নাজনীন বেগম

  ০৩ মার্চ, ২০২৪

মতামত

নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা

২০২৪ সালের নব সম্ভাবনায় দেশ এগিয়ে যাক এমন প্রত্যাশায় সাধারণ জনগোষ্ঠী অপেক্ষমাণ। সম্প্রতি শেষ হলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নতুন সংসদ বিভিন্নভাবে দ্রব্যমূল্য কমানোর আশা ব্যক্ত করলেও বাস্তবে তা প্রায়ই অসহনীয়। যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের স্বস্তি আর সমৃদ্ধি অনেকটাই নির্ভর করে সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের নানামাত্রিক প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিতে। উন্নয়ন শব্দের সার্বিক মহিমাও তেমন বাতাবরণকে নিশ্চিত করে। আর বাংলাদেশ তো ধন ধান্যে, পুষ্পে ভরা উর্বর পলিমাটির এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি।

যেখানে বীজ বপন করলে সহজেই সজীব সতেজ হয়ে বেড়ে উঠতে দেখা যায়। অবহমান বাংলা চিরস্থায়ী এমন আবেদনে সক্রিয়তার দৃশ্য উন্মোচন করলেও কোথায় যেন এক বিসদৃশ চিত্র গভীর অন্তর্জালে জিইয়ে থাকে। কৃষি উৎপাদনশীলতার শাশ্বত বঙ্গভূমি তার নিজস্ব বৈভব এখনো অবধি হারাতে বসেনি, তেমন চিত্র আড়ালেও থাকছে না। নিত্যনতুন আধুনিকতার যোগসাজশে ফলন বৃদ্ধিও দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার কথা। সমস্যাটা সেখানেই কেমন যেন স্থবিরতার গভীর কোপানলে আবদ্ধ। সংগত কারণে এ মুহূর্তে জাতি পার করছে এক অসহনীয় লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের কঠিন জাঁতাকল। প্রতি বছরই রমজানের আগে নিত্য এবং প্রাসঙ্গিক ভোগ্যপণ্যের দাম ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়াও পরিস্থিতির বিপরীত আবহ। রমজানের আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। ইতিমধ্যে দরকারি খাদ্যপণ্যের দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে, যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি তো বটেই। এ কথা সুবিদিত ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা মূল্য কখনো পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায় না। বরং তা আরো সহ্য-ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করে যায়। ইতিমধ্যে চাল, ডাল, আটা, ময়দা, চিনি, তেলসহ প্রয়োজনীয় পণ্য আগের তুলনায় বেশি দামে বিক্রি হওয়ার অশান্ত পরিবেশ জনগণকে অস্থির করে তুলেছে। দ্রব্যমূল্যকে সহনীয় অবস্থায় ফেরাতে সরকার দৃশ্যমান অনেক বাস্তবতা হাজির করলেও শেষ অবধি তা আর জনগণের দ্বারে না পৌঁছানোও এক অবধারিত অপদৃশ্য। ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সাল অতিক্রম করে এখন ২০২৪ সালের নব গিদন্তে নিজেদের অবস্থান হিসাবনিকাশ করলে হতাশা ছাড়া আর কোনো কিছুই সামনে আসে না। নতুন পেঁয়াজ আসার আগেই পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাচ্ছে। তাও আবার দু-একবার নয়, বারবার এমনটি হচ্ছে। বাজারে মুড়িকাটা পেঁয়াজ আসায় পেঁয়াজের বাজার কিছুটা স্বাভাবিক দৃশ্যমান হলেও ভোক্তা-শ্রেণি তার সুফল পেতে কত সময় যে পার হয়ে যায়, যা কোনো হিসাবের মধ্যেই আসে না। প্রয়োজনের তুলনায় উৎপাদন কম হচ্ছে, এমন চিত্র কিন্তু সেভাবে উঠেও আসে না। সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা দৃশ্যমান হয় সার্বিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানকে সহনীয় করার বিভিন্ন কার্যক্রমে। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বাজার ঢেলে সাজানোর আভাস দিয়ে গেলেও জনগণের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ পরিশেষ নেই বললেই চলে। কারণ, নিত্য গ্রাহকদের সেই চড়া মূল্যেই তার প্রতিদিনের খাদ্যপণ্যকে কিনতে হচ্ছে। তবে সবার আগে জনগোষ্ঠীকে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে হয়, যা সবার মৌলিক এবং নাগরিক অধিকারও। অধিকারের ব্যত্যয়ও জনগণকে সেভাবে তাড়িত করে না। আসলে তারা অনেকটাই জানে না কিংবা বুঝতেও চায় না। আর চড়া মূল্যে পণ্য কিনতে গিয়ে একসময় ধাতস্থ হয়, মেনেও নেয়। আগের দাম মনেও থাকে না। আর এটাই দেশের যথার্থ চিত্র। পবিত্র রমজানের মূল পণ্যই কিন্তু পেঁয়াজ। ইফতারির হরেক রকম খাবার তৈরিতে পেঁয়াজের প্রাসঙ্গিকতা নজরকাড়া। ডাল, ছোলা, চাল, তেল এমনসব পণ্যও রোজার মাসে বহুল ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যা চিরকালের ঐতিহ্য ও সম্ভার। তেমন পণ্যসামগ্রীই অসহনীয় মূল্যে জনগণের হতাশা বাড়াতে থাকে। সেসব খাদ্যপণ্যের চড়া দামে কষ্টকর অবস্থায় পড়ে যায় দেশের সাধারণ ও নিম্ন আয়ের মানুষ। মধ্যবিত্তদেরও কম নাভিশ্বাস হয় না। কারণ, সিংহভাগ মানুষের আয়-রোজগার না বাড়াও নির্মম পরিস্থিতিকে আরো নাজেহাল করে তোলে। শীতের সবজিও জনগণকে কাবু করার অবস্থায়। বাজারে শীতের সবজি জোগান প্রায় শেষ হতে চলল। সামনে আরো কী দিন অপেক্ষা করছে সময়ই তার জবাব দেবে। ফুলকপির চড়া মূল্য এবার নাকি অন্যবারের চেয়ে বেশি। আর বেগুন? যা শুধু নিত্যপণ্যই নয়, রমজানের অন্যতম মুখরোচক খাবার বেগুনির মূল উপাদান।

সেখানেও আগুন জ্বলছে বলে তথ্য-উপাত্ত নির্দেশ করে। আর এমন সব অসহনীয় দুর্বিপাককে চিহ্নিত করতে গিয়ে সামনে আনা হয় অসাধু চক্র বাজার সিন্ডিকেটকে। তারা কি সমাজবহির্ভূত কিংবা বিচ্ছিন্ন কোনো গোষ্ঠী? ধরাছোঁয়ার বাইরে এমনটাও বলা কঠিন। এই অসাধু চক্রের অপতৎপরতায় জনজীবনে দেখা দিচ্ছে নিয়ন্ত্রণহীন এক অশান্ত দুর্ভোগ। আবার এই চক্রটি একেবারেই যে চিহ্নিত নয়, তাও কিন্তু বলা যায় না। তবে এমনসব অসাধু সিন্ডিকেট নজরে আসতে পারছে না। বিশেষ করে সার্বিক জনগোষ্ঠীর অন্তরালে থাকাটাও তাদের নিশ্চিন্ত বাতাবরণ। ডিম, মুরগি, মাছ, মাংসও সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। ইতিমধ্যে গরুর মাংস ৬৫০ থেকে ৭৫০-তে চলে যাওয়াও জনগণের জন্য চরম বিপত্তি তো বটেই। বিশেষ করে নিম্নবিত্তের সাধারণ মানুষ ব্রয়লার, কক কিংবা সোনালি মুরগিতেই অভ্যস্ত হলেও সেখানেও মূল্যবৃদ্ধি সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার নিয়ত দুর্ভোগ। সরকার আমদানি করা পণ্যের শুল্ক কমালেও খুচরাতে তার প্রভাব না পড়ারই দুরবস্থা। আর সাধারণ মানুষ কিন্তু খুচরাতেই তার নিত্যপণ্যের বাজারে অভ্যস্ত। তাই শুল্ক কমলেও জনগণ তার নাগালও পাচ্ছে না। তবে ভোজ্য তেলের দাম লিটারপ্রতি ১০ টাকা কমে যাওয়ার দৃশ্য স্বস্তিদায়ক, যা আমদানি শুল্কের কমে যাওয়ার প্রভাব বলছেন অনেকেই। কিন্তু সব অসহনীয় দুর্ভোগ বর্তাচ্ছে সেই অতি সাধারণ নিম্নবিত্তের মানুষের ওপর। যারা দিন আনে দিন খায়। যাদের আয়-রোজগার কোনোভাবেই বাড়ছে না। বরং দুঃসময়ে আয় কমতির দিকে চলে যেতে দেরিও হয় না। রমজান মাসের আর এক প্রয়োজনীয় খাদ্য ছোলা, যা ইফতারির অন্যতম সুস্বাদু খাবার। তবে এমন সুস্বাদু পণ্যটির সরবরাহ এখন অবধি স্বস্তিকর। আগামীতে কী হবে তা বলা মুশকিল। সম্প্রতি সম্পন্ন হলো ইবাদত-বন্দেগির আর এক ধর্মীয় অনুভব পবিত্র রাত, শবেবরাত, যা উৎসব আয়োজনেরও এক অবিমিশ্র বিষয়। রুটি, হালুয়া, মাংসের অভাবনীয় রন্ধনশৈল পবিত্র রাতটিকে এক অনন্য মাহাত্ম্যে নিয়ে যায়। যেখানে ধর্মীয় অনুভূতি ও নামাজ-রোজার মতো আধ্যাত্মিক বিষয় জনগণকে উদ্বেলিত করে। সেখানেও পড়ে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মুনাফা লুণ্ঠন আর কুনজর, যা এক অনধিগম্য দুঃসহ যাতনা। সমস্যায় জর্জরিত হয় খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে কৃষি উৎপাদনশীলতার হাল ধরে, জোগান দেয়। বীজ মাত্রই সরস, সজীব হয় এমনটাও নয়- যা শুধু কবি-সাহিত্যিকদের শৈল্পিক ঝঙ্কার। বরং মানুষের দিনান্ত পরিশ্রমের অভাবনীয় যোগসাজশই ধন ধান্যে, পুষ্পে ভরা এই আবহমান বঙ্গভূমি। তার সঙ্গে সমুদ্র পরিবেষ্টিত ও নদীবিধৌত চিরায়ত বাংলা যুগ যুগ ধরে এক অভাবনীয় সম্পদের জের ধরেই নরম-পলিমাটির এক উর্বর ভূমিনির্ভর সমাজব্যবস্থার চিরায়ত পীঠস্থান। শুধু বৈষয়িক সম্পদই নয় নৈসর্গিক সম্ভারেরও এক দর্শনীয় লীলাক্ষেত্র। এমন সুশোভিত ও বর্ণাঢ্য বাংলাদেশ কোন দুর্বিপাকে তার সমস্ত শুভশক্তি ও ঐশ্বর্যকে মøান করে সাধারণ মানুষকে বিপন্নতার শেষপর্যায়ে নিয়ে যায় ভাবতে গা শিউরে ওঠে। আমাদের সুজলা, সুফলা বাংলায় নিত্য খাদ্যপণ্যের ঘাটতি সেভাবে দৃশ্যমান নয়। দাম যতই চড়া হোক, অর্থের বিনিময়ে তা পাওয়া যাচ্ছে সেটা কিন্তু কম বড় কথা নয়। ঘাটতি তো নেই-ই। বরং কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারকে অস্থিতিশীল করার যে অশুভ অপশক্তি তাদের কবজায় আনতে ব্যর্থ হলে সমস্যা যে গভীরে, সেই তিমিরেই জিইয়ে থাকবে তা বলাই বাহুল্য। নতুন সরকার সূচনালগ্নেই বাজার সিন্ডিকেটের ওপর কঠোর নজরদারি শুরু করলেও সাধারণ মানুষ এখনো তার শতভাগ সুফল পাচ্ছে না।

জেল, জরিমানা এমনসব বিধিনিষেধের আওতায় ব্যবসায়ী অপশক্তিকে বেঁধে দেওয়া হলেও কোনো বাস্তব সহনীয় দৃশ্য আজও আড়ালেই। অপরাধীরা ধরা পড়ে কি না তা অনেক সময় জানাও যায় না। আর পড়লেও আইনি কর্মযোগ কীভাবে প্রয়োগ হয় সেটাও থেকে যায় অদৃশ্য। কেন এত গোলকধাঁধা? অদৃশ্য বাতাবরণ, যা কোনোভাবেই লোকসমক্ষে আসতে প্রাচীরসম বাধা তৈরি হয়। বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্যে উঠে আসে বাজার সিন্ডিকেট নাকি এক অভেদ্য ধূম্রজাল, যা অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার অন্যতম। শুধু কি তাই? যখন থেকে মানুষ খাদ্য মজুদ অর্থনীতির দ্বারপ্রান্তে নিজের সীমানা অবারিত করে, তখন থেকেই এই মজুদদারির কালো অর্থনীতির অপচ্ছায়া, যা একবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকেও পরাভূত করে যাচ্ছে। ইতিহাসের পালাক্রমে সেই অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে অবিভক্ত বাংলা প্রত্যক্ষ করে ১২৭৬ সালের মহা-মন্বন্তর, যা ইংরেজি ১৭৬৯ সাল। আবার ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরও সাড়া জাগানো এক দুর্ভিক্ষ, যা বঙ্গবন্ধু মাত্র ২৩ বছর বয়সে উপলব্ধিতে আনতে পেরেছিলেন। ধারণা করা হয়, বিভিন্ন দুর্ভিক্ষ শুধু খাদ্য ঘাটতির জন্য হয়নি, হরেক মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে দুটো দুর্ভিক্ষ অবিভক্ত বাংলাকে কাঁপিয়ে দেয়- ইতিহাসের এমন নির্মম সত্য আজও সমকালীন পণ্ডিত আর বিজ্ঞজনদের লেখনীতে স্পষ্ট হয়ে আছে। এমন কঠিন বেড়াজালে আবদ্ধ দুর্বৃত্তায়ন চিহ্নিত হতে আরো সময় নিলে দ্রব্যমূল্যের লাগাম ধরাও অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাবে।

মজুদদারি, কালোবাজারিদের সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে চিহ্নিত করে দ্রব্যমূল্যকে অতি সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া এখন সময়ের দাবি, পরিবেশ পরিস্থিতির ন্যায্যতা। তবে ইতিমধ্যে সরকারি নির্দেশে বিভিন্ন গুদামজাত চালের আড়তে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে খাদ্য অধিদপ্তর। জেল-জরিমানা সবই দৃশ্যমান হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপট তার ধরাছোঁয়ার বাইরে। সরকারের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান টিসিবিও চাল থেকে বিভিন্ন খাদ্যপণ্য সহনীয় মূল্যে জনগণকে দিতে না পারার চিত্রও উঠে আসছে, যা সারা দেশকে বিব্রতকর অবস্থায়ও ফেলছে। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়- কোনো জিনিসের দাম একবার বেড়ে গেলে তা কখনো কমার দৃশ্য সামনে আসে না। বরং সাধারণ মানুষই অভ্যস্ত হয়ে যায় চড়া মূল্যকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে। ফেলে আসা সব দুর্বিপাক মুছে যাওয়ার দুরবস্থায়। তেমন চড়া মূল্য যখন আবারও বাড়ে জনগণের সচেতনতাও নতুন করে নিবদ্ধ হয় বর্তমান সময়ের ওপর। সুদ যেমন চক্রাকারে বৃদ্ধি পায়, বাজারমূল্যও সে মাত্রায় চক্রাকারে ঘুরপাক খেতে থাকে। সেখান থেকে মুক্তি যে কখন মিলবে তা বলা মুশকিল।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close