আজিজুল হাকিম, মানিকগঞ্জ

  ১২ নভেম্বর, ২০১৮

মানিকগঞ্জে ৩০ বছরেও সংস্কার হয়নি সেতুটি

নেপথ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব

৩০ বছরেও সংস্কার হয়নি মানিকগঞ্জ সদরের নাড়লা সেতুটি। এতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন ১২টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। যোগযোগব্যবস্থার অভাবে দিনে দিনে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয়ভাবে পুরনো জমিদার বাড়ি ও উপমহাদের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেনের বাড়িসহ পুরনো স্থাপনা পর্যটকদের আকর্ষণ করলেও তারা আসতে পারেন না।

স্থানীদের অভিযোগ, সেতু অবস্থিত ইউনিয়নটি ক্ষমতাসীন দলের ভোটব্যাংক না হওয়ার কারণে বরাবরই বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে। জীবনমান উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনদুর্ভোগ নিরসনে দ্রুত সেতু সংস্কার দাবি এলাকাবাসীর।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৪০ বছর আগে সদরের বেতিলা-মিতরা ইউনিয়নের গাজীখালী নদীর ওপর নাড়লা এলাকায় সেতু নির্মাণ করেন তৎকালীন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী। ১৯৮৮ সালের বন্যায় সেতুটি পুরোপুরি পানিতে ডুবে যায়। এ সময় সেতুটির দুই পাশ ভেঙে গেলে বাঁশের মাচা দিয়ে সেতু ব্যবহার করে স্থানীয়রা। প্রথমে এলাকাবাসীর অর্থায়নে বাঁশের মাচা তৈরি হলেও পরে ইউনিয়ন পরিষদের অর্থায়নে মাচা তৈরি করা হচ্ছে।

মানিকগঞ্জ শহর, পৌরসভা, কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন ও বেতিলা-মিতরা ইউনিয়নের সঙ্গে সংযোগ সেতু দিয়ে পৌরসভার মত্ত, মালঞ্চ; কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের চরমত্ত, গুজুরী, বাহিরচর ও বাংগড়া, রামদিয়া, বকজুরি, সোনাকান্দর, গোপালপুরসহ কমপক্ষে ১২টি গ্রামের প্রায় ৭ হাজার মানুষ চলাফেরা করে। এছাড়াও সেতু দিয়ে পাশাপাশি দুই ইউনিয়নের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র, পুরনো জমিদার বাড়ি, দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইউনিয়ন ভূমি অফিস, বেতিলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কেজি স্কুল, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও হাট-বাজারসহ শহরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়।

সরেজমিন দেখা যায়, সেতুটির দুই পাশে বাঁশের মাচা দিয়ে চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। সেতুর যে অংশটুকু বিদ্যমান আছে তাও ইট-খোয়া বের হয়েছে। ভেঙে গেছে রেলিং। নিচে পিলারের অংশের মাটি বের হয়েছে। ভাঙা অংশে বাঁশের খুঁটি দিয়ে চলাচল করা হচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে বাঁশের খুঁটি ভেঙে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।

সেতুটি সম্পর্কে স্থানীয়রা জানান, সেতুটি সংস্কার না হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে কৃষকদের। এই অঞ্চলে উৎপাদিত শাকসবজি স্থানীয়দের চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন বড় বড় বাজারে যেত। কিন্তু সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে আগের মতো পাইকাররা আসে না। ইউনিয়নে বেশ কয়েকটি পুরনো জমিদার বাড়ি, চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেনের বাড়ি থাকায় এক সময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটক এলেও এখন আর কেউ আসতে চান না। যার প্রভাব পড়েছে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক কয়েকজন জনপ্রতিনিধি প্রতিদিনের সংবাদকে জানান, বেতিলা-মিতরা ইউনিয়নের মধ্যে এই এলাকায় বিএনপির ভোটার সবচেয়ে বেশি। নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা ভোট পায়। এ নিয়ে এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা হয়। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। শুধুমাত্র বিএনপির সমর্থক বেশি হওয়ায় এই সেতুটির কোনো সংস্কার হয়নি। মূলত আওয়ামী লীগ-বিএনপির দ্বন্দ্বের কারণে ৩০ বছরেও এই সেতুটি সংস্কার হয়নি।

স্থানীয় আবদুল জলিল মাস্টার জানান, মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়ন হচ্ছে বেতিলা-মিতরা ইউনিয়ন। অথচ এই সেতুটির কারণে দীর্ঘদিন ভোগান্তি ও দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এলাকায় ভালো কোনো যোগাযোগব্যবস্থা নেই। প্রতিদিনিই ছেলেমেয়েদের কষ্ট করে স্কুল-কলেজের যেতে হয়। যোগযোগব্যবস্থার কারণে দিন দিন অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এলাকায় কি মানুষ বসবাস করা যায়, সেটা দেখার কেউ নেই। নির্বাচনের সময় ছাড়া জনপ্রতিনিধিদের দেখা খুব কষ্টকর।’

স্থানীয় মো. জামাল উদ্দিন জানান, সেতুটি সংস্কার না হওয়ায় ৩০ বছর ধরে মানুষের দুর্ভোগ দেখছি। কত সরকার, কত মেম্বার ও চেয়ারম্যান পরিবর্তন হলো অথচ এই সেতুটির কারণে আমাদের দুর্ভোগ শেষ হলো না। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘বয়স তো শেষ। আমরা তো কোনো মতে চলাফেরা করতে পারলাম। কিন্তু আগামী দিনে কি হবে, আল্লাহই জানে।’

স্থানীয় কৃষকরা জানান, যোগাযোগব্যবস্থার কারণে তাদের বিভিন্ন কাঁচামাল বাজারে নিতে বেশি কষ্ট হয়। অনেক সময় ৫-৭ কিলোমিটার ঘুরে বাজারে যেতে হয়। যখন সেতুটি ভালো ছিল তখন এখানকার কাঁচামাল গাড়িতে করে রাজধানীতে নেওয়া হতো। কিন্তু সেতুটি ভেঙে যাওয়ার পর এখন আর সরাসরি গাড়ি যোগাযোগ নেই।

স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. বিল্লাল হোসেন জানান, সেতুটি সংস্কার না হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। এ বিষয়ে এমপি-মন্ত্রীদের জানানো হয়েছে। তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। মানুষের যাতায়াতের জন্য ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বাঁশের মাচাইন তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই সেতুটি কেন সংস্কার করা হচ্ছে না বিষয়টি আমরাও বুঝতে পারছি না।

মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার প্রকৌশলী মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, নালড়া সেতুটির নতুন করে নির্মাণের জন্য মাটি পরীক্ষা করা হয়েছে। ডিজাইন ও নকশা তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হবে। পাস হলে টেন্ডার দেয়া হবে। মূলত প্রকল্পটির বাজেট পাস হলে কাজ শুরু করা হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close