বিশেষ প্রতিবেদক

  ০৭ জানুয়ারি, ২০২৪

আজ ভোট, ইসির বড় পরীক্ষা

আজ ৭ জানুয়ারি রবিবার, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। উৎসবমুখর এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আজ সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীন ভোট নেওয়া হবে। স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিনুল ইসলাম মারা যাওয়ায় নওগাঁ-২ আসনের নির্বাচন স্থগিত করেছে ইসি। ফলে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৯ আসনে ভোট নেওয়া হবে।

এবার সবচেয়ে বেশি প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। ইসির আশা, আজ উৎসবমুখর ভোট হবে। ভোটারদের নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। বিএনপির ভোট বর্জন ও প্রতিহত করার ঘোষণাও এ নির্বাচনের জন্য চ্যালেঞ্জ। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের দিন গতকাল শনিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত মিট দ্য প্রেসে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তবে কোনো একটা বিরোধীপক্ষ ভোট বর্জনের পাশাপাশি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। এতে নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে উঠিয়ে আনার ক্ষেত্রে কিছুটা সংকট দেখা দিতে পারে। এ বাস্তবতা অস্বীকার করছি না। তবে আশা করি, বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে জনগণের অংশগ্রহণে ও ভোটরদের আগমনে (নির্বাচন) উঠে আসবে। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত মূল্যায়নের জন্য আরো ৪৮ ঘণ্টা অপেক্ষা করুন, সেটা হয়তো দেখতে পারবেন।

এখানে তিনি ইসির পরীক্ষার ফল পর্যবেক্ষণের আহ্বান জানান। সিইসি বলেন, ভোটগ্রহণের সময় ভোটারদের নিরাপত্তায় ৮ লাখের বেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত আছেন। বড় দল ভোটবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, শান্তিপূর্ণ হলে আমরা কিছু মনে করব না। ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য বলবে, সেটা অপরাধ। এটাই আমাদের চ্যালেঞ্জ। কাজী আউয়াল বলেন, নির্বাচন কমিশন হচ্ছে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা বডি। আমি বলতে চাই, আমরা বিশ্বাস করি, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছতামূলক নির্বাচন। স্থানীয়ভাবেই শুধু নয়, আন্তর্জাতিকভাবে পর্যবেক্ষণ হোক- আমরা সেটা চাই।

বিএনপির ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে এ নির্বাচন আয়োজন করা হয়েছে। ভোট বানচাল করতে কিছু তৎপরতাও লক্ষ করা গেছে। বিভিন্ন স্থানে নাশকতার পাশাপাশি সহিংসতাও ঘটানো হয়েছে। এবার এ ভোট যেকোনোমূল্যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা। তাই আগের নির্বাচনগুলোর চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের। এবার ভোট টানাও অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। এ বিষয়ে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলাসহ সার্বিক প্রস্তুতি ভালোই মনে হচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত কী হয়, তা নির্বাচনের দিন বোঝা যাবে। ভোটের দিন ইসির পরীক্ষা কেমন হয় দেখা যাবে। ভোটারের উপস্থিতি, ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ, বিএনপির বর্জন-গর্জনের চ্যালেঞ্জের পরও তা কীভাবে ভোটের মাধ্যমে উতরে যাওয়া যায়, তা দেখা যাবে।’

ভোট নেওয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। ভোটাররা যাতে কেন্দ্রে এসে নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিরাপদে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন, সেজন্য পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। আজ নির্বাচনের দিন ভোটগ্রহণের কাজে ৮ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত থাকবেন। এছাড়া ১ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী স্ট্যান্ডবাই থাকবেন। ৩ হাজার ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারক মাঠে থাকবেন। তারা যেকোনো অপরাধে তাৎক্ষণিক শাস্তি দিতে পারবেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে শনিবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি ভাষণে জনগণকে সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়া এবং সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে প্রার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান। গত ১৫ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে তিনি ভাষণে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিলেন।

নির্বাচন উপলক্ষে সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য স্থাপনায় ৪২ হাজার ২৪টি ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ভোটের সর্বশেষ আপডেট জানার জন্য স্মার্ট ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বিডি অ্যাপস চালু করা হয়েছে। তার মাধ্যমে ভোটের সর্বশেষ পরিস্থিতির সঠিক তথ্য সম্পর্কে জনগণ যেকোনো জায়গা থেকে সহজে জানতে পারবে। এছাড়া ভোটাররা তার ভোটার নম্বর ও কেন্দ্রের নাম এবং অবস্থান জানতে পারবেন। গুগল প্লে স্টোরে গিয়ে অ্যাপটি ডাউনলোড করা যাবে। ভোটে রিটার্নিং অফিসার থাকছেন ৬৬ জন। তার মধ্যে দুই বিভাগীয় কমিশনার ও ৬৪ জেলা প্রশাসক। আজ ২৯৯ সংসদীয় আসনে ১ হাজার ৯৭০ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ইসিতে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এসব দলের প্রার্থী হিসেবে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ হাজার ৫৩৪ প্রার্থী। স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন ৪৩৬ জন।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী ২৬৬, জাতীয় পার্টির ২৬৫, তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী ১৩৫, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ৬৬, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২, জাতীয় পার্টির (জেপি) ১৩ এবং বিকল্পধারা বাংলাদেশের ১০ প্রার্থী আছেন। নির্বাচনে নারী প্রার্থী হিসেবে আছেন ৯০ জন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অন্যান্য মিলে ৭৯ প্রার্থী ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন। এবার ভোটকেন্দ্র ৪২ হাজার ২৪টি। ভোটকক্ষ ২ লাখ ৬১ হাজার ৯১২টি। নির্বাচনে ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭৬ লাখ ৯ হাজার ৭৪১ এবং নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৯৯। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ৮৪৯ জন। এবারই প্রথমবারের মতো ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানো হচ্ছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন স্থানীয় ২০ হাজার ৭৭৩ পর্যবেক্ষক। সেইসঙ্গে দুই শতাধিক বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকবেন।

গত ৩ জানুয়ারি থেকে সেনাবাহিনী ৬২টি জেলায় নিয়োজিত হয়েছে। উপকূলীয় দুটি জেলাসহ (ভোলা ও বরগুনা) ১৯টি উপজেলায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী দায়িত্ব পালন করছে। সমতলে সীমান্তবর্তী ৪৫টি উপজেলায় বিজিবি এককভাবে দায়িত্ব পালন করছে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী হেলিকপ্টারের সহায়তায় দুর্গম পার্বত্যাঞ্চলের ভোটকেন্দ্রগুলোয় প্রয়োজনীয় হেলিকপ্টার সহায়তা প্রদান করবে। এ নির্বাচনে ১ লাখ ৮২ হাজার ৯১ পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মোতায়েন করা হয়েছে। গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে সারা দেশে ৪৮৭টি বেজ ক্যাম্পে ১ হাজার ১৫৫ প্লাটুন বিজিবি নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। সারা দেশে নাশকতা এড়াতে বিস্ফোরক দ্রব্যের ওপর বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত বিজিবি ডগ স্কোয়াড দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করছে। একইসঙ্গে মাঠে কাজ করছে বিজিবির বিশেষায়িত ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন টিম (র‌্যাট)। এছাড়া বিজিবির কুইক রেসপন্স ফোর্সও প্রস্তুত রয়েছে, যারা বিজিবির অত্যাধুনিক হেলিকপ্টারের মাধ্যমে দেশের যেকোনো প্রান্তে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষমতা রাখে।

নির্বাচনে নিরাপত্তা রক্ষায় ৫ লাখ ৫ হাজার ৭৮৮ সাধারণ আনসার ও ভিডিপি সদস্য মোতায়েন করা গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে। তারা আগামী ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত মাঠে থাকবেন। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২ লাখ ১৫ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবেন। সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ৪ লাখ ৭২ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ১৫ থেকে ১৭ জনের নিরাপত্তা সদস্যের দল মোতায়েন করা হবে। নির্বাচন কমিশন জানায়, মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে অস্ত্রধারী দুজন পুলিশ, অস্ত্রধারী একজন আনসার, অস্ত্র বা লাঠিধারী একজন আনসার, ১০ জন আনসার, লাঠি হাতে একজন বা দুজন গ্রামপুলিশ সদস্যসহ ১৫ থেকে ১৬ জনের একটি দল সব সাধারণ ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা দেবে।

তবে প্রতি গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের ক্ষেত্রে অস্ত্রসহ ৩ পুলিশসহ ১৬ থেকে ১৭ জনের দল থাকবে। নির্বাচন উপলক্ষে ৫ জানুয়ারি মধ্যরাত ১২টা থেকে ৮ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে ইসির স্টিকার লাগানো মোটরসাইকেল এ নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে। আজ রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবন থেকে নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হবে। ভোটের ফল ঘোষণার জন্য ইসি ভবনের ভেতরে গতকাল তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ। মূল মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে সাংবাদিকদের জন্য স্টল। বিশাল তাঁবুর মধ্যে ছোট ছোট স্টলে সাজানো হয়েছে ফল সংগ্রহের বুথ। সেখান থেকেই প্রচার করা হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close