রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৯ এপ্রিল, ২০২৪

বিশ্লেষণ

ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যরে বন্ধন ঈদুল ফিতর

বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর অন্যতম প্রধান ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের দিনটি অশেষ তাৎপর্য ও মহিমায় অনন্য। বিশ্বের মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পবিত্র ঈদুল ফিতর অনাবিল আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়। ঈদ মুসলিম উম্মাহর জাতীয় উৎসব। ঈদুল ফিতর প্রতি বছর ধরণিতে এক অনন্য-বৈভব বিলাতে ফিরে আসে। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানের সিয়াম সাধনার শেষে শাওয়ালের এক ফালি উদিত চাঁদ নিয়ে আসে পরম আনন্দ ও খুশির ঈদের আগমনী বার্তা।

সিয়াম পালনের দ্বারা রোজাদার যে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার সৌকর্য দ্বারা অভিষিক্ত হন, ইসলামের যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, দানশীলতা, উদারতা, ক্ষমা, মহানুভবতা, সাম্যবাদিতা ও মনুষ্যত্বের গুণাবলি দ্বারা বিকশিত হন, এর গতিধারার প্রবাহ অক্ষুণ্ণ রাখার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে ঈদুল ফিতর সমাগত হয়। এ দিন যে আনন্দধারা প্রবাহিত হয়, তা অফুরন্ত পুণ্যময়তা দ্বারা পরিপূর্ণ। শাওয়ালের চাঁদটি দেখামাত্র বেতার-টেলিভিশন ও পাড়া-মহল্লার মসজিদের মাইকে ঘোষিত হয় ঈদের আগমনী বার্তা। ঈদ প্রতিটি মুসলমানের ঘরে নিয়ে আসে আনন্দের সওগাত। ঈদগাহে কোলাকুলি সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, ভালোবাসার বন্ধনে সবাইকে নতুন করে আবদ্ধ করে।

ঈদুল ফিতর বা রোজা ভাঙার আনন্দ-উৎসব এমনই এক পরিচ্ছন্ন আনন্দ অনুভূতি জাগ্রত করে, যা মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের পথপরিক্রমায় চলতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করে। ঈদ ধনী-গরিব সব মানুষের মহামিলনের বার্তা বহন করে। এক কাতারে দাঁড়িয়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের একসঙ্গে নামাজ পড়ার সুযোগ এনে দেয় ঈদ। ঈদের খুশির এক অন্যতম উপকরণ হচ্ছে ঈদের দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে রোজা রাখার পর ঈদের নামাজ আদায়ের পর ঈদগাহ ময়দানে একে অন্যের হাতে হাত, বুকে বুক রেখে আলিঙ্গন করলে মুসলমানরা সারা মাসের রোজার কারণে ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট ভুলে যায়। সমাজের সর্বস্তরের মুসলিম জনতা ঈদের নামাজের বার্ষিক জামাতে সানন্দে উপস্থিত হয়। এ যেন একে অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ, কোলাকুলি ও কুশলবিনিময়ের এক অপূর্ব সুযোগ। তখন ছোট-বড়, ধনী-গরিব, আমির-ফকির, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের মধ্যে কোনো রকম ভেদাভেদ বা বৈষম্য থাকে না। ঈদুল ফিতর মুসলিম উম্মাহর কাছে অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। এ দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঈদুল ফিতরের দিন মুসলমানদের জাতীয় জীবনে সাম্য-মৈত্রীর যে বাস্তব নিদর্শন প্রকাশিত হয়, তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, ঐক্যের মধ্যেই সুনিশ্চিত শান্তি সুধা বিদ্যমান।

পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের দীর্ঘজীবী উম্মতদের সঙ্গে নেকির প্রতিযোগিতায় আমরা যাতে পরাজিত না হই, সেজন্য আল্লাহতায়ালা রামাদানে ‘লাইলাতুল কদর’ দান করে যে মহাসুযোগ প্রদান করেছেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতর সামাজিক আদব-কায়দা ও শৃঙ্খলাবোধ শিক্ষা দেয়। মানবস্রষ্টা আল্লাহর আইন পার্থিব জীবনে মেনে চললে ইহকালের মতো পরকালেও এরূপ আনন্দময় জীবন ও প্রশান্তি লাভ করা যাবে, তার বাস্তব জ্ঞানদান করে ঈদুল ফিতর। রামাদানের স্পর্শ পেয়েও মানুষের যে অংশ পুরোপুরি কলুষমুক্ত হয়নি, ঈদুল ফিতর সেই অংশের কলুষতামুক্ত করে সমাজকে সজীব করে তোলে। ঈদুল ফিতর মানুষকে বিনয়ী, নম্র ও হৃদয়বান করে তোলে। যেন ঈদের প্রভাব থেকেই মানুষ অন্যের সুখে সুখী হওয়ার তাগিদ অন্তরও অনুভব করে। ছোটদের প্রতি স্নেহ-মমতা এবং বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তির প্রাণপ্রবাহে তাদের হৃদয় মন ভরে যায়। স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে তারা যেন সৃষ্টির সঙ্গেও সদ্ব্যবহার করতে পারে, যেন সৃষ্টিকে ভালোবেসে সন্তুষ্ট করতে পারে।

বস্তুত নিছক এক দিনের হইচই ও মাতামাতির মধ্যেই ঈদের সার্থকতা নিহিত নয়; বরং প্রত্যেক ব্যাপারে পরিচ্ছন্ন মন ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী হওয়াতেই ঈদ উৎসবের সার্থকতা ও সফলতা। ঈদুল ফিতরের প্রকৃত তাৎপর্য হলো ব্যক্তি জীবনের নানা কুপ্রবৃত্তি বা নফসানিয়াতের দমনের সঙ্গে সঙ্গে নানা প্রকার দান ও দাক্ষিণ্যের মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো রমাদানে মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার দ্বারা মানুষ যে শিক্ষা লাভ করেছে, দান-খয়রাত হচ্ছে তার প্রায়োগিক প্রমাণ। কাজেই ঈদুল ফিতরে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করার পাশাপাশি অন্যান্য দান, সাদাকাহ এবং আপনার ব্যক্তিগত জীবনের সমূহ কুপ্রবৃত্তির উৎসারণ করার সাধনার মধ্যেই সিয়াম পালনের সফলতা। আর এরই সার্থকতার প্রমাণ হচ্ছে ঈদুল ফিতর।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেন সভ্যতার শীর্ষে অবস্থানকারী একটি দেশ। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ দেশটি একটি চমৎকার বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। অসংখ্য অগণিত প্রবাসীর পদস্পর্শে এ মাটি তার সূর্যসন্তানদের সৃষ্টি করেছে। যারা ব্রিটেনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাখছেন অসাধারণ ভূমিকা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ দেশে বাস করছেন অসংখ্য বাংলাদেশি। যাদের বেশির ভাগই মুসলমান। যুক্তরাজ্যে ৩০ লাখেরও বেশি মুসলমান বাস করলেও তাদের জন্য দুটি ঈদে কোনো সরকারি ছুটি বরাদ্দ নেই, যা নিতান্তই অমানবিক। যেখানে অন্যান্য ধর্মের বিভিন্ন দিবসগুলোতে ছুটি রাখা হয় সেখানে মুসলমানদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ আমাদের নতুন প্রজন্মকে তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। এমতাবস্থায় যে সংস্কৃতির মধ্যে আমাদের শিশুরা বড় হচ্ছে তা তাদের অন্তরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ঈদের দিন মুসলমানদের কাছে আনন্দের হিসেবে যেখানে সন্তানরা তাদের মা-বাবাকে কাছে পাওয়ার কথা, সেখানে ঈদের দিনও তাদের কাজের পেছনে ছুটতে হচ্ছে। মুসলমানদের এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিনেও তাদের জন্য নেই কোনো ছুটি, যা সত্যিকার অর্থেই একটি ধর্মবিশ্বাসের প্রতি প্রচণ্ড আঘাত।

তার পরও বিশ্বের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের রমজান মাসের রোজার ভুলত্রুটি দূর করার জন্য ঈদের দিন অভাবী বা দুস্থদের কাছে অর্থ দেওয়া হয়, যেটিকে ফিতরা বলা হয়ে থাকে। এটি প্রদান করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। আমাদের মধ্যে কেউ যখন মনের খায়েশ মেটাতে ব্যস্ত, তখন একমুঠো খাবার জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন কেউ কেউ। আমরা তাদের সারা বছরের বস্ত্রের সংকুলান হয়তো করতে পারব না, কিন্তু ঈদ উপলক্ষ করে সামর্থ্য অনুযায়ী অন্তত একজন অসহায় শিশুর পাশে দাঁড়াতে তো পারি। আমাদের নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশীদের মধ্যেও থাকতে পারে এমন অসহায় সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও মানুষ। তাদের কথাও ভেবে দেখতে হবে। আমাদের একটু সুদৃষ্টি অসংখ্য অসহায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। তাই মুসলমানদের জীবনে ঈদের তাৎপর্য অনেক। ঈদুল ফিতরের দিনে দান-খয়রাতের মাধ্যমে পবিত্র ঈদের উৎসবকে আনন্দে উদ্ভাসিত করে তোলা। জাকাত-ফিতরার মাধ্যমে ধনী ও গরিবের মধ্যকার ভেদাভেদ দূরীভূত হয়। আর এতেই হয় মুসলিম হৃদয় উদ্বেলিত। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো নির্বিশেষে একই কাতারে মিলিত হওয়া মানব সম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন পবিত্র ঈদ।

ঈদ মুসলমানদের জন্য শুধু একটি ধর্মীয় উৎসবই নয়, সম্প্রীতি-সৌভ্রাতৃত্ব শেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষও এই উৎসবের মাধ্যমে প্রত্যেক মুসলমান একে অন্যের আরো কাছাকাছি আসে। শুধু মুসলমান নয়, অন্যান্য ধর্মের মানুষের সঙ্গেও আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। পবিত্র রমজান আমাদের চিত্তশুদ্ধির যে শিক্ষা দিয়েছে, ঈদুল ফিতর হচ্ছে সেই শিক্ষা কাজে লাগানোর দিন। আজ একটি দিনের জন্য হলেও ধনী-গরিব সবাই দাঁড়াবে এক কাতারে। ভুলে যেতে হবে সব বৈষম্য, সব ভেদাভেদ। হিংসা, বিদ্বেষ ও হানাহানি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে হবে। শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে সারা বিশ্বে মুসলমানদের মর্যাদা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। ইসলাম যে প্রকৃত অর্থেই শান্তির ধর্ম, সেটি প্রমাণ করতে হবে। সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক ঈদের সওগাত। আলিঙ্গনের ভেতর দিয়ে সবাই ভুলে যাক হিংসা-বিদ্বেষ। আমাদের ঘরে ঘরে ফিরে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি। বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য।

ঈদুল ফিতরের প্রতিটি অনুশাসনে ইবাদতের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, তা ছাড়া এ দিন প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে সত্যনিষ্ঠ জীবনযাপনের তাগিদ এবং মানবতার বিজয় বার্তা। প্রকৃতপক্ষে ঈদ ধনী-দরিদ্র, সুখী-অসুখী, আবালবৃদ্ধবনিতা সব মানুষের জন্য কোনো না কোনোভাবে নিয়ে আসে নির্মল আনন্দের আয়োজন। ঈদ ধর্মীয় বিধিবিধানের মাধ্যমে ধনী-গরিব সর্বস্তরের মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেয় এবং পরস্পরের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা দেয়। আমাদের একান্ত প্রার্থনা, জগতের সব মানুষের সুখ-শান্তি, কল্যাণ ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি। আগামী দিনগুলো সত্য, সুন্দর ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হোক। হাসি-খুশি ও ঈদের অনাবিল আনন্দে প্রতিটি মানুষের জীবন পূর্ণতায় ভরে উঠুক! ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, সংযম, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ পরিব্যাপ্তি লাভ করুক- এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close