মামুন মুস্তাফা

  ০৫ এপ্রিল, ২০১৯

চিহ্নকথা

চিহ্ন মানে একটি স্মারক, একটি স্বাক্ষর, একটি দাগ। যে দাগ রয়ে যায় মনে, মননে, সমাজে কিংবা রাষ্ট্রে। চিহ্ন ওই নামাঙ্কিত দাগ প্রোথিত করে গেছে জনমানুষে। কারা সেই জনমানুষ? বস্তুত লেখক-পাঠক এবং ছোটকাগজের সম্পাদকদের চিন্তার জায়গাটিতে নাড়া দিয়ে গেছে নানাভাবে। এমনকি সীমানা ছাড়িয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে তো বটেই, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের লেখক-পাঠক ও ছোটকাগজের সম্পাদকদের কাছে চিহ্ন আজ এক বরণীয় নাম।

লিটল ম্যাগাজিনে প্রথমত তরুণরাই লিখে থাকেন এবং তাদের প্রথাবিরোধী ও আপসহীনতাই ছোটকাগজের বৈশিষ্ট্যকে প্রধান করে তোলে। কিন্তু সাহিত্যের জন্য সৃজনশীলতাই মুখ্য। বাংলাদেশে আক্ষরিক অর্থে সে রকম ছোট সাহিত্যকাগজের অস্তিত্ব কতখানি, তা বিবেচনার বিষয়। বিক্ষিপ্তভাবে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে বেশ কিছু নিয়মিত-অনিয়মিত ছোটসাহিত্যের কাগজ চোখে পড়েÑ যার কোনটি কবিতার, কোনটি গদ্যের, আবার কোনটি কবিতা এবং গদ্য দুটোকেই অঙ্গীভূত করেছে। কিন্তু তার প্রকৃত সাহিত্যমূল্য কতটাÑ সেটির তুলনামূলক বিচার অপরিহার্য। কালের সেই বিচারে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত চিহ্ন আজ উভয় বাংলার লেখক-পাঠকের কাছে নিজেকে গ্রহণীয় করে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও সময়ের নিষ্ঠ প্রাবন্ধিক শহীদ ইকবালের সম্পাদনায় প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি ও আগস্টে নিয়মিত প্রকাশিত হয় মননশীলতায় ঋদ্ধ ছোটকাগজ চিহ্ন। সেই ২০০০ সাল থেকে প্রকাশিত হয়ে আসা ছোটকাগজ চিহ্ন দুই যুগ অতিক্রমের দ্বারপ্রান্তে। বলা যায় প্রায় একটি যুগ ধরে আমি এর সাফল্য-ব্যর্থতা খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করেছি। একটি দেশের সভ্যতার মাপকাঠি তার সাহিত্য, তার কৃষ্টি। সেই সৃজনশীলতা রক্ষার জন্য নিবেদিতপ্রাণ চিহ্ন সম্পাদক শহীদ ইকবাল। তার শ্রমসাধ্য একনিষ্ঠতায় চিহ্ন আজ ফাউন্ডেশন। আবার চিহ্ন একটি প্রকাশনা সংস্থাও বটে।

যদিও বাংলাদেশে পশ্চিমবঙ্গের ‘কবিতীর্থ’ (১৯৮২)-এর মতো ছোটকাগজকে কেন্দ্র করে সে-রকম কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারেনি, ব্যতিক্রম শুধু ‘সমকাল’ (১৯৫৭)। ‘সমকালে’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর ‘সমকাল’ পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি গড়ে তোলেন ‘সমকাল প্রকাশনী’। যেখান থেকে প্রকাশিত হয়েছে আবদুল হকের প্রবন্ধের বই ‘ক্রান্তিকাল’, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কবিতার বই ‘দুর্লভ দিন’-এর মতো সাহিত্যগ্রন্থ। তবে আজকাল প্রায় সব ছোটকাগজই দায়সারাভাবে নিজেদেরকে যুক্ত করছে প্রকাশনার সঙ্গে; যেখানে বাণিজ্যই প্রধান। সেই অবস্থান থেকে চিহ্ন অবশ্যই ব্যতিক্রম। ফাউন্ডেশন হওয়া সত্ত্বেও আজও আর্থিক দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে না পারায় চিহ্ন প্রকাশনা, প্রকাশনার সকল চাহিদা পূরণ করে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হচ্ছে না।

সত্তর দশকের শেষভাগেই লিটল ম্যাগাজিনগুলো সংকটে পড়ে। সংকটের কারণ ত্রিবিধ। প্রথমত. ছোটকাগজের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম ও সততার অভাব; দ্বিতীয়ত. মুদ্রণব্যয়ের গগনচুম্বিতা এবং তৃতীয়ত. বিজ্ঞাপনপ্রাপ্তির দুরূহতা। এই অবক্ষয়ের ধারা চলেছিল মধ্য আশি পর্যন্ত। তত দিনে রম্য পত্রিকার প্রতি তরুণ লেখকদের মোহমুক্তি ঘটতে শুরু করেছে। ফলে মধ্য আশিতেই একটি দুটি করে শুরু হয় লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশের চেষ্টা। আশির দশকের শেষে এসে আমরা পেয়ে যাই ভিন্ন ভিন্ন রুচির বেশ কয়েকটি ছোটকাগজ। আর নব্বইয়ের দশক বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী ঘটনা। আশির দশকের প্রায় মধ্যভাগে যার যাত্রা শুরু অথচ পরিপূর্ণতা লাভ করে নব্বইয়ের দশকে এসে। বর্তমানে বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন বা ছোটকাগজ স্পষ্টতই দুটো ধারায় বিভক্ত। প্রথম ধারাটি সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ, যার সত্যতা এর লেখাগুলো প্রমাণ করে। দ্বিতীয় ধারাটি সম্পাদক ও লেখকের আত্মপ্রতিষ্ঠার গোপন ইচ্ছাকে লালিত করে, এ ধারার পত্রিকার লেখাগুলোর দিকে তাকালেও তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শহীদ ইকবালের চিহ্ন স্পষ্টতই প্রথমধারার পঙ্ক্তিতে আসীনÑ তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

বস্তুত ছোটকাগজে সেসব লেখাই স্থান পাওয়া উচিত, যা বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক উভয় ক্ষেত্রেই মৌলিক এবং প্রচলিত ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন চিন্তাচেতনার উদ্ভব ঘটাবে। তা না হলে লিটল ম্যাগাজিনের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে এবং পাঠকের অনাগ্রহের কারণে তার অপমৃত্যুও ঘটতে পারে। সুতরাং যারা এসব কাগজের সঙ্গে জড়িত, তাদেরকে লিটল ম্যাগাজিনের উদ্দেশ্যকে বিবেচনায় রাখতে হবে। ছোটকাগজ দর্শন উপস্থিত করে, তত্ত্ব নির্মাণ করে। তত্ত্ব ভাঙে এবং বিনির্মাণও করে। ছোটকাগজের লেখা যদি চিন্তা ও চেতনায় বড়কাগজের লেখা থেকে স্বতন্ত্র না হয়, যদি সে একই স্রোতে ভাসে, তবে তার অবস্থান উদ্দেশ্যহীন এবং অর্থহীন হতে বাধ্য। এই কথাগুলোকে মেনে নিয়েই চিহ্ন দুই যুগ পূর্তির অপেক্ষায়।

যুগপূর্তি উৎসবের ভেতর দিয়ে ‘চিহ্নমেলা’র যাত্রা শুরু হয়েছিল। ২০১১ সালে সেই উৎসবে চিহ্ন ছোটকাগজসহ সৃজনশীল ও মননশীল শাখায় দুজন ঋদ্ধ কবি-লেখককে সম্মাননা জানায়। তারপর থেকে প্রতি তিন বছর পর পর চিহ্ন দুই দিনব্যাপী ‘চিহ্নমেলা’র আয়োজন করে এবং একইভাবে অপ্রয়োজনীয় হইহুল্লোড় এবং আত্মপ্রচারের নগ্ন ফায়দাবাজির বিপরীতে নীরবে-নিভৃতে যেসব লেখক-সম্পাদক সাহিত্যের সেবক হিসেবে নিজেদের নিবিষ্ট রেখেছেন, তাদেরকে খুঁজে বের করে ছোটকাগজ সম্পাদনা এবং সৃজনশীল ও মননশীল শাখায় পুরস্কৃত করে থাকে। আজ এ উৎসব উভয় বাংলাকে নিয়ে উদযাপিত হয়ে থাকে। আর এখানেই ‘চিহ্ন পরিবার’-এর সার্থকতা।

অতীত থেকে প্রেরণা ও শিক্ষা নিয়ে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে যে ছোটকাগজটি সৃজনশীল নবীন-প্রবীণ লেখকদের সম্মিলন ঘটিয়েছে এবং সাহিত্যের মননশীলতাকে এক অন্যধারার উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, তার নাম চিহ্ন। এই ছোটকাগজটিকে নানা সমাহারে সার্বভৌম হয়ে উঠতে দেখি এর পাঁচ লেখকের মুখোমুখি, চিহ্নমেলা এপার বাংলা-ওপার বাংলা, আমার রবীন্দ্রনাথ, কথাশিল্পের কারুকর্ম, কবিতা সংখ্যা, বাঙালি মুসলমানের চিন্তা-চর্চার দর্শন, পোস্টমর্ডানিজম সংখ্যাগুলোতে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে যে বাংলা গদ্যের সূচনা তার আজকের অবস্থানকে চিহ্ন নির্ণিত করে কথাশিল্পের কারুকর্ম-এর বর্ণাঢ্য আয়োজনে। শতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়নে চোদ্দ শতকের লেখকগণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন আমার রবীন্দ্রনাথ-এ। আবার বাঙালি মুসলমানের চিন্তা-চর্চার দর্শন-এর ভেতর দিয়ে বাঙালি মুসলমানগণের চিন্তার মানসজগত আবিষ্কারে ব্রত চিহ্ন পাঠকের সামনে মেলে ধরে ইতিহাস ও সমাজসচেতন চেতনালোক, কল্পনা-প্রতিভা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই বিচিত্র রসবোধে উজ্জীবীত চিহ্ন ছোটকাগজ চিহ্ন প্রকাশনার ভেতর দিয়ে আজ সে নিজেই প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

আর চিহ্ন ছোটকাগজের অন্তরালে যিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষতায় সম্পাদনার পাশাপাশি অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশ-বিদেশের বাংলা ভাষাভাষী প্রতিশ্রুতিশীল কবি-লেখকদের মিলনমেলার আয়োজনসহ তাদের শ্রেষ্ঠত্ব বিচারে সম্মাননা জানাতে কুণ্ঠাবোধ করেন না, তিনি চিহ্নপ্রধান, ঋদ্ধ প্রাবন্ধিক শহীদ ইকবাল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বহুমুখী রসবোধে উদ্দীপ্ত চিহ্ন ছোটকাগজের সম্পাদক শহীদ ইকবালের প্রতি রইলো অকুণ্ঠ সমর্থন। চারদিকের ফন্দিফিকির আর স্ট্যান্টবাজির সাহিত্যকর্মের বাইরে দাঁড়িয়ে নিরলসভাবে সাহিত্যের ঐতিহ্যকে তিনি ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন বলেই আজ চিহ্ন দাঁড়িয়ে আছে ‘চিহ্ন ফাউন্ডেশন’ হিসেবে। এর অগ্রযাত্রা দীর্ঘায়ু হোক।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close