসা অংকুরিত হয়েছিল তা পরিপূর্ণতা পাওয়ার আগেই বিরহের সুর বেজে ওঠেছিল। বিরহ না থাকলে নাকি প্রেমের সার্থকতা হয় না, নজরুল প্রেম আর প্রেমের সার্থকতাকে বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন কাব্যে। কখনো তার বিদ্রোহের মাঝে প্রেম; আবার কখনো প্রেমের মাঝে বিদ্রোহ প্রকাশ করে, তাই বলে তিনি ব্যক্তিবিশেষের ওপর বিদ্রোহের প্রকাশ ঘটাননি।

বিরহ পুরুষকে কাঁদায় প্রকাশ্য অথবা গোপনে। অন্তরের কাঁদন অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণের দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে রায়। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ কবিতাটিতে বিরহী পুরুষের বোবাকান্নার করুণ ছবি তুলে ধরেছেন। অনেক প্রেমিক পুরুষ আছে যারা তাদের বিচ্ছেদ বেদনা কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারেন না। ভাবেন বন্ধুবান্ধব বা অন্য কোনো মানুষকে নিজের বেদনার কথা শোনালে নিজেকেই অন্যদের কাছে উপহাসের পাত্র করে তোলা হবে। নজরুল ছিলেন তার ব্যতিক্রম। মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, দেব খোঁপায় তারার ফুল, প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই, মিলন-রাতের মালা হব তোমার অলকে, বুলবুলি নীরব নার্গিস-বনে, যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই, মোরা আর জনমে হংস-মিথুন, গভীর নিশিতে ঘুম ভেঙে যায়-এর মতো অসংখ্য প্রেমের গানে তিনি নিজের বিরহের কথা প্রকাশ করেছেন। হয়তো নজরুল বলেই তা সম্ভব হয়েছে।

নারীর ভালোবাসায় নজরুল কবি হয়ে উঠেছেন। এমন স্বীকারোক্তি লক্ষ করা যায় তার ‘কবি-রাণী’ কবিতায়। এক কবিতায় তিনি বলেছিলেনÑ ‘প্রেমের পরশে প্রত্যেকেই কবি হয়ে ওঠে।’ তিনি আরো বলেছেনÑ ‘তুমি আমায় ভালোবাস তাইতো আমি কবি।/আমার এ রূপÑ সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি।’

নজরুল ইসলামের কাব্যে প্রেম বা রোমান্টিসিজম সম্পর্কে বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেছেনÑ ‘প্রকৃতির মাঝে আত্মভাবের বিস্তার এবং একই সঙ্গে প্রকৃতির উপাদান সান্নিধ্যে অন্তর ভাবনার উন্মোচন রোমান্টিক কবির সহজাত বৈশিষ্ট্য। ‘চক্রবাক’ কাব্যে নজরুলের এই রোমান্টিক সত্তার প্রকাশ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ইতোপূর্বের কাব্যসমূহেও আমরা নজরুলের প্রকৃতি চেতনার পরিচয় পেয়েছি কিন্তু ‘চক্রবাক’-এ এসে লক্ষ করছি, এখানে প্রকৃতি নজরুলের প্রজ্ঞাশাসিত ও অভিজ্ঞতালব্ধ মানসতার স্পর্শে এসে হয়ে উঠেছে সংযত, সংহত এবং শূন্যতা তথা বেদনার প্রতীকী ধারক।’

নজরুলের কাব্যগ্রন্থে প্রেমের নিবিড়তা, চিরন্তনতা এবং বিচ্ছেদের তীব্র জ্বালার প্রকাশ দেখা যায়। সিন্ধুর অশান্ত রূপ কবিচিত্তের বিচ্ছেদ জ্বালা পথিকের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। কবি বলেছেনÑ ‘এক জ্বালা, এক ব্যথা নিয়া/তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদে মোর হিয়া।’

নার্গিসের চিঠির উত্তরে নজরুল লিখেছিলেনÑ ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই, কেন মনে রাখো তারে, ভুলে যাও ভুলে যাও তারে একেবারে’।

নজরুলের বিরহের বিখ্যাত অনেক গানের মাঝে এটি একটি। নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে কবি চক্রবাক কাব্যে বেশ কয়েকটি বিরহের কবিতা লিখেছিলেন। চক্রবাক কাব্যগ্রন্থই সেই বিরহ সত্তার জ্বলন্ত ও জীবন্ত নিদর্শন। এই কাব্যের প্রায় প্রতিটি কবিতার অভিব্যক্তি ও বিরহের সুর হৃদয়কে স্পর্শ করে। এর প্রথম কবিতা ‘তোমারে পড়িছে মনে’ কবির গভীর বিরহানুভূতির প্রকাশ। লিখেছেন ‘হার-মানা-হার।’ তাদের প্রেমের বয়স ছিল মাত্র দুই মাস। এই দুই মাসের প্রেমের সময়কালে তিনি নার্গিসকে নিয়ে লিখেছিলেন ১৬০টি গান ও ১২০টি কবিতা। ১৯৩৭ সালে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। যদিও কেউ কেউ বলেনÑ নজরুল আর নার্গিসের বিয়েই হয়নি, বিয়ের অনুষ্ঠান থেকেই অভিমান করে নজরুল উঠে চলে যান। ভালোবেসে নার্গিসকে নিয়ে যেমন লিখেছেন, আবার নার্গিসের বিরহে ও কবি অনেক বিরহী গান রচনা করেন।

নারীর উৎসাহ-প্রেরণা ও প্রেমের মহিমা তাকে বিদ্রোহী হতে উৎসাহ জুগিয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়ও তার প্রেম প্রকাশিত হয়েছে। নারী হৃদয়ের ব্যর্থতা, ক্ষোভ ও বাসনাকে কবি নিজের বিদ্রোহের উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছেন। নজরুলের সর্বাপেক্ষা অমূল্য সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা এর উদাহরণ। ‘আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণি, তন্বী-নয়নে বহ্নি/আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!/আমি উন্মন মন-উদাসীর/আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর।’

কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত একটি আধুনিক গান ‘সাঁঝের পাখিরা ফিরিল কুলায়, তুমি ফিরিলে না ঘরে।’ এই গানে নজরুল একজন সাধারণ গেরস্ত প্রকৃতির মানুষের প্রিয়তম জীবন সঙ্গিনীকে হারানোর কান্না উপস্থাপন করেছেন। বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তার জীবনে দ্রোহের সঙ্গে সঙ্গে যে প্রেমের প্রকাশ ঘটেছে, তারই অনুরণন ঘটেছে তার প্রেম পর্যায়ের গান ও কবিতায়। নজরুলের প্রেম পর্যায়ে এসব গান ও কবিতা চিরকালীন অনুষঙ্গে ভাস্বর। প্রেমিক কবি নজরুলের এই পর্যায়ের গান ও কবিতা আজকের প্রেমিক-প্রেমিকাদের হৃদয়তন্ত্রীকে প্রেম-ভালোবাসা এবং বিরহ-বেদনায়

অনুপ্রবেশ ঘটায়।

কবির হৃদয়ে যদি বিরহের সুর না বাজত, তাহলে হয়তো কালজয়ী কিছু গান ও কবিতা সৃষ্টিই হতো না। নজরুলের প্রেম ও বিরহ নিয়ে লেখা গান, কবিতা ও গল্প বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে; যা চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। নারীদের সমান অধিকারের কথা যেমন নজরুল বলেছেন, তেমনি করে তার কবিতায় সেই একই উত্তরের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন। এজন্য সেসময়ে পুরুষরা তাকে ভাবত নারীবাদী, নারীঘেঁষা কবি। কবি নিজেই তার কবিতায় তুলে ধরেছেনÑ ‘নর ভাবে আমি বড় নারীঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী বিদ্বেষী!’ (কৈফিয়ত; সর্বহারা।)

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close