মাহুরী কবীর শেফা

  ১১ মার্চ, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

বিশ্ববাণিজ্যে জিআই পণ্যের অর্থনৈতিক গুরুত্ব

এমন অনেক পণ্য বা খাদ্যপণ্য আছে, যা শুধু একটি নির্দিষ্ট এলাকাতেই উৎপাদন হয়। ওই একই পণ্য অন্য কোনো এলাকায় উৎপাদিত হলেও একই স্বাদ পাওয়া যায় না। যেমন- বগুড়ার দই, ইলিশ কিংবা দার্জিলিংয়ের চা। এসব পণ্যের গুণমান, স্বাদণ্ডগন্ধ যেন এলাকার মাটি-জল-বায়ু ও মানুষের একান্ত নিজের। শুধু খাদ্যপণ্যই নয়, কৃষিপণ্য, হস্তশিল্প বা শিল্পজাত অনেক পণ্যও রয়েছে, যেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে কোনো এলাকার একান্ত নিজস্ব। এমনকি ওই এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান এবং জলবায়ুর সঙ্গেও এসব পণ্য সম্পর্কিত। এসব পণ্যকে ওই এলাকার পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থাই হলো ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন)। ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই স্বত্ব হলো কোনো ভৌগোলিক অঞ্চলের কোনো পণ্যকে তাদের নিজস্ব পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। কোনো পণ্যের উৎপত্তিস্থল যদি ওই ভৌগোলিক অঞ্চলে হয়, সে দেশের পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে, সেই সঙ্গে, ভৌগোলিকভাবে ও ঐতিহ্যগতভাবে যে পণ্যগুলোকে নিজস্ব হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, তাহলে সেটিকে সেই দেশের ‘ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পণ্যের গুণমান, স্বতন্ত্র-বৈশিষ্ট্য ও খ্যাতির সঙ্গে এর উৎপত্তিস্থলের সরাসরি সম্পর্কের ভিত্তিতে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সংক্ষেপে বলা যায়, ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হলো মেধা-সম্পত্তি অধিকারের একটি কাঠামো, যা পণ্যকে কোনো একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান থেকে উদ্ভূত হিসেবে চিহ্নিত করে এবং এটি সুনির্দিষ্ট করে যে পণ্যের গুণাবলি, খ্যাতি বা বৈশিষ্ট্যগুলো মূলত ওই অঞ্চলের অধিকার। কৃষিপণ্য, খাদ্যদ্রব্য, হস্তশিল্প ও শিল্পজাত পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে জিআই প্রযোজ্য হয়। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, জিআই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, গ্রামীণ অর্থনীতিকে সহায়তা ও নির্দিষ্ট অঞ্চলের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া পণ্যের স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেক দেশ জিআই নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষার জন্য আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছে। আইনি কাঠামোতে রেজিস্ট্রি, মানদ- নির্ধারণ করা ও প্রয়োগের ব্যবস্থার রূপরেখা থাকে। আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ববিষয়ক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস অরগানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম অনুসরণ করে এই জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দিতে হয়। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক সামগ্রী হিসেবে স্বীকৃতি পায় জামদানি শাড়ি। ২০১৭ সালে জিআই স্বীকৃতি মেলে ইলিশের এবং ২০১৯ সালে ক্ষীরসাপাতি আমকে জিআই স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে মাত্র তিনটি পণ্য এই তালিকায় ছিল। এরপর ২০২১ সালে একসঙ্গে ৬টি পণ্যকে জিআই সনদ দেওয়া হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে জিআই পণ্যের সংখ্যা বেড়ে ২৮-এ দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, জিআই পণ্যের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক কতটুকু।

জিআই পণ্যের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব রয়েছে। জিআইয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো সুনির্দিষ্ট এলাকায় পণ্যের প্রসার ঘটানো, এর গুণগত মান বৃদ্ধি ও নকল রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এভাবে মান অক্ষুণ্ণ হলে পণ্যের বাজার বৃদ্ধি পেয়ে স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে এমনকি বিশ্ববাজারেও রপ্তানিযোগ্য হয়ে ওঠে। জিআই সনদ পাওয়া পণ্যের মূল্য বাড়ে ২০ শতাংশ। এ ছাড়া এই শিল্পকে ঘিরে পর্যটন খাতের বিকাশের সম্ভাবনাও অপার। কারণ, এসব খাঁটি পণ্য কিনতে এবং পণ্যগুলো স্বচক্ষে দেখতে দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক ওইসব এলাকায় পরিক্রমণ করবে, যা দেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করবে অনায়াসেই। বিশেষ এক পরিস্থিতিতে ২০১৩ সালে আমাদের দেশে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তর জিআই পণ্য আইন ও সনদ কার্যক্রম প্রবর্তন করে। মূলত, জামদানি শাড়ি ও ইলিশ মাছ যখন ভারতে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধ পাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন এটি করা হয়েছিল। দেশে ২০১৩ সালে জিআই আইন হলেও ১০ বছরে মাত্র ১০টি পণ্য জিআইভুক্ত হয়েছে। তবে গত ১ বছরে আরো ১০টি পণ্য জিআইভুক্ত হয়েছে। সম্প্রতি ভারত টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করলে এ নিয়ে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়। পরে ৬ ফেব্রুয়ারি দ্রুততার সঙ্গে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসন টাঙ্গাইল শাড়ির জিআইয়ের জন্য আবেদন করে। এখন টাঙ্গাইল শাড়িসহ ১০টি পণ্যের জার্নাল প্রকাশিত হয়েছে। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে আছে রংপুরের হাঁড়িভাঙা আম, মৌলভীবাজারের আগর আতর, মুক্তাগাছার মণ্ডা, গোপালগঞ্জের রসগোল্লা, রাজশাহীর মিষ্টি পান, জামালপুরের নকশিকাঁথা, যশোরের খেজুর গুড় এবং নরসিংদীর অমৃত সাগর কলা।

একটি পণ্যের জিআই সনদ পেতে জার্নাল প্রকাশের পর দুই মাস অপেক্ষা করতে হয়, কোনো অভিযোগ বা আপত্তি-নিষ্পত্তির জন্য। তবে জার্নাল প্রকাশ করার কাজ শেষ হতে না হতেই পণ্যের জিআই হয়ে গেছে বলে প্রচার করা হয় সরকারের তরফ থেকে। অবশ্য এভাবে পণ্য নথিভুক্ত করার ত্বরিতপ্রবাহকে মন্দের ভালো বলেই মনে করেন অনেকে। তবে জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর একটি পণ্য বাণিজ্যিকভাবে কতটুকু সুবিধা পাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। কোনো পণ্য জিআই হলে এর প্রচার ও বিক্রি দুটোই বৃদ্ধি পায়। জিআই পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ের ফলে দেশে পর্যটন ও রপ্তানি বাড়ে, কৃষক, উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা লাভবান হন। এসব পণ্য ক্রেতারা বাড়তি দাম দিয়ে কিনতেও রাজি থাকেন। তবে দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে এসব নিয়ে কোনো রকম গবেষণা বা পরিসংখ্যান নেই।

স্থানীয় ও বৈদেশিক বাণিজ্যে জিআই স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে আমাদের দেশ এখনো বিভিন্ন পণ্যের জিআই স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে।

আগেই বলা হয়েছে, জিআই স্বীকৃতি পেলে একটি পণ্যের বাড়তি মূল্যমান যুক্ত হয়। বিশেষ করে পণ্যটির বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই সুবিধা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এর জন্য ওই পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ের দরকার হয়। এ ক্ষেত্রে পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের পক্ষে পণ্যের ব্র্যান্ডিং করা সম্ভব নয়। সেজন্য সরকারি উদ্যোগ অত্যাবশ্যক। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে কোনো পণ্যের ক্ষেত্রেই তা মানা হয়নি। পণ্যের জিআই স্বীকৃতি দেওয়ার পর কী করতে হবে, তা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা ও কার্যক্রম পরে আর পরিলক্ষিত যায় না।

বলতেই হয়, যেহেতু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়া গেছে, সে কারণে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে সরকারের রপ্তানি আয় বৃদ্ধির অংশ হিসেবে এসব পণ্যের উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট মহলকে

এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে। তবেই আমাদের কৃষ্টি-কালচার আর ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি বিশ্ববাসীর কাছে প্রতিফলিত

হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকেও ত্বরান্বিত করতে পারবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close