অলোক আচার্য

  ২১ মার্চ, ২০২৪

আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ

ট্রাম্পের ট্রাম্পকার্ড বনাম বাইডেনের ওভারট্রাম্প

সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মার্কিন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিশ্চিত করেছেন গতবারের দুই প্রতিযোগী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জো বাইডেন। এত দিন দল থেকে মনোনয়ন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন দুজনেই। এবার তা নিশ্চিত হওয়ায় নির্বাচনের মাঠ জমে উঠতে শুরু করেছে। ২০২০ সালেও এদুজনই নির্বাচনের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এমনটা সচরাচর হয় না। কিন্তু দুদলেই এই দুই প্রার্থীই নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। যারা তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ছিলেন তারা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়েছেন। মূলত দুদলেই এই দুই প্রার্থী ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয়। শেষ পর্যন্ত এই দুজনেই দুদল থেকে মনোনয়ন পেয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো না হলেও এটাই নিশ্চিত। ফলে নির্বাচন হতে যাচ্ছে ট্রাম্প বনাম বাইডেন। ঠিক গতবারের চিত্র। শুধু পরিস্থিতি ভিন্ন। গতবার ট্রাম্পের বিপক্ষে দাঁড়ানোর অনেক জায়গা ছিল। কিন্তু এবার যেহেতু তিনি ক্ষমতায় নেই ফলে পরিস্থিতি সে রকম হবে না জো বাইডেনের জন্য। তবে ট্রাম্প হয়তো তার জায়গায় অনড় রয়েছেন। রয়টার্সের প্রতিবেদন দুই নেতার এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ৭০ বছর পর আবার এ রকম ‘রিম্যাচ’ হচ্ছে। অর্থাৎ পরপর দুই নির্বাচনে একই প্রার্থীর মধ্যে প্রতিযোগিতা হওয়া। গতবারের পরাজয়ের পর ট্রাম্প এখন আগের চেয়ে অনেকটাই শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন বলেই মনে করা হচ্ছে। বিভিন্ন জরিপের ফল অন্তত সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ও সায়েনা কলেজের এক জরিপে দেখা গেছে, বাইডেনের ওপর মার্কিনিদের আস্থায় ঘাটতি রয়েছে। তিনি যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তা নিয়েও তাদের মনে সন্দেহ রয়েছে। এটা তাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে পেছনে ফেলেছে। জরিপে দেখা গেছে, ট্রাম্প ৫ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন। আগামী নভেম্বরে এ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।

দেশব্যাপী নিবন্ধিত ভোটারদের মধ্যে চালানো নতুন জরিপে প্রেসিডেন্ট বাইডেন পেয়েছেন ৪৩ শতাংশের সমর্থন; তার প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্প ৪৮ শতাংশ সমর্থন পেয়ে এগিয়ে আছেন। ১০ শতাংশ ভোটার কোনো মন্তব্য করেননি। ফলে ট্রাম্পের হাতের ট্রাম্পকার্ড এবং বাইডেনের ওভারট্রাম্প ঠিক কী হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। দুই বয়স্ক (বাইডেনের ৮১ এবং ট্রাম্পের ৭৭ বছর) প্রেসিডেন্টের লড়াইয়ে মার্কিনিরা কাকে সমর্থন করবেন তা সময়ই নিশ্চিত করবে। দুই প্রার্থীর স্মরণশক্তি নিয়েও কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। কারণ গত কয়েক মাসে দুজনই তাদের বক্তব্যে এমনভাবে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন যে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এখানেই জনগণের মনে বয়স নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সত্যিই কি দুজনের বয়সই যুক্তরাষ্ট্রকে চালানোর জন্য একটু বেশি নয় কি? যেহেতু দুদল থেকেই তারা দুজন দারুণভাবে নির্বাচিত হয়েছেন, সে ক্ষেত্রে এই দুজনের ওপরেই আপাতত ভরসা রাখতে হবে। ট্রাম্প এবং বাইডেন নীতি অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন। তবে বাইডেনের গতবারের ইস্যুগুলো এবার ভালোভাবে কাজ নাও করতে পারে বৈশ্বিক সমস্যার প্রেক্ষাপটে। ট্রাম্প নির্বাচিত হলে সীমান্ত বন্ধ করে দেবেন এবং অনেক অভিবাসী ফেরত পাঠাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অপরাধের বিরুদ্ধে লড়বেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো, বিদেশি পণ্যে কর আরোপ, ইউক্রেন যুদ্ধে ইতি টানাসহ বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি বাস্তবায়ন করবেন বলেও উল্লেখ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের গত নির্বাচন ছিল এক ঐতিহাসিক নির্বাচন। গত নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয়, নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে বিলম্ব করা এবং একদল উগ্র মানুষের ক্যাপিটাল হিলে হামলা, ভাঙচুর করা এসবই নির্বাচনের পরে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এরপরও বিভিন্ন সময় ট্রাম্পের মন্তব্য, তার বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ প্রভৃতি কারণেও আলোচনায় ছিলেন তিনি। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার নানা কর্মকাণ্ডের কারণে বেশ সমালোচিত। তার বিরুদ্ধে আদালতে কয়েকটি মামলাও চলছে। এসব তাকে সম্ভবত আরো বেশি জনপ্রিয় করে তুলেছে। প্রার্থীদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই কথার লড়াই শুরু হয়েছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রিপাবলিকান প্রার্থী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে লুজার বা পরাজিত বলে কটাক্ষ করেছেন।

বৃহস্পতিবার উইসকনসিনে এক বিশাল সমাবেশে ট্রাম্পকে পরাজিত বলে কটাক্ষ করেন বাইডেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে সরাসরি টেলিভিশন বিতর্কে অংশ নেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর ‘যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গায়’ বাইডেনের সঙ্গে এই বিতর্কের জন্য প্রস্তুত বলেও জানিয়েছেন তিনি। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ এবং প্রাকৃতিক কারণে শরণার্থীর সংকট একটি বড় ধরনের সমস্যা। এ সমস্যা ইস্যুতে দুজনের অবস্থান ভিন্ন। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জরিপে কেন ট্রাম্পের চেয়ে বাইডেন পিছিয়ে রয়েছেন তার প্রধান কারণ সম্ভবত ফিলিস্তিন ইস্যুতে বাইডেনের অবস্থান। সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা নমনীয় হলেও প্রথম থেকে ইসরায়েলকে ভালোভাবেই সমর্থন দিয়ে গেছেন বাইডেন। অনেকেই বিশ্বাস করেন যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই এর একটি দ্রুততম গ্রহণযোগ্য সমাধান করতে পারে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হলো ইসরায়েল। এতসংখ্যক নিরীহ মানুষ মারা যাওয়ায় ক্ষোভের কিছুটা যুক্তরাষ্ট্রের দিকেও গেছে। কারণ সেখানের কিছু অঙ্গরাজ্যে মুসলিম ভোটার ফ্যাক্ট রয়েছে, যারা গত নির্বাচনে ট্রাম্পকে বদলে বাইডেনকে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু এবার তারা কী করবে? কারণ দুই প্রার্থীর কাউকেই তারা সেভাবে আশা করবেন কি? হয়তো না। যদি সেটাই হয় তাহলে এই ভোটও ভাগ হয়ে যেতে পারে, যা টানটান উত্তেজনার সময় ফ্যাক্ট হয়ে দাঁড়াতে পারে। বর্তমান সংকটাপন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়। একদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধে ইউক্রেনকে সর্বাত্মক সমর্থন, রাশিয়ার ওপর নানা অবরোধ আরোপ, হামলার নিন্দা এবং ঠিক উল্টোদিকে ইসরায়েলের ফিলিস্তিনে ভয়ংকর আগ্রাসনে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলকে সহযোগিতা এবং সমর্থন অর্থাৎ পরস্পরবিরোধী অবস্থান বাইডেনকে বেশ সমালোচনায় ফেলেছে। যেখানে বারবার যুদ্ধ থামানো বিষয়ে ঐকমত্য জরুরি, সেখানে যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। এই রোজার মধ্যেই ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরছে। ত্রাণ নিতে গিয়েও মানুষ মরছে। এই পরিস্থিতিতে সবার আগে দরকার যুদ্ধবিরতি। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নির্বাচনে রাশিয়ার সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ ওঠে। ট্রাম্পের মার্কিন মসনদের ক্ষমতায় আসা যেন বেশ নাটকীয়। ধনকুবের ব্যবসায়ী থেকে রীতিমতো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর জলবায়ু থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত, অভিবাসী ইস্যু প্রভৃতি বিষয় নিয়ে একের পর এক সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন তিনি। তার সময়েই চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ লেগে ছিল এ পরাশক্তির। শুল্ক এবং পাল্টা শুল্ক আরোপের ভেতর দিয়েই গেছে বছরের পুরোটা সময়ই।

ট্রাম্পের সময়ে নীতি ছিল আমেরিকা ফার্স্ট আর বাইডেনের যুক্তরাষ্ট্রের স্বমূর্তিতে ফিরে আসার নীতি। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত ইস্যু বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে। এখন দেখা যাক, আগামী নির্বাচনে প্রার্থিতার ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো প্রভাব বিস্তার করবে। নিঃসন্দেহে গত কয়েক দশক থেকে বর্তমানের পরিস্থিতি ভিন্ন। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতা, নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখা, করোনা ও যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিও দুঃসময়ে, বেকারত্ব প্রভৃতি নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমেরিকার। আগামীর নতুন বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে তা নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রকে কতটা দক্ষতার সঙ্গে একটি বৈশ্বিক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া যায়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের একক নেতৃত্বের বিষয়টি আরো প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে কি না আগামী নেতৃত্বের জন্যও এটা চ্যালেঞ্জ। এই কাজটি যে ভালোভাবে করতে পারবেন যুক্তরাষ্ট্রের ভোটের পাল্লা তার দিকেই ভারী। তার ওপরেই জনগণ আস্থা রাখবেন। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন ইস্যু এবং বিশ্বে পারমাণবিক উত্তেজনা কমানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আশা করে বিশ্ব। তা ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক দক্ষতায় এগিয়ে থাকা এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণে আমেরিকার ভূমিকা শক্তিশালী করার নীতিও আগামী নির্বাচনে ফ্যাক্ট হয়ে কাজ করবে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সে ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য প্রশ্নের মুখে। বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র যে বিশ্বে একক কর্তৃত্ব ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে তা স্পষ্ট। এবার লড়াই হবে আরো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। তার ওপর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে, যা ঠিক করবে জনগণ কোন দিকে যাবে। ট্রাম্পের ট্রাম্পকার্ডের বিপরীতে বাইডেনের ওভার ট্রাম্প কী হতে পারে সে অপেক্ষায় নির্বাচন পর্যন্ত থাকতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close