প্রকাশ ঘোষ বিধান

  ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

মুক্তমত

জলবায়ুর প্রভাবে উপকূলে ভূমির ব্যাপক পরিবর্তন

জলবায়ু পরিবর্তনে নদীভাঙন-ভরাটসহ উপকূলীয় অঞ্চলে ভূমির ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে স্থানীয় কৃষক ও মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকা মারাত্মক হুমকির পড়ছে। কৃষকরা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াই করে ফসল উৎপাদন করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে বৃদ্ধি পেয়েছে নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি আঘাত হানে। এগুলোর মধ্যে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্ব¡াস, বন্যা, নদীভাঙন এবং ভূমিধসের মাত্রা বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে পরিবর্তনশীল সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বিশাল এক জনগোষ্ঠীর জীবিকা এখন হুমকির মুখে।

বাংলাদেশের উপকূলে বসবাসকারী মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পরিবর্তশীল উপকূলরেখা। বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে হিমালয়ের বরফগলা পানিসহ উজানের নেপাল ও ভারতের বৃষ্টিপাতের পানি বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদ-নদী গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। প্রতি বছর গড়ে ১০৯৪ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং প্রতি বছরই প্রায় ১৫ লাখ হেক্টর চাষের জমি বন্যা ও জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে। যার ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। উপরন্তু শীতকালে পানির স্রোত কম থাকায় সামুদ্রিক লোনাপানি উজানে প্রবেশ করছে। যার ফলে চাষাবাদ নিয়ে সংকট মোকাবিলা করছে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ।

বাংলাদেশে ৭১০ কিলোমিটার উপকূলীয় সমুদ্র তটরেখা রয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবন উপকূল ঘিরে রয়েছে ১২৫ কিলোমিটার এবং কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত ৮৫ কিলোমিটার। সমুদ্র উপকূল বরাবর রয়েছে গঙ্গা ও মেঘনা অববাহিকায় অবস্থিত প্রশস্ত জোয়ারভাটা সমভূমি এবং অসংখ্য নদী মোহনার ব-দ্বীপ। নদী সঙ্গমের ব-দ্বীপগুলো ও সমুদ্রে তটরেখা বরাবর ভূ-খণ্ড প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। বিগত ২০ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এর পরিমাণ ক্রমানায়ে বাড়ছে। চট্টগ্রাম উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্র তটরেখা সংকুচিত হচ্ছে এবং ভূ-ভাগের দিকে এগিয়ে আসছে। এ ছাড়া জলোচ্ছ্বাস বা ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের অবকাঠামো বেড়িবাঁধ ভেঙে পড়েছে। ফলে অবাধে লোনাপানি প্রবেশ করে জলবদ্ধতাকে স্থায়ী রূপ দিচ্ছে।

বাংলাদেশে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, উপকূলীয় এলাকার নদী ও কৃষিজমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, হিমালয়ের অস্বাভাবিক বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি সবদিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে শীর্ষ। আর দেশের মধ্যে শীর্ষে আছে উপকূলীয় অঞ্চল। উপকূলের পাইকগাছায় শিবসা নদী নাব্যতা হারিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে আবার কপোতাক্ষ নদের দুই পাড় ক্রমাগত ভাঙনের ফলে উপকূলরেখা হারিয়ে যাচ্ছে। উপকূলের নদ-নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম শিবসা নদী। কপোতাক্ষের শেষ প্রান্ত থেকে শুরু হয়েছে শিবসা, যা মিশেছে সুন্দরবন উপকূলে। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে নদীটি প্রায় ভরাট হয়ে যাওযার উপক্রম হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর। শিবসা নদীর দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৫ কিলোমিটার যা ভরাট হয়ে গেছে।

বর্ষাকালে সামগ্রিকভাবে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং শুষ্ক মৌসুমে অতিরিক্ত খরা দেখা যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টিপাত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত না থাকলেও অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে ফসলের খুব ক্ষতি হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ঘন ঘন বৃষ্টিপাত কৃষকদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষকরা শুধু ফসলের ধরন পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়নি বরং ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং জলোচ্ছ্বাসের কারণে কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। উপকূল এলাকার কৃষির মৌসুম পিছিয়ে গেছে। অন্য এলাকা থেকে প্রায় এক মাস পরে এখানে আবাদের পরিবেশ তৈরি হয়। আবার উপকূলীয় এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে সুপেয় পানির অভাবে খরার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশনির্ভর উপজীবিকারা তাদের জীবিকা হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়ছে। মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় স্বাদু পানির জেলে, সমুদ্রগামী জেলে এবং মোহনাগামী জেলে তাদের জীবিকার উৎস হারাচ্ছে। এতে দেশের বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। বর্তমানে এ রকম ঝুঁকির মধ্যে আছে উপকূলের এক লাখেরও বেশি জেলে। এ ছাড়া ঘন ঘন বন্যা বা দীর্ঘমেয়াদি বন্যা মানুষের কাজের সুযোগ কমিয়ে দেয়। এর ফলে উপকূলীয় এলাকার লোকরা শহরমুখী হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে ১৫ কিংবা ২০ বছর পরপর বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও বর্তমানে অস্বাভাবিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা প্রত্যেক বছরে হানা দিচ্ছে। সুপার সাইক্লোন যার ঢেউয়ের উচ্চতা ১৬ ফুট বা প্রায় ৫ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। এগুলো বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এই ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার জন্য উপকূলবাসীর প্রস্তুত থাকতে হয়। সবকিছু মিলে জলবায়ুজনিত বিপর্যয় এবং নদীভাঙন-ভরাটসহ উপকূলীয় অঞ্চলে ভূমির ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে উপকূলের বিশাল এক জনগোষ্ঠীর জীবিকা এখন হুমকির মুখে।

লেখক : পরিবেশবিদ ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close