নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

তাপপ্রবাহে মৃত্যুর মিছিল

ছয় দিনে ৩৪ প্রাণহানি

আগে দেশে শৈত্যপ্রবাহে মানুষ মারা যেত বেশি। এখন তাপপ্রবাহে দেখা যাচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। গত শুক্রবার থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত ছয় দিনে তাপপ্রবাহে ৩৪ জন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

তীব্র তাপপ্রবাহের দিনগুলোয় মৃত্যু বেড়ে যায় ২২ শতাংশ। দেশের পাঁচটি প্রধান নগরের ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ প্রবল তাপের ঝুঁকিতে আছেন। তাপপ্রবাহ থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করতে গাছ লাগানো ও জলাশয় বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে অতিরিক্ত তাপের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১৮ হাজার ৯৭০ জন শ্রমজীবী মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। গত সোমবার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রকাশিত এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এ তথ্য ওঠে এসেছে। ২০২০ সালের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এই হিসাব তুলে ধরা হয়েছে।

‘এনশিউরিং সেফটি অ্যান্ড হেলথ অ্যাট ওয়ার্ক ইন অ্যা চেঞ্জিং ক্লাইমেট’ (জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা) শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের সব অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা যাচ্ছে। ৩৪০ কোটি শ্রমশক্তির মধ্যে ২৪০ কোটি মানুষই কোনো না কোনোভাবে অতিরিক্ত তাপের সংস্পর্শে আসছেন। অর্থাৎ বৈশ্বিক শ্রমশক্তির ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ অতিরিক্ত তাপের সংস্পর্শে আসছেন।

প্রতিবেদনে অতিরিক্ত তাপ, আলট্রাভায়োলেট রেডিয়েশন, চরম আবহাওয়া, কর্মক্ষেত্রে বায়ুদূষণ, পরজীবী-ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাসবাহিত রোগ এবং অ্যাগ্রোকেমিক্যাল (কৃষি খাতে ব্যবহার করা রাসায়নিক) এ ছয় ক্ষেত্রে কর্মীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, অতিরিক্ত তাপের পাশাপাশি বন্যা, খরার মতো চরম আবহাওয়ায় বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে হতাশা, উদ্বেগ, সব বয়সিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা, পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) বা মানসিক আঘাতজনিত দুশ্চিন্তা ও মাদকাসক্তি বাড়ছে। দুর্যোগের মধ্যে জরুরি কাজে নিয়োজিত কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, ফায়ার সার্ভিসের কর্মী, জেলে, কৃষি ও নির্মাণশ্রমিকদের মধ্যেও নাজুক মানসিক অবস্থা দেখা যাচ্ছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা যা আছে, তা যথেষ্ট নয়। অনেক দেশ তাপ থেকে সৃষ্ট রোগকে ‘পেশাগত রোগ’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। ঝুঁকির ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীরা। ঝুঁকি থাকলেও আর্থিক কারণে তারা অতিরিক্ত গরমের মধ্যেও কাজ করেন।

একুশে পদকপ্রাপ্ত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, অতিরিক্ত তাপমাত্রা সবার জন্য ক্ষতিকর। শ্রমজীবী মানুষ প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের মধ্যে বাইরে কাজ করেন বলে তাদের ঝুঁকি বেশি। গরমে একটানা কাজ করতে গিয়ে প্রচণ্ড ঘাম হয়। এ সময় দেহে লালচে ফোসকা পড়া, বমি ভাব, অবসাদ, মাথা ঘোরা, মাংসপেশির খিঁচুনি (হিটক্র্যাম্পস) ও হিটস্ট্রোক হতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে হিটস্ট্রোকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। পানিশূন্যতা থেকে কিডনির ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

অতিরিক্ত তাপপ্রবাহের এই কয় দিনে সম্ভব হলে দুপুরে কাজ বন্ধ রেখে সকালে ও বিকেলে কাজের ব্যবস্থা করা যায় কি না, তা বিবেচনা করতে বলেছেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, মরুভূমির দেশে অতিরিক্ত গরমে এই ব্যবস্থা চালু আছে।

আইএলওর প্রতিবেদনে বলা হয়, অতিরিক্ত গরমজনিত প্রায় সোয়া দুই কোটি ‘পেশাগত দুর্ঘটনায়’ ২০ লাখের বেশি মানুষকে নানা প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বাস করতে হচ্ছে। কৃষি, নির্মাণ, পরিবহন খাতের মতো বাইরে কাজ করা কর্মীরা অতিরিক্ত গরমের কারণে মৃত্যু ও প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে পড়ছেন। তারা হিটস্ট্রেস, হিটস্ট্রোক, হিটক্র্যাম্পস, র‍্যাশ, ত্বকে ক্যানসার, হৃদরোগ, শ্বাসজনিত অসুস্থতা, কিডনির রোগ ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। অন্তঃসত্ত্বা নারীরা নানা জটিলতায় পড়ছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চরম আবহাওয়ায় বাংলাদেশ, ভারত, লাওসসহ অনেক অঞ্চলে গত বছরের এপ্রিলে রেকর্ড পরিমাণ উচ্চ তাপমাত্রা দেখা গেছে। এ ধরনের আবহাওয়াকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, চরম আবহাওয়ায় বাংলাদেশ, ফিলিপাইন ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, হতাশা, মাদকাসক্তি, আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে।

প্রতিবেদনে অভিবাসীকর্মীদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কায়িক শ্রম বেশি করতে হয় বলে তারাও ঝুঁকিতে থাকেন। ভাষাগত প্রতিবন্ধকতার কারণে তারা কীভাবে নিজেদের সুরক্ষিত রাখা যায়, সে সম্পর্কে অনেক ক্ষেত্রে বুঝতে পারেন না।

বাংলাদেশের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুসারে, গত বছর ৮ লাখের বেশি কর্মী শুধু মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে গেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বছরের বড় সময় ধরে উচ্চ তাপপ্রবাহ থাকে। বিশেষ করে জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত।

আইএলওর বাংলাদেশের যোগাযোগ ও জ্ঞান ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাথেরিন এমজেন্ডি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলেন, অত্যন্ত বিপজ্জনক বায়ুমান ও প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের মধ্যে কর্মীদের যথাযথ সুরক্ষা নেই। বাংলাদেশসহ এশিয়ার অন্য দেশে এই সময়ে বাইরে যাদের কাজ করতে হয়, তারা তাপজনিত অসুস্থতার উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন।

ঢাকা নগরের তাপমাত্রা কমানোর উদ্যোগ হিসেবে দুই বছরে দুই লাখ গাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। গত বছর তার এ ঘোষণার পরও তেমন গাছ লাগাতে দেখা যায়নি। উল্টো দুই সিটির বিভিন্ন সড়কদ্বীপে গাছ কাটা হয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের এক সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে, আট বছরের ব্যবধানে ঢাকায় সবুজ ও ফাঁকা জায়গার পরিমাণ ১৬ থেকে ২০ শতাংশ কমেছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘তাপপ্রবাহের কারণে এখন নগর বনায়নের দিকে আমরা নজর দিয়েছি। নগর বনায়ন করা গেলে ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা কমানো যেতে পারে। ঢাকার তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম উৎস আশপাশের ইটভাটা বন্ধ করা হচ্ছে; দূষণ কমাতেও চলছে নানা উদ্যোগ। সামনের পরিকল্পনায় তাপপ্রবাহকে আরো গুরুত্ব দেওয়া হবে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close