মিজান রহমান

  ১১ আগস্ট, ২০২২

সংকটে সতর্ক বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক যেসব সংকট সৃষ্টি হয়েছে সে ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে বাংলাদেশ সরকার। বিশ্ব সংকটের প্রবাহে দেশে সংকট যাতে বড় আকার নিতে না পারে সে লক্ষ্যে দূরদর্শী ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। এর মাধ্যমে দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের একজন নীতিনির্ধারক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, যে যাই বলুক দেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হবে না। বাংলাদেশের পায়ের নিচে মাটি রয়েছে। এখন রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে বলা যায় প্রবাসী আয়ের পালে হাওয়া লেগেছে। চলতি আগস্ট মাসের প্রথম ৭ দিনে ৫৫ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৯৫ টাকা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকা। এ তো গেল রেমিট্যান্সের কথা। জ্বালানি সংকট? খুব শিগগিরই এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে। এছাড়া বর্ধিত মূল্যে জ্বালানি তেল বিক্রির কারণে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে।

তিনি জানান, এই মুহূর্তে সরকারের বড় উদ্যোগ হচ্ছে বিদ্যুতের লোডশেডিং থেকে বেরিয়ে আসা। লোডশেডিং থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে সরকারের কাছে বেশকিছু সুখবর রয়েছে। আগামী অক্টোবরের মধ্যে এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তারা। সংকট কাটিয়ে উঠতে সরকার বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এসব বিষয় তদারকি করছেন। সার্বক্ষণিকভাবে প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।

কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, সরকার বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে অপ্রয়োজনে অফিসের এসি ও বাতি ব্যবহার না করার নির্দেশনা দিয়েছে। এভাবে ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে চায় সরকার। লোডশেডিং থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে সরকারের কাছে বেশকিছু সুখবর রয়েছে। শিগগিরই একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন শুরু হবে যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ডিজেল চালিত নয়। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু হলে সরকার বিদ্যুৎ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়াও সরকার নতুন গ্যাসকূপ অনুসন্ধান এবং বিদ্যমান কূপগুলো আরো আধুনিকায়ন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করছে। অক্টোবরে শীত মৌসুম শুরু হলে বিদ্যুতের চাহিদা অনেকখানি কমবে। এটাও লোডশেডিং থেকে মুক্ত হওয়ার একটি সম্ভাবনা। এসব উদ্যোগের ফলে লোডশেডিং থেকে সরকার বেরিয়ে আসতে পারবে এবং চাপমুক্ত হতে সক্ষম হবে। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, অক্টোবরের মধ্যে আরো চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।

সরকারের আরেকটি উদ্যোগ হলো রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো। প্রবাসীদের অর্থ যেন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বৈধপথে আসে সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে রেমিট্যান্স আনা সহজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া এ ব্যাপারে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে। খোলাবাজারের সঙ্গে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের যে মূল্যের পার্থক্য এজন্যই অনেকে হয়তো উৎসাহী হচ্ছে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোয়। সেটি বন্ধ করার জন্য সরকার প্রণোদনা বাড়াতে পারে এবং আর কী কী করা যায় সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা চলছে। সরকারের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, শিগগিরই রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। এরই মধ্যে চলতি আগস্ট মাসের প্রথম ৭ দিনে ৫৫ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।

এছাড়া সরকার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে তা থেকে উত্তরণের জন্য একটি কূটনৈতিক পথ খুঁজছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করা, খাদ্যের বিকল্প উৎস খুঁজে বের করা এবং সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল আনার পথগুলো খুঁজে দেখার চেষ্টা করছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ নিয়ে কাজ করছে বলে জানা গেছে। সরকার মনে করছে, আগামী তিন মাসের মধ্যেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।

এ ছাড়া বড় ধরনের সংকট হওয়ার আগেই সেটি নিরসনে সরকার জ্বালানি সাশ্রয়, আমদানি ব্যয় কমানো ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, উচ্চমূল্যের কারণে বিশ্ববাজার থেকে জ্বালানি আমদানি করে তা ভর্তুকি মূল্যে বিতরণ করা দুরুহ হয়ে পড়েছে। আবার বৈদেশিক মুদ্রার আয় কম হওয়ায় ডলার সংকট দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমদানিনির্ভর পণ্য ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার পরামর্শ দিয়েছে সরকার। যার ফলে জুলাইয়ের ২৭ দিনে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য কম আমদানি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানিয়েছে, স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মাসে আমদানি ব্যয় প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার। পেট্রল পাম্পগুলোও সপ্তাহে এক দিন বন্ধ। দিনে ১ ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের বিষয়েও কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এছাড়া, রাত ৮টার পর দোকান-শপিং মল বন্ধ রাখাসহ আলোকসজ্জাতেও এসেছে নিষেধাজ্ঞা।

প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে প্রত্যেককে নিজ নিজ জায়গায় থেকে কৃচ্ছ্রসাধন, সঞ্চয় বাড়ানো, মিতব্যয়ী হওয়া, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় পরিহার ও অপচয় কমানোর পরামর্শ দিচ্ছেন বারবার। এরই মধ্যে বন্ধ করা হয়েছে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। এছাড়া সরকারও সংকট গভীর হওয়ার আগে প্রয়োজনীয় সরকারি পরিপত্র জারি করেছে। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। গাড়ি কেনা বন্ধ করতে বলা হয়েছে। মিটিং ভার্চুয়ালি করার নির্দেশনা রয়েছে। আপ্যায়ন ব্যয় কমিয়ে আনা ও প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলো গুরুত্ব অনুসারে এ, বি, সি ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত করা হয়েছে। একইভাবে নিয়মিত বাজার তদারকি ও টিসিবির কার্যক্রম বাড়ানোর সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। চলছে এ নিয়ে নজরদারিও।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে নানাবিধ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আরো কিছু নির্দেশনা প্রয়োজনে পরে দেওয়া হবে।

করোনা মহাসংকটের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সাময়িক উল্লেখ করে এ সংকট মোকাবিলায় দেশের মানুষকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, দেশের মানুষ কষ্টে থাকুক এটা বঙ্গবন্ধুকন্যা কখনোই চান না। জাতির পিতা দেশ স্বাধীন করেছেন এদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করে হাসি ফোটানোর জন্য। সেই লক্ষ্য পূরণে কাজ করছেন শেখ হাসিনা। তিনি আরো বলেন, গ্রামগঞ্জের কোনো মানুষ না খেয়ে নেই। প্রত্যেকটি মানুষ খেতে পারছে। প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামা-কাপড় আছে। গ্রামের প্রায় সব রাস্তাঘাট পাকা হয়ে গেছে।

মো. তাজুল ইসলাম জানান, অনেক উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়নের আগ্রহ প্রকাশ করছে। আমাদের দেশের অবস্থা এত খারাপ হলে তারা তো আমাদের সহযোগিতা করত না। একটি গ্রুপ বলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নাকি শ্রীলঙ্কার মতো হবে। কেন হবে? শ্রীলঙ্কা কী করেছে আর আমরা কী করছি? ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমাদের একজন শেখ হাসিনা আছেন।

শিগগিরই দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল হয়ে আসবে বলে দাবি করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে এপ্রিল, মে ও জুনে দেশের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির রেকর্ড হয়। জুলাইয়ে এসে কিছুটা কমে এলেও এখন জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এই মূল্যস্ফীতি আগের চেয়েও বেড়ে যাবে।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘জ্বালানির সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই জ্বালানির দাম বাড়লে পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে। তার প্রভাব সার্বিক অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার ওপরে পড়বে। অর্থাৎ দাম বাড়লে, খরচ বাড়লে মূল্যস্ফীতিও বাড়বে।’ এ পরিস্থিতিতে গরিব মানুষ কষ্টে আছে, তাদের এই কষ্ট লাঘবে সরকার কী করবে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সবার জন্যই সরকার। এই ধরনের পরিস্থিতিতে গরিব মানুষের কষ্ট অনেক বেশি হয়। এরই মধ্যে তাদের কষ্ট লাঘবে সরকার ওএমএস, টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। তবে নতুন করে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা থেকে গরিব মানুষকে সুরক্ষা দিতে আরো কী সহায়তা দেওয়া যায় সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেন, ডলারের দাম বৃদ্ধি একটি বৈশ্বিক সংকট। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের দেশে দেশে বাড়ছে ডলারের দাম। যারা যুদ্ধ করছে তাদেরও বাড়ছে, যারা যুদ্ধে উসকানি দিচ্ছেন তাদেরও বাড়ছে। বাংলাদেশেও তার প্রভাব আছে। তবে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করছে। শিগগিরই ডলারের দাম স্বাভাবিক হবে বলে আশা করা যায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close