সাইফুল ইসলাম স্বপ্নীল

  ২৩ মার্চ, ২০২৪

মুক্তমত

মৃত্যু, অপমৃত্যু ও সমকালীন ভাবনা

মানবজীবনের চিরন্তন ও শাশ্বত সত্য হচ্ছে মৃত্যু। মৃত্যু হচ্ছে ইহকাল ও পরকালের সংযোগ। সংসার সাগর পাড়ি দিতে দিতে জীবনের যাবতীয় প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির জটিল হিসাব করতে করতেই মৃত্যু নামক অধ্যায় হঠাৎ জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দেয়। মৃত্যু মানে না কোনো বয়স, স্থান-কাল-পাত্র অথবা বাঁধা ছক। মানে না ধনী- মধ্যবিত্ত-দরিদ্র; মানে না রাষ্ট্রনায়ক-ফকির-মিসকিন। যেকোনো সময় যে কারো জীবনে হানা দিতে পারে। অকালে মৃত্যু অথবা বার্ধক্য মৃত্যু বলে কোনো শব্দ প্রাণ হরণকারীর কাছে নেই। যখনই কারো ডাক আসে তখনই আত্মা চলে যায় ওপারে।

নমরুদ-ফেরাউন, নবী-রাসুল, পীরে-কামেল-মাশায়েক, ধর্মগুরু, পুরোহিত, ভান্তে, আস্তিক-নাস্তিক থেকে এ যুগের মাইকেল জ্যাকসন কেউই মৃত্যু নামক অমোঘ সত্য থেকে বাঁচতে পারেনি। পবিত্র কোরআন অনুসারে প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যুকে উপেক্ষা করার মতো এ পৃথিবীতে কোনো কিছুই নেই। মাইকেলের ভাষায় ‘জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে!’ সমরেশ মজুমদারের ভাষায়, ‘মৃত্যু কী সহজ, কি নিঃশব্দে আসে অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়।’

জগৎ সংসারের কতশত সুখ-দুঃখ, যন্ত্রণা-বেদনা পাড়ি দিয়ে ওপারে চলে যেতে হয়! জীবননদী বাইতে বাইতে এক দিন অস্তাচল সূর্যের মতোই নিভে যায় জীবনপ্রদীপ! জীবনখাতায় অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মানুষকে যবনিকা টানতে হয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিধির বিধান উপেক্ষা করা যায় না। আবার অনেকেই জীবনের প্রতি বিষাদগ্রস্ত হয়ে এই সুন্দর, বর্ণিল পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যেতে চায় ওপারে। অপমৃত্যু হয়ে তেমনি অবন্তিকার মতো হাজারো তরুণ-তরুণী, আবালবৃদ্ধবনিতা প্রতিনিয়ত চলে যায় জীবনের মায়া ছেড়ে। সুন্দর এ পৃথিবীর আলো-বাতাস-প্রকৃতি আর কতশত স্মৃতি রেখে

চলে যেতে হয়! চলে যায় অসীমে, মহাশূন্যে, পরপারে।

আজকে এলাকার জয় ভাই মৃত্যুবরণ করেছেন। তাকে গতকাল চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে হার্টে রিং পরানো হয়েছিল। গতকালও তিনি হাসিমুখে ফেসবুকে একটি ছবি দিয়েছিলেন। সবাই তার জন্য শুভকামনা ও দোয়া করেছেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণচঞ্চল মানুষটি যেন নিমিষেই হারিয়ে গেল। খুবই পরিচিত মুখ এবং সমাজসেবক, জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে এলাকায় তার অনেক খ্যাতি রয়েছে। কিন্তু হায় মধ্যবয়সি সুঠামদেহী এ ভাইটি সবাইকে কাঁদিয়ে পরপারে পাড়ি দিলেন।

কেউ কেউ বিশ্বাস করেন জীবনানন্দ দাশের শঙ্খচিল বা শালিকের বেশে অথবা সন্ধ্যের আকাশে সুদর্শন ওড়ার মতো ফিরে আসার। আবার কেউ আফসোস করে বলেন, হায় জীবন ছোট কেন? একটা কচ্ছপ কেন সাড়ে তিন শ বছর বাঁচবে? একটা তিমি কেন পাঁচ শ বছর বাঁচবে? কিন্তু সৃষ্টির সেরা জীব বলে খ্যাত মানুষ কেন ৭০ বছর বাঁচবে? কেন, কেন, কেন? এই আফসোস রেখে এ পৃথিবী থেকে বিচ্ছেদ হয় মানুষের। সে বিচ্ছেদ অনন্ত, অসীম। মাঝে মাঝে মনে হয় প্রতিনিয়ত মৃত্যু আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

যে মানুষটি সবার মধ্যমণি বা চোখের মণি হয়ে থাকে, তাকেও চলে যেতে হয় অকালে স্রষ্টার ডাকে। কিন্তু হায় বাস্তবতা কি! সেই প্রিয় মানুষটিকে মানুষ কত দিনইবা স্মরণ রাখে? সপ্তাহ, মাস, বছরান্তে ঠিকই ভুলে যায় সেই ভাইরাল চোখের মণি মানুষটিকে। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘যেতে নাহি দেব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়!’ মনে হয় হেলায় হেলায় দিন গুনেছি, প্রহর গুনছি শেষখেলার। চরম সত্য হচ্ছে মৃত্যু না থাকলে পৃথিবীটা হয়তো এত সুন্দর মনে হতো না। গৌতম বুদ্ধ বলেন, ‘বর্ষাকালে এখানে, শীত-গ্রীষ্মে ওখানে বাস করব- মূর্খরা এভাবেই চিন্তা করে। শুধু জানে না জীবন কখন কোথায় শেষ হয়ে যাবে।’

তবে কেউই চাই না অবন্তিকার মতো এত প্রাণচঞ্চল, বাঁচতে উৎসাহদানকারী মেয়ে এভাবেই অকালে ঝরে যাক। যে মেয়েটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানে হতাশা দূর করার জন্য বাসায় একা না থাকতে উৎসাহ দিয়েছিল, সে মেয়েটিই কি না এভাবে নিজেকে শেষ করে দিল! মৃত্যুর জন্য আম্মান সিদ্দিকী ও একজন সহকারী প্রক্টরকে অভিযুক্ত করেছে, তার সুষ্ঠু বিচার রাষ্ট্রীয় আইনে হোক। আশা করছি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক সাদেকা হালিম এ ঘটনার সুষ্ঠু সমাধান বের করবেন। ফুল ফোটার আগেই পাপড়িগুলো ঝরে গেলে বৃক্ষ কষ্ট পায়, তার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। অবন্তিকারা এ পৃথিবীর পাপড়িস্বরূপ। আমরা চাই সব হতাশা ও ভুল ফুল হয়ে ফুটুক। কোনো অবস্থাতেই যাতে এ পাপড়িগুলো ঝরে না পড়ে সে রকম সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামো বিনির্মাণ করা আমাদের সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ সমাজের দায় কোনো অংশেই কম নয়।

লেখক : প্রভাষক, সরকারি হাজী আবদুল বাতেন কলেজ

সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close