নাজমুল ইসলাম

  ০২ মার্চ, ২০১৮

বরফে গপ্পবাজি

আজ ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন। শুয়ে আছি বরফে আবৃত এক টুকরো রাজপ্রাসাদে। রিমঝিম করে তুষার পড়ছে চারপাশে। ভেলি গাছের সবুজ পাপড়িগুলোর ওপর জমাট বেঁধেছে একগাদা বরফ। আমি দরজার ওপাশে, বিছানায় শুয়ে এদিক-ওদিক হচ্ছি বারবার। মাথায় কিলবিল করছে শব্দমালা। মন চাচ্ছে বাক্যের ফুলঝুড়ি আর সরলশান্ত শব্দের গাঁথুনির স্নিগ্ধতা দিয়ে মোহনীয় করে দিই পুরো পৃষ্ঠাকে। কিন্তু না! ভুরি ভুরি বিচিত্র আর যন্ত্রণাদগ্ধ অনুভ‚তি এবং আকাশস্পর্শী স্বপ্নের এভাবে মুহূর্তেই ইতি টানব না। এসব ভাবতেই দোস্ত মারুফ ডাক দিল। কিরে উঠবি না, বাইসারান (মিনি সুইজারল্যান্ড) যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। চোখ মেলেই দেখি দরজার সামনে গাড়ি প্রস্তুত। জিজ্ঞেস করলাম, এই গাড়িতে করেই যাব নাকি? ওপাশ থেকে সাজ্জাদ বলল, আরে নাহ! ওখানে গাড়িতে করে আবার যাবে কেমনে। ঘোড়ায় চড়ে যেতে হবে। পাশ থেকে নাঈমের হাসিটা চরম লাগছিল। ঘোড়ায় করে! এত টাকা কই পাব। বাইসারান ঘোড়ায় করে যেতে হলে প্রত্যেককে গুনতে হবে হাজার রুপি। দাদা রাশেদ; খুব চঞ্চল টাইপের। যার চঞ্চলতা আমাদের ভ্রমণকে দিগুণ আনন্দিত করেছিল। বলল, আসছি এন্টারটেইনমেন্টের জন্য, হেঁটেই যাব। তাছাড়া বরফে হাঁটব আর গপ্পবাজি করব সেটাওতো কম না। হুম, মারুফের এক ধমকেই সবাই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ডিএসএলআর হাতে আসলাম ভাই খুব মজার মানুষ। অনবরত ক্লিক করছেই। সঠিক পোজে ক্লিক হচ্ছে কি না, সেটা দেখার সময় নেই। আমরা এগোতে থাকলাম, স্বপ্নপুরির দিকে। ১০ ফিটের রাস্তা পুরো ছয় ফিট গিলে ফেলছে বরফে। এভাবে মিনিট দশেক হাঁটার পর নজরে পড়ল বরফে মোড়ানো পর্বতশৃঙ্গ এবং পাইন গাছের সবুজ ভ্যালিগুলো। দেখতে খুবই মনোরম।

আগ থেকেই জানতাম, কাশ্মীরের পেহেলগাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জলবায়ু, ক্যাম্পিংসহ বলিউডের মুভি দৃশ্যের শুটিংয়ের জন্য বিখ্যাত। এ জন্যই বোধহয় এখানে পর্যটকদের এতো ভিড়। তাছাড়া কাশ্মীর ভ‚স্বর্গ বলে কথা! যেখানে যেয়ে স্বয়ং মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর নাকি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে যদি কোথাও স্বর্গ থাকে, তবে তা এখানেই আছে, এখানেই আছে এবং এখানেই আছে।’ এমন জায়গায় কে না যেতে চায়? আমাদের ভ্রমণেরও সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য ছিল পেহেলগাম। যেখানে একসঙ্গে আছেÑ লিডার নদী, পেহেলগাম ভ্যালি, বেতাব ভ্যালি, আরু ভ্যালি, চন্দনওয়ারি, পেহেলগাম ভিউপয়েন্ট, বাইসারান, ধাবিয়ান, কাশ্মীর ভ্যালি ভিউপয়েন্ট, কানিমার্গ, ওয়াটারফল, তুলিয়ান ভ্যালি, মামলেশ্বর মন্দির, কোলাহাই হিমবাহ ইত্যাদি। প্রতিটি স্থাপনায় ঘোড়া এবং হেঁটে যাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে গোড়ায় চড়লে একটু কষ্ট কম ও অ্যাডভেঞ্চার হয়। আমরা হেঁটেই সামনে এগোতে থাকলাম। একে তো ঠাÐা আবার বরফ গলা পানি জমে পাহাড়ের মাটি ও পাথুরে রাস্তায় কাদা তৈরি হয়ে পাহাড়ে আরোহণ অসম্ভব হয়ে পড়ছে সবার। কনকনে শীতে সবাই হা-হু করছে। এ ছাড়া পর্বত বেয়ে ওপরে উঠতে ছিল চরম ভয়ও। পদে পদে ছিল ভয়ের সঙ্গে রোমাঞ্চকর অ্যাডভাঞ্চার; যা সারা জীবন মনে রাখার মতো একটি জার্নি। সৃষ্টিকর্তার পরিচয় তার অপরূপ সৃষ্টিতে সেটা দেখতে হলে কাশ্মীর আপনাকে যেতেই হবে। আমরা হাঁটলেও অনেক বিদেশি পর্যটক ঘোড়ায় করে চ‚ড়ায় উঠছেন। আল্লাহপাক এই পশুটিকে যে অসাধারণ ক্ষমতা প্রদান করেছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাদা-কালো বিদেশি পর্যটকরা ঘোড়ায় করে এগোচ্ছেন। আমরা বরফ ঠেলে হাঁটছি। ক্ষুধায় তখন পেট আমাদের শাঁ শাঁ করছে। বাঙালি আমরা; ভুল করিনি। সঙ্গে নিয়ে যাই কলা-রুটি। কিছু দূর যেতে না যেতেই দোস্ত হেলাল গা এলিয়ে দিল বরফে। কথা একটাই তার, আর এক কদমও সামনে আগাব না। কিছু খেতে দে। কি আর করা। সবাই এই ঠনঠনে বরফে গোল হয়ে বসে পড়লাম লাঞ্চ করতে। আশপাশের পর্যটকরা আমাদের এমন ভাবসাব দেখে অবাক। আজীব তো! এরা কি তাহলে খেতে এসেছে। এদের খাওয়া দেখে মনে হচ্ছে, কোনো রেস্টুরেন্টে বসে আছে।

সামান্য লাঞ্চ করে আবার উঠে দাঁড়ালাম আমরা। এখনো কিলোমিটার দুয়েক বাকি। এদিকে মোবাইলে ডাটার টানাপড়েন। কেউ ফেসবুকেও ঢুকতে পারছে না। আমাদের পেছনে ছিল দুই চায়না ফ্রেন্ড। তাদের সম্পর্ক বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড। তখনো এটা জানতাম না। সামনে দু-চার কদম এগোতেই কথার ফাঁকে ফাঁকে এমনটাই বুঝলাম। লোক দুটো হিন্দি বোঝে না। তাই কারো সঙ্গে গপ্পবাজি করতে পারছে না। কাশ্মীর গেলে হিন্দি জানাটা বেশ ভালো। কাশ্মীর বেড়ালে বুঝে আসে হিন্দি ভাষার কী কদর। সবার সঙ্গে শুরুতে ধাপ্পাবাজিটা আমিই বেশ নিয়েছিলাম। বলছিলাম, আরে যত কিলোমিটার হোক না কেন, আমি হেঁটেই পার হব। এবার আমিই প্রথম থ হয়ে গেলাম। পা আর এগোচ্ছে না। কেডস ভেদ করে পায়ের মোজা অবধি পানিতে ভিজে আছে। পা ফ্রিজ হয়ে আছে। এমন অবস্থা দেখে চায়না বন্ধুগুলো মজা নিচ্ছিল। বোধহয় মনে মনে বলছিল, অনেক তো ভাব নিয়েছ, এবার বোঝ! না, এবার কষ্ট চাপা দিয়ে ফের উঠে দাঁড়ালাম। আর মাত্র এক কিলোমিটার দূর মিনি সুইজারল্যান্ড; সেটা ভাবতে ভাবতে পৌঁছেই গেলাম।

হাজার হাজার পর্যটক। সবার অবস্থাই নাজুক। মিনি সুইজারল্যান্ড পুরোটা এখন বরফে সাদা। ভেলি গাছের পাতায় পাতায় জমে গাদাগাদা বরফ। পৌঁছে আমি প্রথমেই সোজা চলে গেলাম তাঁবু করে সাজিয়ে বসা চাউমিন দোকানে। ভারতে নুডলসকে ওরা চাউমিন বলে। ভালো লাগছিল, চাউমিনের মূল্যটা মোটামুটি সাশ্রয়ী ছিল। চার বন্ধু মিলে কোনোরকম তিনটি চাউমিন ভাগাভাগি করে ক্ষুধা কিছুটা নিবারণ করলাম। কিন্তু তখনো পা আমার অবশ। ভ্রমণের স্বাদটা যেন চলনেই শেষ হয়ে গেল। আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না। সবাই যে যার মতো সেলফি তুলছে। স্কাউটিং করছে। বরফ মাখামাখি করছে। আমি নীরব দর্শক সেজে দেখছি। এক বিদেশি বন্ধু বলল, ‘ইধার আইয়ে। আওর আপকি মোজা তুড়াছা গরম করলি জিয়ে।’ ভাবলাম, তাইতো, সেটাই করা যায়। মিনিট দশেক আগুনে পা-টা রেখে বন্ধুদের পিড়াপীড়িতে দাঁড়ালাম এবং আশপাশ ঘোরাঘুরি করে মিনি সুইজারল্যান্ডের কিছুটা স্বাদ নিলাম।

সত্যিই অসাধারণ স্পট! দেখলে তবে ফিরতে মন চায় না। কিন্তু বিকেল এখন ৪টা। আবার আমাদের হেঁটে নামতে হবে। ফেরার রুটিন ছিলÑ আসতে আসতে সুন্দর সব লোকেশনে পিকচার ওঠানো। শুরু হলো ক্লিক। সঙ্গে বন্ধুদের দুষ্টুমি আর বরফ দিয়ে একে-অন্যকে ঢিল মারা। এবার কষ্ট অনুভ‚ত হলো না। দুষ্টুমি করতে করতে কখন যে নিচে নেমে এলাম, টেরই

পেলাম না!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist