হাফিজ মুহাম্মদ

  ০৩ এপ্রিল, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

পৃথিবীর ফুসফুস রক্ষায় সবুজ বনায়ন সৃজন হোক

আমাদের সমাজে একটা কথা বেশ প্রচলিত- ‘গাছ লাগাই, পরিবেশ বাঁচাই।’ কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই মূল্যবান উক্তিটি সবাই স্বীকার করছি, কিন্তু কেউ-ই যথাযথভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি না। কাজেই আমরা বলতে পারি, মানুষ নিজেদের স্বার্থে আজকাল কোনো কিছু করতে দ্বিধাবোধ করছে না। আমাদের মানবসভ্যতা যেভাবে উন্নয়নের দ্বারপ্রান্ত উন্মোচন করে চলেছে, ঠিক ততটুকুই নিজেদের পায়ে কুড়াল মারতে তারা একটুও দ্বিধাবোধ করছে না। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। একইভাবে বদলে যাচ্ছে সমাজ, দেশ, জাতি ও কাল।

এ জন্য সবুজ অরণ্যই পারে মরুভূমির রুক্ষতাকে দূর করতে। ফিরিয়ে দিতে পারে অক্সিজেনের বিপুল সমারোহ। তখন সতেজ পৃথিবীতে নির্মল হাওয়া আমরা উপভোগ করতে পারব। একটু পুরোনো ইতিহাস ঘাঁটলে অনুধাবন করা যায়- আদিম মানুষ পৃথিবীতে আসার সময় সবুজের সমারোহে ভরা ছিল, পর্যাপ্ত শীতল ছায়া ছিল, ক্ষুধা নিবারণের জন্য গাছপালার ওপর নির্ভর করত। এমনকি বিভিন্ন ধরনের বনওষধি তৈরি করতে গাছপালার ওপর নির্ভর করা হতো। কিন্তু আজ মানুষের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে, ইটপাথরের ব্যস্ত নগরী তৈরি করছে, গাছপালা উজাড় করছে। সুষ্ঠু পরিবেশ সম্পর্কে তেমন কোনো কারো মাথাব্যথা নেই! যেন প্রকৃতির সঙ্গে একটা নীরব সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন যেভাবে গাছ কেটে উজাড় করছে, ঠিক সেই পরিমাণে গাছপালা তারা রোপণ করছে না। আবার যেসব গাছপালা অবশিষ্ট রয়েছে, সেসবেরও তেমন কোনো যত্ন নিচ্ছে না।

কাজেই আমরা গাছপালাকে পৃথিবীর ফুসফুস বলে জানি। কিন্তু জেনে-বুঝে আজ বারবার গাছপালা ধ্বংস করে পৃথিবীর ফুসফুসকে গলা টিপে ধরছি। যার কারণে পৃথিবীতে সময়ে-অসময়ে নানা রকমের দুর্যোগ ক্রমাগতভাবে আঘাত হানছে। এতে পৃথিবীর বুকে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। পৃথিবীর স্নিগ্ধ পরিবেশ উলোট-পালোট করে দিচ্ছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, সিডর, সাইক্লোন, টর্নেডো, লবণাক্ততা, শিলাবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, নদীভাঙন, কালবৈশাখীর ব্যাপক তাণ্ডবতা ইত্যাদি পৃথিবীর বুকে আঘাত হানছে। ভেঙে যাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আমাদের বাংলাদেশ প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় আরো এগিয়ে থাকবে। তা ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় ইটভাটার নির্গত কালো ধোঁয়ার কারণে বায়ুমণ্ডলের ওজন নামক স্তরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের প্রক্রিয়া শীর্ষস্থানে রয়েছে এবং বায়ুদূষণের ফলে নগরবাসী প্রতিনিয়ত নানা ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করছে।

অনেক সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জলবায়ুর অস্বাভাবিক কারণে দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হতে দেখা গেছে। বৈজ্ঞানিকরা জানিয়েছেন, গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে আমাদের বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় এক মিটার সমুদ্রপৃষ্ঠে তলিয়ে যেতে পারে। যার প্রমাণ আমরা বর্তমানে সেন্টমার্টিন দ্বীপে দেখতে পাচ্ছি। লক্ষ করা যাচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যে তা যেন সমুদ্রপৃষ্ঠে তলিয়ে যেতে পারে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে পৃথিবীর মেরু অঞ্চলে বরফ অস্বাভাবিকভাবে গলে যাচ্ছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু দেশ চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, জাপান, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়াসহ প্রভৃতি দেশ। আর বিভিন্ন পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ খরার অভিশাপে উদ্বাস্তু হবে। তখন জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়বে, স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রভাবে নানা ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাবে। এসব পর্যালোচনা করে শীতল মনে একবার প্রশ্ন জাগে? এই বিংশ শতাব্দীতে এসে প্রকৃতি আজ নিজ খামখেয়ালিতে মানবজাতির সঙ্গে ন্যায্য বিচার করছে। ফলে বিশ্ব মহামারি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব সময়ে অসময়ে পৃথিবীতে গড়িয়ে আসছে। তা মোকাবিলা করতে বড়-ই হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের মানবজাতির।

বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার দেশ হিসেবে পরিচিত থাকলেও বিগত কয়েক বছর ধরে অস্বাভাবিকভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গিয়ে খরায় পরিণত হচ্ছে দেশের উত্তরাঞ্চল, যা বর্তমানে আংশিকভাবে মরুভূমি অঞ্চল বললে কোনো ভুল হবে না? যেহেতু বিপুল জনসংখ্যার দেশে তা বিরাট সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। এর ফলে হাজার হাজার মানুষ বেকারত্বের অভিশাপ থেকে রেহাই পাবে না। এদিকে বন বিভাগের বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, একটি দেশের পরিবেশ রক্ষা করার জন্য শতকরা ২৫ ভাগ বনাঞ্চল থাকা অবশ্যক। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি তথ্য মতে, শতকরা ১৭ ভাগ বনাঞ্চলের দেখা মেলে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এর জন্য দায়ী- বন বিভাগের সরকারি কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী বনদস্যুর লোভ-লালসার কারণে। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর জাতীয় ভারসাম্য রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছে, পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সুতরাং দেশের পরিবেশ রক্ষার্থে সরকারকে কঠোর সজাগ হতে হবে এবং আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রশাসনের তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে।

ইদানীং আমরা বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় লক্ষ করছি- জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা দেখল দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। রিও ডি জেনেরিওতে সর্বোচ্চ ৪২ ডিগ্রি সেন্টিমিটার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হলেও আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, মানুষ যেটা অনুভব করছে সেই বিচারে (ফিলস লাইক) তাপমাত্রা ৬২ দশমিক সেন্টিমিটার ছাড়িয়ে গেছে, যা ব্রাজিলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর সেখানে প্রায় ৭০০ জন স্থানীয় মানুষ আটকা পড়ে। তাই প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতি ও আঘাত হানছে। এর মূল কারণ হচ্ছে ব্রাজিলের আমাজন বন থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত সিংহভাগ বনভূমি দাবানলে পুড়ে যাচ্ছে কিংবা মানুষ নিজেদের স্বার্থে ওই বনভূমি ধ্বংস করে ফেলছে। জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের জন্য জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।

সর্বোপরি, আমরা বলতে পারি- পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা দায়িত্ব আমাদের সবার। তাই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হবে। তাহলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের হাত থেকে কিছুটা হলেও আমরা ইতিবাচক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হব। এ জন্য আমাদের চারপাশে বৃক্ষ নিধন করা নয় বরং সবুজ বনায়ন গড়ে তুলতে হবে। বসতবাড়ির আশপাশে, রাস্তার দুধারে, পতিত জমিতে, বাঁধের দুধারে, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতের পতিত জমিতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। এমনকি শহরের মধ্যে বিভিন্ন বাড়ির ছাদে, বারান্দায় বৃক্ষরোপণ করতে আগ্রহী হতে হবে। পরিবেশ রক্ষার্থে সজাগ ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশের সরকারে উচিত- বিভিন্ন সামাজিক বনায়ন সৃষ্টি করতে এগিয়ে আসা। দেশের পরিবেশ ও বন বিভাগের জন্য যেসব আইন প্রয়োগ করা হয়েছে, তা কেউ লঙ্ঘন করলে কঠোর শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে।

যেহেতু দেশের বনভূমির মধ্যে সুন্দরবন ৪৪ শতাংশ অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে, তা সার্বিকভাবে সুরক্ষা করতে হবে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে পরিবেশবান্ধব সম্পর্কে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করতে হবে। গাছপালা আমাদের নিকটতম আত্মীয় বটে! কাজেই এই নিকটতম আত্মীয়কে টিকিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। আসুন, আমরা সবাই বৃক্ষকে টিকিয়ে রাখি, নতুন নতুন বৃক্ষরোপণ করি। আর কেউ যদি একটি গাছ কাটতে চায় তাহলে তাকে দুটি গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের সমাজে এই স্লোগানটি অব্যাহত থাকুক- ‘গাছ লাগাই, পরিবেশ বাঁচাই’ এবং বিংশ শতাব্দীতে দেশের অর্থনীতি উন্নয়নকে যেভাবে জোর দেওয়া হয়, ঠিক একইভাবে পরিবেশ রক্ষার্থে সবুজ বনায়ন সৃষ্টি করতে আগ্রহী হতে হবে। তাহলে আমরা জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তন মোকাবিলায় কাঙ্ক্ষিত আশানুরূপ সাফল্য বয়ে আনতে সক্ষম হব।

লেখক : কবি, গীতিকার ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close