মাহমুদ আহমদ
ঈদুল আজহা আমাদের যে শিক্ষা দেয়
মুমিন বান্দার জীবনে পবিত্র ঈদুল আজহা এবং কোরবানির গুরুত্ব সীমাহীন। কারণ মুমিনের জীবনের একমাত্র আরাধনা মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। আর প্রকৃত কোরবানি তাকে অত্যন্ত দ্রুত আল্লাহর নৈকট্যে ভূষিত করে। আমরা বাঙালি কোরবানির ঈদ বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কোরবানি শব্দের অর্থ নৈকট্য, ত্যাগ, উৎসর্গ। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যেই এই কোরবানি।
কোরবানির ঈদ পালনের মাধ্যমে বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও নবী হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.) এর অতুলনীয় আনুগত্য এবং মহান ত্যাগের পুণ্যময় স্মৃতি বহন করে। আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির জন্য মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর পশু কোরবানি করে থাকে।
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘অতএব আপনি আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন।’ (সুরা কাউসার : ২)।
পশু কোরবানি একটি প্রতীকী ব্যাপার। এখানে পশু কোরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জানমাল থেকে শুরু করে সবকিছুই কোরবানি করতে প্রস্তুত। হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তার পুরো পরিবারের নজিরবিহীন কোরবানির ইতিহাস মানুষকে যে ত্যাগের শিক্ষা দেয় তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একজন মুমিন তার সবকিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত থাকে।
হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) এবং মা হাজেরার আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশগুলো আল্লাহতায়ালা হজের অংশ হিসেবে গণ্য করেছেন।
‘আল্লাহতায়ালা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে স্বপ্নে দেখালেন, তিনি তার পুত্রকে জবাই করছেন।’ (সুরা সাফ)। পিতা ইব্রাহিম স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গেলে আল্লাহ বললেন, হে ইব্রাহিম! তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছ। আমি তোমাকে নিজ পুত্রকে আমার পথে উৎসর্গ করতে বলেছি, হত্যা করতে নয়। তোমার পুত্র সারাজীবন লোকদের বোঝাবে আল্লাহ এক-অদ্বিতীয়। প্রশ্ন হলো, তাহলে কেন দুম্বা বা ছাগল জবাই করলেন? এর উত্তর হলো- যদি সেদিন এই ঘটনা না ঘটতো তাহলে তৎকালীন ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী কোনো কোনো জাতিতে প্রভুকে বা দেব-দেবীদের খুশি করার জন্য নরবলি তথা মানুষ কোরবানি চলমান থাকত। অতএব আল্লাহ মানবজাতিকে শিক্ষা দিলেন, মানুষ জবাই করার জিনিস নয়, জবাই যদি করতে হয় তাহলে পশু জবাই করো।
ইতিহাস পাঠে জানা যায়, হজরত রাসুলে পাক (সা.) এর শ্রদ্ধেয় পিতা একবার অসুস্থ হলে তার দাদা ১০০ উট জবাই করেছিলেন (সিরাতে নববি)। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, পশু জবাই করা রাসুল (সা.) প্রচলন করেননি বরং আগেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু জবাই করা হতো।
মূল উদ্দেশ্য হলো, হৃদয়েও যদি কোনো পশু সুলভ আচরণ থাকে সেই পশুত্বকে হত্যা করতে হবে, সেটাকে জবাই করতে হবে। হাদিসে আছে, পশু জবাই খোদা তায়ালার নৈকট্য লাভের একটি মাধ্যম তবে তা ওই ব্যক্তির জন্য যে নিষ্ঠার সঙ্গে কেবল আল্লাহতায়ালার ভালোবাসায়, তার ইবাদতের উদ্দেশ্যে ঈমান সহকারে পশু জবাই করে এমন কোরবানিকে আরবিতে ‘নুসক’ বলা হয়েছে, যার আরেকটি অর্থ অনুগত।
আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা আল্লাহর নামে কোরবানি করে তাদের জন্য সীমাহীন সওয়াবের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)।
মহানবী (সা.) বিভিন্ন সময় কোরবানির বিষয়ে তার উম্মতকে নসিহত করেছেন। কারো হৃদয়ে যদি এমন ধারণার উদ্রেক হয় যে, প্রতি বছরই তো কোরবানি দিয়ে যাচ্ছি এবার না হয় দিলাম না, এমনটি চিন্তা-ভাবনা মোটেও ঠিক নয়, কেননা কোরবানি শুধু একবারের জন্য নয় বরং তা সারা জীবনের জন্য। হাদিস থেকে জানা যায়, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘হে লোক সব! জেনে রাখ, প্রত্যেক পরিবারের পক্ষে প্রত্যেক বছরই কোরবানি করা আবশ্যক।’ (আবু দাউদ ও নাসাঈ)।
হজরত ইবনে উমর (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) মদিনায় ১০ বছর অবস্থান করেছেন এবং বরাবর কোরবানি করেছেন। (তিরমিজি)।
মহানবী (সা.) বলেছেন, কোরবানির দিনে কোরবানি করাই সবচেয়ে বড় ইবাদত। কোরবানির জন্তুর শরীরের প্রতিটি পশমের বিনিময়ে কোরবানিদাতাকে একটি করে সওয়াব দান করা হবে। কোরবানির পশুর রক্ত জবাই করার সময় মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। (মেশকাত)।
কোরবানির বিনিময়ে সওয়াব পেতে হলে অবশ্যই কোরবানিটা হতে হবে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে।
আল্লাহপাকের দরবারে আমাদের প্রার্থনা, হে আল্লাহ! আমাদের এ কোরবানি তুমি গ্রহণ করো আর আমাদের আত্মাকে পবিত্র করো, আমিন।
* লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
"