বাসুদেব রায়

  ২৪ মার্চ, ২০২৪

মুক্তমত

আগুন নিয়ে খেলা নাকি অপরিকল্পিত কাঠামো

সভ্যতার প্রথম ও বিস্ময়কর আবিষ্কার হচ্ছে আগুন, যা দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কোনো না কোনো কাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আগুন আবিষ্কার করে মানুষ অন্ধকার দূর করে আলোর পথ সৃষ্টি করেছিল। কখনোই ভাবেননি যে সেই আগুনে নিজেকে কংকাল হতে হবে। এই আগুন আজ একটি দুর্ঘটনার নাম, বিভীষিকার নাম, আর্তনাদের নাম, ধ্বংসস্তূপের নাম। আজ সবচেয়ে আলোচিত ও ভয়াবহ দুর্ঘটনাই হচ্ছে অগ্নিকাণ্ড। এর মাত্রা এখন এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে চোখ খুললেই দৈনিক পত্রিকার পাতার শিরোনাম। বড় বড় অট্টালিকা থেকে শুরু করে বড় বড় বাজার এ অগ্নিকাণ্ডের শিকার। এখানে যে শুধু আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিই হচ্ছে তা নয় জীবন্ত মানুষকে জ্বলন্ত মুখাগ্নি দেওয়া হচ্ছে। আজ আমাদের চেতনাশক্তি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে এই নির্মম অগ্নিকাণ্ডকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে সহজে মানতে শুরু করেছি। তা ছাড়া এখানে এক তদন্তের কাজ শেষ না হতে আরেক তদন্তের কাজ শুরু হচ্ছে। তাই মনে হয় এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পেছনের রহস্যময় কাহিনির আর সত্য উন্মোচন হচ্ছে না। আসলে তাই কি মনে হয়? যদি হয় তাহলে আমরা আগুন নিয়ে খেলছি। মনে পড়ে গ্রামের সেই তাচ্ছিল্য প্রবাদের কথা, ‘আগুন লাগছে তা কি হইছে! ছ্যাওয়া তো মোর দমকল দেখ্ছে।’

বাংলাদেশ অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপকতা ও প্রসারণ জানতে হলে একটু পেছনের বছরগুলোতে যেতে হবে। ২০২২ সালের প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে ছোট-বড় ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিদুর্ঘটনার কথা জানা যায়। ঠিক তার পরের বছরে অর্থাৎ ২০২৩ সালে সারা দেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স (সূত্র : দ্য ডেইলি স্টার)। সে হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন ৬৬-৭৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এসব অগ্নিকাণ্ড গ্রামে ও শহরে সমান তালে ঘটলেও তুলনামূলকভাবে শহরে নাশকতা বেশি। ২০২২ সালে অগ্নিদুর্ঘটনায় ৮৫ জনের লাশ উদ্ধার এবং প্রায় ৩৪৩ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল এবং ২০২৩ সালে, ১০২ জন নিহত এবং প্রায় ৭৯২ কোটি ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ১৪ টাকা মূল্যের সম্পদের ক্ষতি হয়। আর যারা আহত অবস্থায় মেডিকেলে মারা যায় তাদের খবর তো ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স রাখে না। যার বেশির ভাগ ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি শহর অঞ্চলে বেশি, যার মধ্যে ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে চিন্তার ব্যাপার হচ্ছে, এসব অগ্নিকাণ্ড মার্চ ও এপ্রিল মাসের দিকে বেশি ঘটে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণে এসব আগুন লাগার কারণ হিসেবে বৈদ্যুতিক গোলযোগ, বিড়ি ও সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো, চুলা ও গ্যাসের লাইন ও অন্যান্য বিষয়কে দায়ী করেছেন। ধরে নিলাম বিভিন্ন কারণে যান্ত্রিক ত্রুটি হতে পারে, তবে অগ্নিদুর্ঘটনার ব্যাপকতা ও নাশকতা এত বেশি হয় কেন? তার যথেষ্ট প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ হিসেবে অপরিকল্পিত কাঠামো ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। আমাদের আর কত শুনতে হবে চকবাজার, বঙ্গবাজার, মগবাজার, সিদ্দিকবাজার, নিউমার্কেট, বনানী ইত্যাদি ইত্যাদিসহ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেইলি রোডের ঘটনা। যদিও এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তবে আগুন নেভানোর কৌশল হিসেবে তা যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নতমানের কৌশলের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা বাঞ্ছনীয়।

অগ্নিকাণ্ডের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ যদি অপরিকল্পিত কাঠামো হয়, তবে অপরিকল্পিত কাঠামোর অট্টালিকার মালিক ও অসাধু ব্যবসায়ীরাই এর জন্য দায়ী। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সরকার এ ব্যাপারে দৃষ্টান্তমূলক কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। যদিও সরকার অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩ চালু করেছিল, তবে অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে তাই কি যথেষ্ট? প্রশ্নই থেকে যায়। আশা করি অতি শিগগিরই সরকার এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ ও সুষ্ঠু পদক্ষেপ নেবেন। এ ছাড়া অসাধু অর্থলিপ্সাদের আইনের আওতায় এনে সমাজে নীতিমূলক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। অগ্নিদুর্ঘটনা আজ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে, তাই সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে হবে। কেননা জনসচেতনতাই অগ্নিকাণ্ডের প্রধান নিয়ামক। জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক। যেমন : তা হতে পারে ব্যানার, ফেস্টুন, লিফলেট, মঞ্চ নাটক কিংবা সামাজিক মিডিয়ায় বিভিন্ন সচেতনতামূলক বার্তা। বিশেষ করে গ্যাস লাইন, বিদ্যুৎ লাইন ও বিস্ফোরণ কেমিক্যালের ব্যবহারে দিকে বিশেষ নজর রাখা হোক। গ্যাস লাইন ও কেমিক্যাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্রহীতাকে উপযুক্ত কারণ দর্শানো হোক। সর্বোপরি আমরা নিজেরাই নিজে সচেতন হই এবং অন্যকে এ বিষয়ে সচেতন করি কেননা একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্নাই নয় শুধু, একটি পরিবারের মৃত্যু। আর এটাই সত্য, আগুনের আবিষ্কার মানবসভ্যতার আশীর্বাদস্বরূপ।

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close