নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৭ জানুয়ারি, ২০২৪

পোশাক খাতে উজ্জ্বল দিনের সম্ভাবনা

দেশের তৈরি পোশাক খাতের ধূসর সময় পার হয়ে সামনে উজ্জ্বল দিনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। রপ্তানিকারকরা ২০২৪ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকের শুরু থেকে পোশাকের ক্রয়াদেশ বাড়বে বলে আশা করছেন। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের মূল্যস্ফীতি কমা, বৈশ্বিক খুচরা পর্যায়ের দোকানগুলো বিভিন্ন উৎসবে তাদের শীতকালীন পোশাকের মজুদ বিক্রি করে ফেলায় সামনে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ বাড়তে পারে।

এদিকে তৈরি পোশাক খাতে পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতিতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নতুন এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। আইএলওর প্রতিবেদনের শিরোনাম, ‘পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিরোধ এবং মোকাবিলা’। গত বুধবার জেনেভায় আইএলও সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গবেষণার ফল নিয়ে আলোচনা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য (ওএসএইচ) ব্যবস্থা প্রাথমিকভাবে শ্রম আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও মর্যাদা উন্নীত করতে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যনীতি-২০১৩ এবং গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি-২০১৫ গঠন করেছে। শ্রম আইনের ১০৯ ধারা কর্মক্ষেত্রে নারীদের সুরক্ষা প্রদান করে। প্রতিবেদনটিতে শ্রম আইনে পরিবর্তনের ফলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও নির্মূলে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরে প্রশংসা করা হয়েছে। এছাড়া পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যকাঠামো কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা এবং হয়রানি প্রতিরোধে কার্যকর উপায় হিসেবে প্রমাণ হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ী-নেতা এবং বৈশ্বিক ক্রেতাদের প্রতিনিধিরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো রপ্তানি গন্তব্যের প্রধান দেশগুলোর খুচরা পর্যায়ের দোকানগুলো ব্ল্যাক ফ্রাইডে, সাইবার মানডে, ক্রিসমাস ডে ও বক্সিং ডের মতো বিভিন্ন উৎসবের কল্যাণে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে প্রচুর পণ্য বিক্রি করতে পেরেছে। ইউএস সেন্সাস ব্যুরোর উপাত্তও বলছে, গত এক বছরে তৈরি পোশাকের দোকানগুলোয় বিক্রি ধারাবাহিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এ বিক্রি ২০২৩ সালের জানুয়ারির মাসিক ১৩.৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে নভেম্বরে ২১.৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

গত বছরের ডিসেম্বরে মার্কিন দোকানগুলোয় মাসিক বিক্রি হয়েছিল প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি। ভারতীয় মার্কেট গবেষণা ফার্ম ওয়াজির অ্যাডভাইজরের মতে, ইয়ার-টু-ডেট হিসেবে ২০২৩ সালে পোশাক বিক্রয়ের পরিমাণ ২০২২ সালের তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি ছিল। বৈশ্বিক থিঙ্কট্যাঙ্ক দ্য কনফারেন্স বোর্ড মার্কিন ভোক্তাদের মনোভাব, ব্যয়ের অভিপ্রায় এবং মুদ্রাস্ফীতি, স্টকের দাম ও সুদহার নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির মাসিক মূল্যায়ন পরিচালনা করে। এটির সর্বশেষ সমীক্ষা অনুসারে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আগের মাসের ১০২.০ থেকে বেড়ে মার্কিন ভোক্তা আস্থা সূচক ১১০.৭ হয়েছে। আর এ সূচক ২০২২ সালের ডিসেম্বরের সূচকের চেয়েও কিছুটা বেশি। এদিকে যুক্তরাজ্যের বাজারেও খুচরা পর্যায়ে তৈরি পোশাকের বিক্রি বাড়ার কথা জানা গেছে।

ইউকে স্ট্যাটিস্টিক্স অথোরিটির কার্যনির্বাহী দপ্তর অফিস অভ ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্সের তথ্যানুসারে, যুক্তরাজ্যের বাজারে ২০২৩ সালজুড়েই খুচরা পর্যায়ে মাসিক পোশাক বিক্রি ঊর্ধ্বমুখী ছিল। যদিও সর্বশেষ প্রান্তিকে সামান্য মন্দারও সম্মুখীন হয়েছে বাজারটি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সারা বছরের ১২ মাস মিলিয়ে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ মাসিক পোশাক রপ্তানি মূল্য ৪.৫৬ বিলিয়ন ডলার অর্জন করে। তবে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুসারে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের তুলনায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রপ্তানি ২.৪ শতাংশ কম ছিল। ২০২৩ সালে রপ্তানির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি হয় সামান্যই- ৩.৬৭ শতাংশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৭.৩৯ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২২ সালে রপ্তানি করা হয়েছিল ৪৫.৭১ বিলিয়ন ডলারের।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, আমাদের রপ্তানিকারকরা চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক থেকে বৈশ্বিক ক্রেতাদের কাছ থেকে পোশাকের অর্ডার বাড়বে বলে আশা করছেন। ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বগত এক বছরে ব্র্যান্ডগুলো সফলভাবে তাদের মজুদ বিক্রি শেষ করায় বাংলাদেশ থেকে তাদের পোশাকের সোর্সিং বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিছু ক্রেতা এরই মধ্যে আমাদের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে অর্ডার বাড়াতে আলোচনা শুরু করছে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ২০২৪ সালে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) অন্তর্গত দেশগুলোর প্রত্যাশিত ১.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ মূল্যস্ফীতি ৩.২ শতাংশে হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আমরা ২০২৪ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশের পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির পূর্বাভাস দেখতে পাচ্ছি। মুদ্রাস্ফীতি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তাদের পোশাক ক্রয়ে আরো বেশি ব্যয় করার সম্ভাবনা রয়েছে।

নোমান গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের বৃহত্তম টেক্সটাইল বিভাগ জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফেব্রিক্স লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক (বিক্রয় ও বিপণন) শফিকুর রহমানও পোশাকশিল্পের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও নেতাদের প্রকাশিত আশাবাদের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, মহামারি-পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো ব্যাপক আমদানি করেছিল। এসব পণ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তাদের কাছে মজুদ ছিল। তা সত্ত্বেও গত বছর পশ্চিমা দেশগুলোয় শীত একটু তাড়াতাড়ি পড়ায় বেশিরভাগ খুচরা আউটলেট এরই মধ্যে তাদের সংগ্রহে থাকা পোশাক বিক্রি করে ফেলেছে।

গত বছর ডেনমার্কে তার ব্যক্তিগত সফরের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে শফিকুর বলেন, সাধারণত পশ্চিমে শীতকালীন তুষারপাত হয় ডিসেম্বরের শেষের দিকে। কিন্তু এবার এক মাস আগেই তুষার পড়তে শুরু করে। এতে খুচরা দোকানগুলোর পোশাক দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। ব্যবসায়িক সুযোগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। কিছু রপ্তানিকারক মে থেকে জুনের মধ্যে ক্রয়াদেশের জন্য বর্তমানে ক্রেতাদের সঙ্গে আলোচনা করছেন। তিনি আরো বলেন, টেক্সটাইল উৎপাদনকারীরা জুনের শুরু থেকে ফেব্রিক উৎপাদন শুরু করার পরিকল্পনা করছে। পোশাক উৎপাদন জুনের পর শুরু হয়ে নভেম্বর পর্যন্ত চলবে বলে আশা করা হচ্ছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close